শাকিলের উদ্ভাবনে বদলে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসা ব্যবস্থা
- লিডারশিপ ডেস্ক
রোগীর ইতিহাস জানতেই ব্যয় হয়ে যায় ডাক্তারদের কর্মঘণ্টার বড় একটা সময়। ডকুমেন্টেশনের এ কাজটা যদি আরেকজনকে দিয়ে করানো যায়, তাহলে আগের চেয়ে অনেক বেশি রোগী দেখতে পারেন একজন ডাক্তার। বাংলাদেশে যেমন রোগীর হিস্টরি লেখার কাজটি করেন তাঁর সহকারীরা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত কোনো দেশে সহকারী রাখাটাও ব্যয়বহুল। মার্কিন ডাক্তারদের জন্য বিকল্প পথ খুঁজতে লাগলেন বায়োটেকনোলজির গ্র্যাজুয়েট বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ইয়ান শাকিল। এমন একটা উপায় যা একই সঙ্গে কার্যকর ও টেকসই। বন্ধু পেলু ট্র্যানের সঙ্গে একদিন গুগল গ্লাস নিয়ে কাজ করছিলেন বাংলাদেশের শাকিল। চোখে গ্লাস পরা অবস্থায় হঠাৎ তাদের মনে হলো, আরে এটি ব্যবহার করেই তো ডকুমেন্টেশনের কাজটা করা যায়। নিবিড়ভাবে কাজে লেগে থাকলেন দুই উদ্যোক্তা। প্রাথমিক ধারণাগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, কর্মীদের প্রশিক্ষণ সবকিছু পর্যায়ক্রমে শুরু করেন তাঁরা। প্রস্তুতিতেই কেটে যায় বছর দুয়েক। ২০১৪ সালে পুরোদমে কাজ শুরু করে অগমেডিক্স।
অগমেডিক্স পদ্ধতিতে বাংলাদেশে অবস্থানরত সহকারীর মাধ্যমে রোগীর ইতিহাস লেখার কাজটি করিয়ে নেন একজন মার্কিন চিকিৎসক। ওই চিকিৎসক ও এখানে কল সেন্টারে কর্মরত একজন অপারেটর গুগল গ্লাস পড়েন। চিকিৎসকের সঙ্গে রোগী কথা বলেন, তাঁদের কথোপকথন শুনে লিপিবদ্ধ করেন ডেটা অপারেটর। চিকিৎসক রোগীকে যেসব গাইডলাইন দেন সেগুলোও তিনি ব্যবস্থাপত্র আকারে লিখে ফেলেন। এসব তথ্য কল সেন্টারের দায়িত্বরত অপারেটর একটি নির্দিষ্ট ডাটাবেইসে ডকুমেন্ট আকারে সেভ করে রাখেন। পরে অগমেডিক্স অ্যাপ্লিকেশনের সাহায্যে যেকোনো সময় রোগী বা চিকিৎসক এটা দেখতে পাবেন। মোট কথা, গুগল গ্লাস ব্যবহার করে অডিওর মাধ্যমে রোগীকে পরামর্শ, ব্যবস্থাপত্র সবই দিতে পারেন একজন চিকিৎসক।
মিলিয়ন ডলার প্রতিষ্ঠান
শুরুতে গুগল গ্লাস নিয়ে কাজ করা তাঁদের কাছে বেশ কঠিনই ছিল। তবে বায়োটেকনোলজিতে পড়া দুই বন্ধু দমে যাননি। বরং উদ্যোগটিকে স্টার্টআপ থেকে বিলিয়ন ডলার প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের স্বপ্নও ছিল তাঁদের। তবে এখনই বিলিয়ন ডলারের প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়াতে না পারলেও মিলিয়ন ডলারের প্রতিষ্ঠানে রূপ পেয়েছে অগমেডিক্স।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বড় পাঁচটি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রায় ১৭ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ পেয়েছে অগমেডিক্স। বিশ্বের সর্ববৃহৎ স্টার্টআপ হিসেবেও পুরস্কৃত হয়েছে এটি। অগমেডিক্স এখন প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলারের প্রতিষ্ঠান বলে রয়টার্স একটি খবরে বলেছে।
বর্তমান অবস্থা
অগমেডিক্স স্যান ফ্রান্সিসকোভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হলেও বাংলাদেশ থেকেই পরিচালিত হচ্ছে এর পুরো কার্যক্রম। বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিংয়ের (বিপিও) মাধ্যমে ভারতেও কিছু করা হচ্ছে। গুগল গ্লাসের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী চার শতাধিক ডাক্তারকে যুক্ত করতে পেরেছে অগমেডিক্স। যার বেশির ভাগ মার্কিন। কিছু ছেলেমেয়ে নিয়ে ঢাকায় অগমেডিক্সের পুরো অ্যাপ্লিকেশন উন্নয়ন করেন শাকিল। এটির ফ্রন্ট ও ব্যাক এন্ডের কাজও হয়েছে এ দেশে। এর অপারেশনের পুরোটাই পরিচালিত হয় ঢাকা থেকে, জানালেন অগমেডিক্স বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমাদুল হক।
সফল এ উদ্যোগ চিকিৎসকদের জীবনধারা অনেক সহজ করেছে বলে মনে করেন তিনি। বর্তমান বিশ্বে অগমেডিক্স স্বাস্থ্যসেবায় গুগল গ্লাস ব্যবহার করে নেওয়া সবচেয়ে বড় স্টার্টআপ উদ্যোগ বলে জানান আহমাদুল।
প্রতিবন্ধকতা
বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বিপিওর মাধ্যমে অগমেডিক্স পরিচালনা করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে ইন্টারনেট সংযোগ সমস্যায় পড়তে হয়। যেহেতু প্রতিদিন চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করতে হয় এবং চিকিৎসকদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত থাকতে হয়—তাই নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ প্রয়োজন। এর বিকল্প কোনো ব্যবস্থা দেশে নেই। এ ছাড়া এ খাতে কাজ করার মতো যোগ্য কর্মীর অভাব থাকায় চাহিদা থাকলেও কর্মী নেওয়া যাচ্ছে না বলে জানান আহমাদুল হক।
বেসরকারি সফটওয়্যার পার্ক
দেশে যে কয়েকটি সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক বেসরকারি খাতের হাইটেক পার্ক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে তার একটি অগমেডিক্স। অগমেডিক্স বাংলাদেশ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীনে সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কের স্বীকৃতি পায়। এরপর রাজধানীর পান্থপথে অগমেডিক্স ভবনে প্রতিষ্ঠানটি তাদের কাজের জন্য ব্যবহার শুরু করেছে। চলতি বছরের মে মাসে বাংলাদেশে অগমেডিক্সের কার্যক্রমের এক বছর পূর্তি ও অগমেডিক্স ভবন উদ্বোধনের সময় এই ঘোষণা দেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ।
পরিকল্পনা
অগমেডিক্স সুনির্দিষ্ট কিছু পরিবকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। দেশের চিকিৎসকদেরও উদ্যোগটির সঙ্গে যুক্ত করে বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা অর্জন করাতেও সচেষ্ট এ স্টার্টআপ। দক্ষ কর্মী গড়ে তুলতে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের সঙ্গেও কাজ করছে অগমেডিক্স বাংলাদেশ।
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বড় ধরনের কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে অগমেডিক্স। উদ্যোগটি আগামী এক বছরে ছয় হাজার দক্ষ কর্মী নিয়োগ দেবে। আর এর সবটাই বাংলাদেশ থেকে নিতে চায় বলে জানান আহমাদুল হক। তিনি বলেন, দক্ষ কর্মী গড়ে তোলা প্রয়োজন, যাঁরা পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণ শেষে এ কাজ করার উপযুক্ত হবেন।
যাঁরা অগমেডিক্সে কাজ করেন তাঁদের সম্মানজনক বেতন, বিভিন্ন বোনাস, ছুটি, চিকিৎসা ভাতাসহ বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা দেয় প্রতিষ্ঠানটি। চাহিদা অনুযায়ী অগমেডিক্সে কর্মী সরবরাহ করতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীনে শুরু হওয়া লিভারেজিং আইসিটি ফর গ্রোথ, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এলআইসিটি) প্রকল্পে বিভিন্ন সরকারি-বেসকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে বলে জানান বাংলাদেশের দায়িত্বে থাকা এ উদ্যোক্তা। তবে শিক্ষার্থীরা স্নাতকোত্তর শেষ করেই সরাসরি এ কাজে নিয়োগ পেতে পারেন সেদিকে দৃষ্টি দিতে শিক্ষা পদ্ধতি এবং শিক্ষার্থীদের আরো সচেতন হওয়া দরকার বলে মনে করেন তিনি।