সংগ্রামী ও জনপ্রিয় মানুষের জীবনকাহিনী
- লিডারশিপ ডেস্ক
জনপ্রিয়তা মানুষের একটি বিষেশ গুন। সমাজের সব মানুষ জনপ্রিয় হতে পারে না। বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী ডেল কার্ণেগী তার ‘’প্রতিপত্তি ও বন্ধুলাভ’’ গ্রন্থে লিখেছেন জনপ্রিয় হতে হলে মানুষের বিষেশ কিছু গুন স্বভাবগতভাবে থাকতে হয় বা অর্জন করতে হয়।
যেমন মনযোগ দিয়ে মানুষের কথা শুনা, কেবল নিজের বিষয় নিয়ে কথা না বলা, মানুষের সুখে দুঃখে পাশে থাকা, অহেতুক তর্কযুদ্ধে জড়িত না হওয়া, গঠনমূলক সমালোচনা করা ইত্যাদি। যাকে নিয়ে এই প্রবন্ধের আলোচনা সেই শিক্ষক আব্দুন নূর মাস্টার সাহেবের মাঝে উক্ত গুনাবলী অধিকাংশই আছে যে কারণে তিনি ধনী, দরিদ্র, হিন্দু-মুসলিম সকলের কাছে সমান জনপ্রিয়।
সমাজে দেখা যায় আদর্শ কৃষক হতে শুরু করে শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, রাজনীতিবীদ, ব্যবসায়ী স্ব স্ব পেশায় পারদর্শী কিন্তু অন্য বিষয়ের নিতান্ত আনকোরা। কিন্তু মনোবিজ্ঞান বলে মানবজীবনে চলার পথে প্রয়োজনীয় সকল বিষয়ে দক্ষতা থাকা প্রয়োজন।
নূর মাস্টার সাহেবের শিক্ষকতা ছাড়াও সবগুলো বিষয়ে দক্ষতা রয়েছে। একটি দৃষ্টান্ত দিলে ভাল হবে মনে করি। প্রায় ত্রিশ বছর পূর্বে দীর্ঘ দিন ঝুলে থাকা একটি জটিল মামলা, বাদী বিবাদী উভয় পক্ষের সম্মতিতে, উভয় পক্ষের উকিলের বাসায় উপস্থিত হলেন আপোশের আশায়। হাহতোস্মি!
কোথায় সালিস কোথায় আপোশ? উকিলরা আইনের ধারার মারপ্যাচ দেখিয়ে আপোশকে দূরে সরিয়ে দিলেন! উকিলের বাসায় আব্দুন নূর মাস্টার শেব উপস্থিত ছিলেন। তিনি তখন টগবগে যুবক। এর প্রায় দু মাস পর তিনি মধ্যস্থতা করে এই জটিল মামলাটি আপোষে নিস্পত্তি করে দিয়েছেলেন।
এভাবে তিনি নিজগ্রাম, পার্শ্ববর্তী গ্রাম ছাড়াও অনেক দূরে গিয়েও অনেক জটিল বিচার করেছেন, মামলা মোকদ্দমার জটিল প্যাচ থেকে মানুষকে রক্ষা করেছেন। বুদ্ধির বিচারে মানুষকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। স্থুল বুদ্ধি ও সুক্ষ্ণ বা তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ। স্থুল বুদ্ধির মানুষের সংখ্যাই সমাজে বেশি।
সুক্ষ্ণবুদ্ধির মানুষের সংখ্যা সমাজে খুব কম এবং এরাই সমাজের করিতকর্মা সদস্য। নূর মাস্টার তেমনি একজন মানুষ। তার জীবনে চলার পথে শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, ক্রীড়া, সমাজ সেবা এমনকি সংসার জীবনে সর্বত্র সুক্ষ্ণবুদ্ধির স্বাক্ষর রেখেছেন। অনুজসম নূর মাস্টারের প্রশংসা করলে পরোক্ষভাবে নিজেরই প্রশংসা করা হয়।
রুডিয়ার্ড ক্লিপিং বলেছেন,’’মানুষের প্রশংসার কিছু থাকলে তা আমরা এড়িয়ে যাই, আবার তার নিন্দার কিছু পেলে মুখে খই ফুটাই’’। পাশের গ্রামে থাকার সুবাদে সেই কিশোর বয়স হতে তার ঘনিষ্ট সানিধ্য পাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, সহকর্মী শিক্ষক হিসেবে তো বটেই।
গোপীনগর মরিচা দূটি পাশাপাশি গ্রাম। হিন্দু অধ্যুষিত মরিচা গ্রামের মানুষের সুখে দুখে তাকে পাশে পেয়েছি আমরা। শুধু মরিচা নয় আশেপাশের সকল এলাকায় মামলা ফ্যাসাদ মিমাংসায় তিনি অপরিহার্য ব্যক্তি। গোঁড়ামি মুক্ত, প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি নূর মাস্টার তাই হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সকলের অতি আপনজন। আব্দুন নূর মাস্টার শুধু একজন শিক্ষক নন একজন শিক্ষানুরাগীও বটে।
পতন ঊষার উচ্চ বিদ্যালয়ের দাতা সদস্য হয়ে স্কুলের উন্নতিতে তিনি সক্রিয় ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। পতনঊষার একটি ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রবন এলাকা। প্রতি বছর বিভিন্ন জাতীয় উৎসবে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান হয়। নূর মাস্টার সাহেব এর প্রত্যেকটিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে আসছেন স্বাধীনতা উত্তরকাল থেকেই।
আব্দুন নূর মাস্টারের জীবনে এমন অনেক ঘটনা আছে যা লিখলে প্রবন্ধ অনেক দীর্ঘায়িত হবে তাই আর একটি বিষয় উল্লেখ করে লেখা শেষ করবো যা স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্মের লোকেরা জানে না। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় এ দেশের আপামোর জনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। বলাবাহুল্য গোপীনগরবাসীও তখন বসে থাকে নি।
এ সময় গোপীনগরের আব্দুন নূর মাস্টার, উস্তার মাস্টার, ইয়াসিন আলি প্রমুখ ব্যক্তিরা প্রাণের মায়া ত্যাগ করে অতি গোপনে মরিচা গ্রামের কালিকুমার বাবুর বাড়িতে যে সকল মুক্তযোদ্ধারা দলবেধে আসতো তাদের নিজ বাড়িতে নিয়ে আসতেন, থাকা খাওয়ার আশ্রয় দিতেন এবং সুবিধামত সময়ে হাওর করাইয়া, শ্যামেরকোনা, চাটুরা ইত্যাদি এলাকায় নিয়ে যেতেন।
মৌলভীবাজার এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা যাওয়ার একটি নিরাপদ রুট ছিলো এই গোপীনগর গ্রাম। পাকিস্থানি সৈন্যদের চোখ ফাকি দিয়ে নিজেদের জীবন বাজি রেখে এই কাজটি করেছেন নূর মাস্টার ও তার দেশপ্রেমিক গ্রামের মানুষেরা। বিভিন্ন দিনে কয়েকশত মুক্তিযোদ্ধা এই রুট দিয়ে নিরাপদে যাতায়াত করতো।
যুদ্ধ মানেই হত্যা, পৈচাশিকতা, নিষ্ঠুরতা। দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েকদিন মাত্র বাকি। এই সময়ে মৌলভীবাজের পশ্চিমাঞ্চলের একজন মুক্তিযপোদ্ধা পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে বাধ্য হয়ে গোপীনগরের উস্তার মাস্টারের বাড়ির ঠিকানা বলে দেয়।
পিচাশ পাকিস্থানীরা গোপীনগর গ্রামে এসে তার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। দেশ স্বাধীনের আগেই সারা দেশের মতো গোপীনগর গ্রামের জানমালের আরো ক্ষতি হয়। মৌলভীবাজার মুক্ত হওয়ার পর রণক্লান্ত মুক্তিযোদ্ধারা মৌলভিবাজার সরকারি হাই স্কুল মাঠে বিশ্রাম করছিলেন।
আব্দুন নূর মাস্টার সাহেব তার পূর্ব পরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে মৌলভীবাজার যান। পরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কুশল বিনিময়ের পর হাইস্কুল মাঠে আসা মাত্র গগনবিদারী শব্দে সমস্ত মৌলভীবাজার শহর প্রকম্পিত হয়ে উঠে।
বিস্ফোরণের শব্দে চত্বরের ঘরগুলো এবড়োতেবড়ো হয়ে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। স্কুল ঘরের ভিতরে বাহিরে অনেক মুক্তিযোদ্ধার ছিন্ন ভিন্ন দেহ ছড়িয়ে পড়ে। ভাগ্যক্রমে নূর মাস্টার সাহেব প্রাণে বেচে গেলেও মারাত্মক আহত হন। মুক্তিযুদ্ধের ক্ষত চিহ্ন সাক্ষী হয়ে রইলো তার শরীরের স্থানে স্থানে।
মনিষী এডমন্ড বার্ক বলেছেন,’’ মানুষের জীবন সংগ্রামের সমষ্টি বৈ কিছু নয়। সংগ্রামে যারা জয়ী হয় তারাই পরিপূর্ণ মানুষ।‘’আব্দুন নূর মাস্টার সাহেবের বেলায় এডমন্ড বার্কের উক্ত উক্তিটি সর্বাংশেই সত্য।