১৬ নারী ফুটবলে জয়ের গল্প
- ক্যারিয়ার ডেস্ক
ঢাকায় এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবলে জয়ের পতাকা ওড়াচ্ছে বাংলাদেশের মেয়েরা। আজ তারা গ্রুপ পর্বে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে নামবে চীনা তাইপের বিরুদ্ধে।
অপ্রতিরোধ্য সানজিদা
প্রথম দুই ম্যাচে গোল না পেলেও সবারই নজর কেড়েছে সানজিদা। সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে অলিখিত সেরা খেলোয়াড় ছিল সে-ই। সানজিদার কর্নারগুলো নিয়ে পরদিন সবাই বলছিল, ‘ইশ্, মেয়েটা কী দারুণ কর্নার নেয়! একদম জায়গামতো ফেলে!’
ভালো ফুটবলার হওয়ার সব গুণই সানজিদার মধ্যে আছে। ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলছে। ঢাকায় দুই বছর আগে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলে সাড়া ফেলেছিল। সেই থেকে নিজেকে আলাদা করে রেখেছে। গতি-স্কিল—সবই ভালো। কোচ গোলাম রব্বানীও একটু অবাক এই মেয়েকে দেখে। পেছনে তাকিয়ে বলেন, ‘শুরুতে একেবারেই আনাড়ি ছিল। লজ্জা পেত। কথা বলতে চাইত না।’
মাঠের বাইরেও সানজিদা এখন চটপটে। দলে কেউ ভুল কিছু বললে প্রতিবাদ করে। এই দলে ময়মনসিংহের বিখ্যাত কলসিন্দুরের আট-নয়জন মেয়ের মধ্যে নিজেকে উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরছে ৭ নম্বর জার্সি পরে খেলা সানজিদা। অন্যদের চেয়ে একটু ‘সচ্ছল’ পরিবারের এই মেয়েটি ২০১৩ সালে ‘প্ল্যান বাংলাদেশ’ টুর্নামেন্টে খেলতে প্রথম ঢাকায় আসে।
সেই শুরু। তবে ২০১৪ নভেম্বরে ইসলামাবাদে সাফ খেলতে যায়নি। যদিও জাপানের কোচ সুকি তাকে অনেক চেয়েছেন। কিন্তু সানজিদার বাবা রাজি হননি। জেএসসি পরীক্ষার জন্য নিয়ে যান বাবা। ফিরে এসে সানজিদা এগিয়ে চলেছে নিজের মতো। গোল দিতে না পারলে সে হতাশ হয়ে পড়ে। সিঙ্গাপুরের সঙ্গে সোমবার ম্যাচের পর রাতে তাকে অনেক বোঝান কর্মকর্তারা। এক কর্মকর্তা বলেন, ‘তুই কি জানিস, তুই কর্নার নেওয়ার সময় গ্যালারি থেকে সানজিদা, সানজিদা আওয়াজ উঠেছে। তোর এত হতাশ হলে কি চলে!’
সানজিদা শুধু নিজেকে নিয়ে নয়, পুরো দল নিয়ে ভাবে। ড্রেসিংরুমে ২৩ জন খেলোয়াড়কে এনার্জি ড্রিংকস দেওয়া হয়। দলের এক কর্মকর্তা সবাইকে বললেন, সব ড্রিংকস এক জায়গায় রাখতে। সানজিদা বলল, শুধু একাদশের খেলোয়াড়দের ড্রিংকসগুলো রাখতে। সব একসঙ্গে রাখলে একাদশের খেলোয়াড়েরা সব খেয়ে ফেলে। বেঞ্চের খেলোয়াড়েরা পায় না। সানজিদার এই গুণের কথা বললেন দলের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা সাদিয়া আফরিনও।
বাংলাদেশ দলের এই খেলোয়াড় বেশ ফ্যাশনসচেতনও। সেই প্রসঙ্গ উঠতেই সানজিদা হেসে বলল, ‘কই আর ফ্যাশন করি। ফ্যাশন করার টাইম কই!’
অফুরন্ত দম মৌসুমির
প্রথম দুই ম্যাচে দুই গোল করা মিসরাত জাহান (মৌসুমি) পরিশ্রমী খেলোয়াড়। অন্যদের চেয়ে তার দমই নাকি সবচেয়ে বেশি। রংপুরের এই মেয়ে ৮ নম্বর জার্সি পরে খেলে। শুধু পায়েই খেলে না, ভালো কথাও বলতে পারে। কোচ তো সবাইকেই ভালোবাসেন, সবাইকেই তাঁর পছন্দ। তবে মৌসুমির ওপর এখন তাঁর নির্ভরতা একটু বেশিই। এসএ গেমসের একাদশে ছিল মৌসুমি। নেপাল ও তাজিকিস্তান চ্যাম্পিয়ন হওয়া অনূর্ধ্ব-১৪ দুটি টুর্নামেন্টেই দলে ছিল।
মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে মৌসুমির ‘ভদ্র খেলোয়াড়’ হিসেবে একটা পরিচিিত আছে। দেখতেও বেশ সুন্দর। সব সময়ই পরিপাটি থাকে। তবে মূল লক্ষ্য ভালো খেলা। সেটাই বলছিল সে, ‘ভালো খেলা ছাড়া আমার মাথায় আসলে আর কিছু নেই।’
অনূর্ধ্ব-১৪ ফুটবলে ভুটানকে বাংলাদেশ দল ১৬ গোল দিয়েছিল সম্প্রতি নেপালে। বাংলাদেশ দলের এক কর্মকর্তা মজা করে তখন বলেছিলেন, ‘এত গোল দেওয়ার কী দরকার ছিল?’ মৌসুমির উত্তরটা ছিল এমন, ‘স্যার, ওরা তো আমাদের বড় বোনদের গোল দিয়েছিল। সেটা তো আমরা ভুলে যাইনি।’
দায়িত্বশীল কৃষ্ণা
কৃষ্ণা রানী সরকার সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে দুই গোল করেছে। অধিনায়ক হিসেবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারে। মাঠের বাইরে একটু চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে। প্রথম যখন এসেছিল ক্যাম্পে, পেছনের দিকে থাকত। এখন তো বল পায়ে ভালো কিছু করার নেশা পেয়ে বসেছে। টেকনিক্যালি বেশ ভালো। মহিলা দলের সঙ্গে কাজ করে যাওয়া সব বিদেশি কোচই কৃষ্ণার প্রশংসা করে গেছেন।
তবে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের মহিলা কমিটির প্রধান মাহফুজা আক্তার মজা করে বলছিলেন, ‘ওর তো কাউন্সেলিং দরকার।’ কেন? এবার তাঁর উত্তর, ‘দুই গোল করেছে ঠিক আছে। গোল নষ্ট করেছে কয়টি সেই হিসাব নিন।’ টাঙ্গাইলের মেয়ে কৃষ্ণা যেভাবে গোল নষ্ট করছে, তাকে আবার সবকিছু নতুন করে দেখানো দরকার। এটা শুনে কোচও মজা করে, ‘ওকে তো সব থেরাপিই দেওয়া হয়েছে।’
অল্প দিনেই দলে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে এগিয়ে চলেছে কৃষ্ণা। ২০১৪ পাকিস্তান সাফে প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানের সঙ্গে দুই গোল করেছে। তবে নিজে আরও গোল না পাওয়ায় অতৃপ্তি নয়, ‘আমি যত বেশি সম্ভব গোল করতে চাই। গোল নষ্ট করলে মনটা খুবই খারাপ থাকে।’
হার মানেনি তহুরা
এই টুর্নামেন্টে তহুরা খাতুন খেলেছে বদলি খেলোয়াড় হিসেবে। তবে প্রথম দুই ম্যাচে নেমেই গোল করেছে। শান্ত স্বভাবের মেয়েটি যেটুকু পায়, তাতেই খুশি। এই টুর্নামেন্টের ক্যাম্পে শুরুর পরপরই জলবসন্ত হয়েছিল তার। সঙ্গে সঙ্গে ঠিকানা হলো বাড়ি। গ্রামে গিয়ে সুস্থ হয়ে আসে। আসার পর তো স্বাস্থ্য বেশ খারাপ। আবার ফিটনেস পেতে দিনে তিন-চারটি ডিমও খাওয়ানো হলো প্রতিদিন। কোচ বলছিলেন, ‘আমি তো চাইতাম আমার ডিমটাও ওকে দেওয়া হোক।’
এই তহুরা সম্প্রতি তাজিকিস্তানে ১০ গোল করেছে। এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ ফুটবলে সে সেরা গোলদাতা হয়েছে। সামনে চায় আরও গোল। সেটাই বলছিল তহুরা, ‘আমি চাই সব সময় সেরা গোলদাতা হতে।’
উজ্জীবিতকরণ মন্ত্র
ছুটির দিনে এক ঘণ্টার জন্য ফোন ব্যবহার করতে পারে ফুটবলার মেয়েরা। বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা হলেই আবার ফোনসেট নিয়ে নেয় টিম ম্যানেজমেন্ট। ফোন হাতে পেলে গেমস খেলবে, ফেসবুকে থাকবে, যা তাদের খেলায় মনোযোগ নষ্ট করবে মনে করেন কর্মকর্তারা। তাই ফোন থেকে দূরে রাখা। তা ছাড়া দলের মধ্যে স্লোগান একটাই—কথা কম, কাজ বেশি।
এই মেয়েদের এটাই বোঝানো হয়, ‘দেশের জন্য খেলো। ভালো খেললে তুমি ভালো থাকবে। কর্মকর্তারা ভালো থাকবে।’ তাদের গড়ে তুলতে ওয়ার্কশপ, কাউন্সেলিং হয়। এসবেরই ফল, মেয়েরা মাঠে ঢেলে দেয় নিজেদের সেরাটা। এসবেরই যোগফলে সানজিদা-কৃষ্ণারা আজ সবার অহংকার।