ভালো আছেন ফল ব্যবসায়ী মোশারফ
- এস এম রাসেল
বরিশাল থেকে ঢাকার দূরত্ব কত তা জানেন না পঞ্চন্ন বছর বয়সী মোশারফ সরদার। শুধু জানেন, জীবনের পথটা অনেক দীর্ঘ। সেই দীর্ঘ পথকে মসৃণ করতে একদিন ঢাকার পথেই পা বাড়িয়েছিলেন তিনি। সেটা ১৯৮০ সালের কথা। এখন ২০১৬। এই দীর্ঘ সময়ে স্থায়ীভাবে আর কখনোই ফেরা হয়নি বরিশালের উজিরপুর থানার উত্রাসপুর গ্রামে। এই গ্রামেই শৈশব-কৈশোর ও বেড়ে ওঠা মোশারফ সরদারের।
‘মাঝে মাঝে কি খুব ইচ্ছে করে বরিশালে ফিরে যেতে?’
মোশারফ সরদার হাসেন। বলেন, ‘না, এই শহরেরই ভালো আছি। ব্যবসা-বাণিজ্য করতেছি।’
এবার মোশারফের ব্যবসায় চোখ যায় এই প্রতিবেদকের।
শুক্রাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে যে রাস্তা চলে গেছে কাঁচা বাজারের দিকে সেই রাস্তার মোড়ে একঝুড়ি ফল নিয়ে বসে আছেন মধ্যবয়সী মোশারফ। পেপে, কলা, পেয়ারা, জাম্বুরা… এই তো। এটাই মোশারফের ব্যবসা।
তাঁকে জিজ্ঞেস করি, ‘চাচা, আপনার ব্যবসা কি সফল।’
তিনি উত্তর দেন, ‘হ্যাঁ, বাবা। সফল।’
‘মাসে আয় রোজগার কেমন হয়?’
‘তা সব বাদছাদ দিয়ে হাজার পনের থাকে।’
প্রতিবেদকের কৌতুহল বেড়ে যায়। শুনতে চাই তাঁর সফলতার গল্প।
মোশারফ ঘোলাটে চোখ তুলে তাকান। কাঁচাপাকা দাড়িতে হাত বুলান। হয়তো স্মৃতি হাতড়ান। ব্যবসার বয়স তো কম হলো না। কোথা থেকে শুরু করবেন গল্প, বুঝে উঠতে পারেন না।
তাঁকে গল্পের সূত্র ধরিয়ে দিই, ‘প্রথম ব্যবসা কি দিয়ে শুরু করেছিলেন?’
সেটা তো বাজান, কাঁচামালের ব্যবসা। সেই বরিশালে থাকতে শুরু করছিলাম। এটুকু বলার পর বরিশালের গল্প শুরু করেন মোশারফ সরদার। কঠিন দারিদ্র্যের মধ্যে শৈশব কেটেছে তার। পরিবারে সুখ আনতে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন রাজমিস্ত্রি হিসেবে। যা উপার্জন করতেন তা দিয়ে সংসার চলানো কঠিন হয়ে পড়ত। চার ছেলে-মেয়ের সংসারে এই অল্প আয়ে কোনোভাবেই সংসার চলতো না। তাই একদিন বরিশালের মায়া ত্যাগ করে চলে আসানে ঢাকার কোলাহলে।
মোশারফ আবার বলেন, ‘সেটা ১৯৮০ সাল বাবা। কোনোমতে গাড়ি ভাড়ার টাকা জোগাড় করে ঢাকার পথে পা বাড়াই।’ কাঁচা আমের ব্যবসা দিয়ে শুরু করেন ঢাকার বুকে ব্যবসার পথযাত্রা। বছর পাঁচেক এই ব্যবসা করার পর সবজির ব্যবসায় নামেন। বেশ লাভবান হচ্ছিলেন এই ব্যবসায়। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলার কৌশল শিখে ফেলেন মোশারফ। বাজারের চাহিদা বুঝে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যবসা করেন। তাইতো ২০০০ সালে ধানমন্ডির শুরক্রাবাদে শুরু করেন ফলের ব্যবসা। আম, লিচু, পেয়রা, জাম্ভুরা ও পেঁপে এই গুলাই দিয়ে শুরু করেন তাঁর এই নতুন ব্যবসা। এখনো পর্যন্ত এই ব্যবসাই করছেন।
রাজধানীর শুক্রাবাদে রাস্তার পাশে জুড়ি নিয়ে বসেন প্রতিদিন। সাত সকালে তাজা ফলের ঘ্রাণে সুগন্ধি হয়ে যায় চারপাশ। দীর্ঘ ১৫ বছর যাবত একই জায়গায় একই ব্যবসা করায় তাঁর মুখখানা সবার কাছে পরিচিত। সারা দিন ফল বিক্রি করে সন্ধ্যায় মুখভরা হাসি নিয়ে বাড়ি ফেরেন। বাড়ি বলতে মেস বাসা। রায়ের বাজারের বউবাজারে ব্যাচেলর মেসে থাকেন। মাস শেষে এক হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। এখনো বরিশালেই তাঁর সংসার। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন ও মেজো ছেলে বিদেশে আছেন। আর দুই ছেলে-মেয়ে পড়াশুনা করছেন।
তাহলে তো আপনি সুখি মানুষ! জানতে চাই মোশারফ সরদারের কাছে।
তিনি হাসতে হাসতে বলেন, ‘আমার এই পরিবারের সুখ এক-দুই দিনের না। দীর্ঘ ৩০ বছরের কষ্টের সফলতা আজ। এমনও দিন গিয়েছে আমার অসুখের সময় পাশে কেউ ছিল না। জ্বর নিয়ে মাথায় ফলের জুড়ি নিয়ে ফল বিক্রি করেছি। এখনোও তাই করছি। বাকি জীবনটা এভাবেই কাঁটিয়ে দিতে চাই। আল্লাহ্র রহমতে আমার পরিবারকে নিয়ে অনেক ভালো আছি।’