সাক্ষাৎকার : অ্যানিমেশন কঠিন কিছু নয়

সাক্ষাৎকার : অ্যানিমেশন কঠিন কিছু নয়

  • লিডারশিপ ডেস্ক

বাংলাদেশী তরুণ অ্যানিমেটর নাফিস বিন জাফর।দু দুবার অস্কার পুরষ্কার অর্জন করেছেন। ১৯৭৮ সালের ৮ অক্টোবর ঢাকায় জন্মগ্রহণকারী নাফিস বর্তমানে চীনের সাংহাইতে ওরিয়েন্টাল ড্রিম ওয়ার্কসে অ্যানিমেশন বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করছেন। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান নাফিস।

ঢাকার মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে স্ট্যান্ডার্ড সিক্স লেবেল পড়াশোনা করে সপরিবারে ১৯৮৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেন নাফিস। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ অব চার্লসটন থেকে সফটওয়্যার প্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। বাবা জাফর বিন বাশার বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে একটি অ্যাকাউন্টিং ফার্মে চাকরি করছেন। আর মা নাফিসা জাফর গৃহিণী। তাদের গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ী জেলার কাজীকান্দা। জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি প্রয়াত সৈয়দ মইনুল হোসেন নাফিসের মামা এবং বরেণ্য চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার তার নানা।


: আপনার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে যদি একটু বলেন?

নাফিস : আমি ১৯৭৮ সালের ৮ অক্টোবর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করি। বাবা-মার একমাত্র সন্তান। বাবা জাফর বিন বাশার বর্তমানে নিউইয়র্কে একটি অ্যাকাউন্টিং ফার্মে কর্মরত। আর মা নাফিসা জাফর গৃহিণী। আমার দাদাবাড়ি রাজবাড়ী জেলার কাজীকান্দা। নানাবাড়ি বিক্রমপুরের টঙ্গিবাড়ী থানার রামপারা। বাবার সেনাবাহিনীতে চাকরি করার সুবাদে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় বেড়ে উঠেছি। মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে স্ট্যান্ডার্ড সিক্সে পড়াশোনা অবস্থায় বাবার এমবিএ পড়ার সুবাদে পরিবারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ক্যারোলিনার চার্লসটনে চলে যাই। সেখানে কলেজ অব চার্লসটন থেকে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করি।

: অস্কার জয়ের গল্পটা কেমন?

নাফিস : ২০০৭ সালে ‘পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান : অ্যাট ওয়ার্ল্ডস এন্ড’ সিনেমার জন্য সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে আমরা তিন সহকর্মী অস্কার জিতি। ২০০৮ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পুরস্কার আমাদের হাতে তুলে দেয়া হয়। তখন কাজ করতাম ভিজ্যুয়াল ইফেক্টস প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল ডোমেইনে। সহকর্মী ডাগ রোবেল ও রিয়ো সাকাগুচিওসহ আমরা তিনজন যৌথভাবে এই পুরস্কার পাই। মূলত সিনেমাটিতে ডিজিটাল ফ্লুইড ইফেক্টস সিম্যুলেশনে কাজ করেছেন তারা। সহজে বোঝানোর জন্য বললেন, আপনারা যদি সিনেমাটা দেখেন, সেখানে দেখবেন অনেক পানির খেলা। সমুদ্রের পানি অনেক ওপরে উঠছে, আবার নিচে আছড়ে পড়ছে। পানির এই খেলা বাস্তবসম্মতভাবে উপস্থাপন করা কঠিন। অ্যানিমেশনের কাজ করার সময় প্রথমেই যেটি মাথায় রাখতে হয় সেটি হলো দৃশ্যকে জীবন্ত করে তোলা। দর্শকদের চোখে যেন মনে হয়, দৃশ্যটি বানানো নয়, স্বাভাবিক। সিনেমাটির জনপ্রিয়তা এবং অস্কারপ্রাপ্তির পর বুঝতে পারি আমরা সফল ছিলাম।

Giasliton007-1440942294-3a3872b_xlarge: অ্যানিমেশন বলতে পাঠক কি বুঝবে?

নাফিস : অ্যানিমেশন হচ্ছে শিল্পের একটি ডিজিটাল মাধ্যম। রঙ-তুলির বদলে এখানে শিল্পী কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে তার দক্ষতা ফুটিয়ে তোলেন। প্রযুক্তিটি চিত্র পরিচালকদের ঝুঁকি, সময় ও কল্পিত দৃশ্যকে বিশ্বাসযোগ্য করে প্রদর্শনের দারুণ সুবিধা দেয়। তাই হলিউড এখন অনেকটাই ঝুঁকে পড়েছে ফ্লুইড অ্যানিমেশনের দিকে। সমুদ্রে না গিয়েই তারা দর্শককে দেখাতে পারছেন সমুদ্রের উথাল-পাথাল ঢেউ, কয়শ’ ফুট ওপরে উঠে পানি আছড়ে পড়ার সশব্দ দৃশ্য। অ্যানিমেশনের কাজ করার সময় প্রথমেই মাথায় রাখতে হয় কতটা সার্থকভাবে দৃশ্যটিকে জীবন্ত করে তোলা যায়। ভালো প্রোগ্রামার যে কেউ হতে পারে, কিন্তু ভালো এনিমেটর হতে হলে শিল্পমন থাকাটা সমানভাবে জরুরি। এখানে প্রোগ্রামার তার কল্পনাকে ভিজ্যুয়ালাইজ করবেন।

: বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ফিল্ম ও মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ চালু হচ্ছে, তাদের সঙ্গে কাজ করার কোন পরিকল্পনা আছে?

নাফিস : যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমি অতিথি শিক্ষক হিসেবে ক্লাস নিই। বাংলাদেশে এ ধরনের কাজে যুক্ত হতে পারলে আমি খুব সম্মানিত বোধ করব। দেশের নতুন প্রজন্ম যদি এনিমেশন বা স্পেশাল ইফেক্ট নিয়ে কাজ করে, আর তাতে যদি আমার কোন সম্পৃক্ততা থাকে, তা হবে আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া।

: বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কি?

নাফিস : সত্যি কথা বলতে কি, আমার বাংলাদেশি সিনেমা দেখা হয় না। শুনেছি বাংলাদেশে ডিজিটাল ফিল্ম শুরু হয়েছে। এটি অবশ্যই ভালো। উন্নত বিশ্ব কি করছে সেটি লক্ষ্য করে এগোলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র এগিয়ে যাবে। পরবর্তী কয়েক জেনারেশন মনে রাখবে এমন সিনেমা তৈরি করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বিশ্বের অনেক ভালো সিনেমা রয়েছে যেগুলো অর্ধশতক বছর আগের। এগুলো এখনও অনেকেই দেখে।

: সফটওয়্যার প্রকৌশলী হয়েও চলচ্চিত্রের সঙ্গে কাজ করছেন?

নাফিস : মূলত আমি চলচ্চিত্রের প্রযুক্তিগত অংশের সঙ্গে কাজ করছি। তাছাড়া আমার পরিবারের অনেকেই শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত। আমার নানা বরেণ্য চিত্রশিল্পী মুস্তফা মনোয়ার। তার কাছ থেকে অনেক অনুপ্রেরণা পেয়েছি। ছোটবেলা থেকেই ক্রিয়েটিভ কিছু করতে মন চাইত। আমি যখন গ্রাজ্যুয়েশন শেষ করি তখন ছিল ‘ডটকম’ এর শ্রেষ্ঠ সময়। ক্রিয়েটিভ দিকটা ফুটিয়ে তোলার সুযোগ পাওয়ায় যোগ দিলাম চলচ্চিত্র শিল্পে। এখন মনে করি সেটি ভালো সিদ্ধান্ত ছিল।

: অ্যানিমেশনে ভালো করতে হলে কিভাবে শুরু করা উচিত?

নাফিস : আসলে যাই করতে চান না কেন- সেজন্য আপনাকে সময় দিতে হবে। আগে বিষয়টি নির্বাচন করুন। তারপর ওই বিষয়ের বেসিক থেকে শুরু করতে হবে। আর অ্যানিমেশন ও স্পেশাল ইফেক্ট একটি ক্রিয়েটিভ কাজ। এক্ষেত্রে সফলতা আসতে অনেক সময় লাগে। আমি মনে করি, একজন অ্যানিমেটর হতে হলে কমপক্ষে ১০ হাজার ঘণ্টা কাজ করতে হবে। তারপরেও বিভিন্ন সফটওয়্যার, প্রযুক্তির সঙ্গে আপডেটেড থাকতে হবে।

আর চর্চার কোন বিকল্প নেই। প্রচুর প্রজেক্ট করতে হবে। লেগে থাকলে সফলতা আসবেই। সৃষ্টির মধ্যে যারা আনন্দ খুঁজে পান, তাদের জন্য এটা খুব কঠিন কিছু নয়। আকর্ষণ না থাকলে চেষ্টা করে লাভ নেই। আর আকর্ষণ থাকলে শুরু করতে হবে দেরি না করে।

: অস্কার জয়ের জীবনে কি পরিবর্তন এসেছে?

নাফিস : কাজটা তো কখনও পুরস্কার পাওয়ার জন্য করিনি। তবে যখন পুরস্কারটা পেয়েছি, আমার বাবা-মা, আমার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই খুবই খুশি হয়েছেন। তাদের জন্যই আমার কাছে পরে মনে হয়েছে না, আমি বোধ হয় বড় কিছুই অর্জন করতে পেরেছি।

অ্যাওয়ার্ডের পর জীবনে তেমনভাবে কোন পরিবর্তন আসেনি। তবে হলিউডে ভিজ্যুয়াল ইফেক্টসে আমার একটা জায়গা তৈরি হয়েছে। নিজের প্রতি আস্থা ছিল, পুরস্কার জয়ের পর সেটা আরও দৃঢ় হয়েছে। কাজে উৎসাহ বেড়েছে। পরিসরও বেড়েছে।

: এ পর্যন্ত কতগুলো সিনেমায় অ্যানিমেশনের কাজ করেছেন?

নাফিস : এগুলো তো আমরা এককভাবে করি না, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হয়ে থাকে। তবে শতাধিক সিনেমা তো হবেই। আমার ক্রেডিট রয়েছে এর মধ্যে কুংফু পান্ডা ২, ২০১২, পার্সি জ্যাকসন অ্যান্ড অলিম্পিয়ান্স : দ্য লাইটিং থিফ, দ্য সিকার : দ্য ডার্ক ইজ রাইজিং, শ্রেক ফর এভার আফটার, স্টিলথ, মেগামাইন্ড প্রভৃতি মুভির নাম বলা যেতে পারে।

এর মধ্যে চলতি বছর মুক্তি পেয়েছে টার্বো এবং দ্য ক্রুডস। আগামী বছর আসছে মিস্টার পিবাডি অ্যান্ড শার্ম্যান। আগামী গ্রীষ্মে বস্নকবাস্টার মুভি হাউ টু ট্রেইন ইয়োর ড্রাগনের সিক্যুয়াল মুক্তি পাচ্ছে।

সূত্র: দৈনিক সংবাদfavicon59

Sharing is caring!

Leave a Comment