গবেষক মামুনের অনন্য কীর্তি
- লিডারশিপ ডেস্ক
বাংলাভাষী যে মানুষদের কথা বলার ক্ষমতা নেই, তাঁদের ‘মুখে’ কথা ফোটাতে চেয়েছেন তিনি। নড়াচড়ার ক্ষমতা যাঁদের নেই, তাঁরাও যেন লিখতে পারেন, এমনটাই চান। শুধু চাওয়াতেই সীমাবদ্ধ না থেকে তরুণ গবেষক এস এম আবদুল্লাহ আল মামুন তা করে দেখিয়েছেন। দিয়েছেন প্রযুক্তিগত সমাধান। তাঁর সেই উদ্ভাবন সম্পর্কে জানার আগে ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং সম্পর্কে জানাটা জরুরি। কিংবদন্তি এই বিজ্ঞানীই আবদুল্লাহ আল মামুনের প্রথম অনুপ্রেরণা।
মোটর নিউরোন রোগে আক্রান্ত হয়ে ২১ বছর বয়সে শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করেন ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং। তবে তাঁর মস্তিষ্ক সচল ছিল, আর তা সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশিই। অদম্য সে মেধার জোরেই মহাবিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তবে নড়াচড়া কিংবা কথার বলা ক্ষমতা হারিয়ে ফেলায় গবেষণালব্ধ সেই জ্ঞান সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল না। এগিয়ে আসে মাইক্রোপ্রসেসর নির্মাতা মার্কিন প্রতিষ্ঠান ইনটেল করপোরেশন। প্রযুক্তির সাহায্যে হকিংয়ের ভাবনা সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। কম্পিউটারের মাধ্যমে হকিংয়ের ভাবনা রোমান হরফে লিখিত বা কথার আকারে প্রকাশিত হয়।
স্টিফেন হকিংয়ের মতো বিশেষ ব্যক্তির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা হয়েছে। সাধারণ মানুষের সাধ্যে তা নেই। ইংরেজি, চীনা বা আরও কয়েকটি ভাষায় সে ব্যবস্থা থাকলেও বাংলায় এ নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা এর আগে কেউ করেননি। আর ঠিক এই ভাবনাই আসে এস এম আবদুল্লাহ আল মামুনের মাথায়। তুরস্কের ইস্তাম্বুল টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে স্নাতক করার সময় তাঁর শিক্ষক জাফর ইশ্চানের তত্ত্বাবধানে বাংলা ভাষার জন্য তৈরি করেন ব্রেইন কম্পিউটার ইন্টারফেস (বিসিআই)। নড়াচড়ার কিংবা কথা বলার শক্তি যাঁদের নেই, তাঁরাও মামুনের এই বাংলা ব্রেইন কম্পিউটার ইন্টারফেস ব্যবহার করে কথা বলতে বা লিখতে পারবেন। কাজটা কীভাবে হয়, তা-ই ব্যাখ্যা করছিলেন মামুন। কিছুদিন আগে দেশে এসেছিলেন তিনি। ১ অক্টোবর ঢাকায় কথা হয় তাঁর সঙ্গে।
মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ থেকে লকড-ইন সিনড্রোমের সঙ্গে অনেকেই পরিচিত। দুর্ঘটনা বা রোগাক্রান্ত হয়ে অনেকেই কথা বলা কিংবা লেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। ‘এই মানুষেরা যেন তাঁদের মনে জমে থাকা কথাগুলো চিন্তার মাধ্যমে কম্পিউটারে লিখতে পারেন, সে জন্য এই প্রচেষ্টা। এটিই ব্রেইন কম্পিউটার ইন্টারফেস। মানুষের মস্তিষ্কের সঙ্গে কম্পিউটারের যোগাযোগের একটা প্রযুক্তি’—বললেন মামুন।
আমরা যা কিছু করি, তার সবকিছুরই পরিকল্পনা হয় আমাদের মস্তিষ্কে, সেটা হাত নাড়ানো হোক কিংবা কথা বলা। প্রতিটা কাজের জন্য মস্তিষ্কে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ তৈরি হয়। এই তরঙ্গ ধরতে পারলেই কোনো কাজ করার আগেই আমরা জানতে পারব, কী করতে চাচ্ছেন তিনি।
আবদুল্লাহ আল মামুন যখন এই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ শুরু করেন, তখন জাফর ইশ্চান তাঁকে বলেছিলেন, কাজটা বাংলায় করা সম্ভব কি না। সেদিন থেকেই মামুনের চেষ্টা শুরু। ভাবলেন, অন্য ভাষায় লেখা গেলে বাংলাতেও লেখা সম্ভব। মামুন বলেন, ‘দুঃখজনক হলেও সত্য যে এই বিষয়ে গবেষণার জন্য তেমন কোনো উৎস নেই বললেই চলে। বাংলা কিংবা দক্ষিণ এশিয়ার ভাষাগুলো নিয়ে তেমন কোনো কিছুই হয়নি।’
মামুনের বিজ্ঞানের প্রতি ভালো লাগার শুরু স্টিফেন হকিংয়ের লেখা আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম পড়ে। বর্তমান সময়ের কিংবদন্তি বিজ্ঞানী কীভাবে তাঁর সব যোগাযোগ করেন প্রযুক্তির মাধ্যমে, তা জানতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। মামুন বলেন, ‘যতই পড়তে থাকলাম আর ততই ছোট ছোট জিনিসগুলো আমাকে ভাবিয়ে তুলল। রোমান অক্ষরে লেখার পদ্ধতি আর প্রয়োগ নিয়ে অনেক গবেষক কাজ করেছেন। বেশ কিছু কাজও খুঁজে পেলাম কোরীয় ও চীনা ভাষার ওপরে। বিসিআইয়ের মূলে যে পদ্ধতি রয়েছে, তা দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার যেকোনো ভাষা লেখা বেশ কষ্টসাধ্য এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসম্ভব মনে হচ্ছিল। এর কারণ, অক্ষরের সংখ্যা অনেক বেশি এবং যুক্তাক্ষরের ব্যবহার।’
ইস্তাম্বুলে গবেষণা
এক বছর চার মাসের চেষ্টার পর একটা ইন্টারফেস দাঁড় করিয়েছিলেন মামুন। কম্পিউটার পর্দায় যা দিয়ে বাংলা লেখা সম্ভব। এর আগে এই প্রযুক্তি ব্যয়বহুল আর ব্যবহারে জটিলতার কারণে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালের বাইরে ছিল। মামুন বলেন, ‘কীভাবে বাংলাদেশের মানুষ এই সুবিধা পেতে পারে সেটাই আমার উদ্দেশ্য।’
পুরো কাজটা ইস্তাম্বুলে বসে শেষ করেন মামুন। মামুনের শুরুর দিকে লেখা গবেষণাপত্রগুলোর কয়েকটি রিসার্চগেট ডটনেটে তাঁর প্রোফাইেল পাওয়া যাবে। রিসার্চগেটে জানা যায়, কে কে গবেষণাপত্রগুলো পড়ছেন বা ব্যবহার করছেন। মামুন বলেন, ‘প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেক গবেষককে সাহায্য করতে পেরেছি। অনেকে আমার কাছে ই–মেইল করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস মেশিনসের (আইবিএম) মূল শাখা এবং পরে আইবিএম ইন্ডিয়া।’
বাংলার জন্য চেষ্টা
এস এম মামুনের মূল সাফল্য ছিল কম ধাপে ৬৮টি অক্ষরের বেশি লেখা সম্ভব—অ্যালগরিদম দিয়ে এমন একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম লেখা। কেননা সবচেয়ে ভালো ইন্টারফেসগুলো দিয়েও তখন ৬৮টি অক্ষরের বেশি লেখা সম্ভব ছিল না। মামুন এই সংখ্যাকে দ্বিগুণ করে ফেলেছেন। তিনি বলেন, ‘আমার প্রকাশিত গবেষণাপত্রের পদ্ধতিতে এখন মিনিটে সাতটি বাংলা অক্ষর লেখা সম্ভব। এটা খুব কম মনে হলেও পক্ষাঘাতগ্রস্ত কোনো মানুষের বেলায় বেশ ভালো।’
মামুনের গবেষণাপত্রটি ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে একই সঙ্গে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ থেকে প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন এমার্জিং অব নেটওয়ার্কিং, কমিউনিকেশন অ্যান্ড কম্পিউটিং টেকনোলজিস এবং ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন ইমার্জিং ট্রেন্ডস অব কম্পিউটার সায়েন্স উইথ এডুকেশনাল টেকনোলজি নামের দুটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়। এরপর একই বছর বাংলাদেশের নয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর কাজের ওপর সেমিনার করার সুযোগ পান। আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (এআইইউবি) থেকে তিন ছাত্র তাঁদের স্নাতক পর্যায়ের থিসিস করেন এস এম আবদুল্লাহ আল মামুনের গবেষণার বিষয়ের ওপর।
কেন গুরুত্বপূর্ণ
মামুনের এই প্রযুক্তির গুরুত্ব কেন বেশি, তা বোঝার চেষ্টা করা যাক। আমাদের মস্তিষ্ক যখন কোনো কিছু নিয়ে ভাবে, তখন সেটা একটা নকশা বা প্যাটার্ন তৈরি করে। ব্রেইন কম্পিউটার ইন্টারফেসে এই নকশাকে নির্দেশ হিসেবে ধরা হয়। যদি কেউ ডান আর বাম দিকে চলার চিন্তা করে, তাতেও লেফট ও রাইট হেমিস্ফিয়ারে একটা নকশা তৈরি করে, আর সেটা শিখে কম্পিউটার ব্যবহারকারীকে ফলাফল (আউটপুট) দেয়। এর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন বিষয় নকশার শ্রেণিভেদ করা। কারণ, সঠিকভাবে আলাদা করতে না পারলে আউটপুট ঠিক আসবে না। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে তৈরি করা প্রযুক্তিতে সম্পূর্ণ পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষ তার মস্তিষ্কের ভাবনা কাজে লাগিয়ে লিখে ভাব প্রকাশ করতে পারেন, ই-মেইল ও ফেসবুক ব্যবহার করতে পারবেন। আধুনিক গবেষণায় এখন গাড়ি চালানো, হুইলচেয়ার নিয়ন্ত্রণ, ছবি আঁকা, গেম খেলা, সুর করা এবং বিমান নিয়ন্ত্রণও করা সম্ভব হচ্ছে। তবে বেশির ভাগ প্রযুক্তিই এখনো ল্যাবে সীমাবদ্ধ। এর মূলে একই পদ্ধতি কাজ করছে, তবে ফলাফলগুলো আলাদা।
মামুন বললেন, বিজ্ঞান কল্পকাহিনির মতোই একসময় এই প্রযুক্তি আমাদের সামনে নিয়ে আসবে চোখধাঁধানো সব জিনিস। বলা হয়, এই সৌরজগতে সবচেয়ে জটিল বস্তু আমাদের মস্তিষ্ক। কারণ, এখানেই সব চিন্তার উৎস। আমাদের জগৎ আর অর্থবহ চিন্তার সব একসময় কম্পিউটারে যুক্ত হবে।
কীভাবে কাজ করে এই প্রযুক্তি
এস এম আবদুল্লাহ আল মামুনের এই প্রযুক্তি ব্রেইন-মেশিন ইন্টারফেস নামেও পরিচিত। এই পদ্ধতিতে কি-বোর্ডের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য গবেষকেরা বেশ চেষ্টা করছেন। তবে সব কাজ মূলত মুখের নড়াচড়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কোনো পদ্ধতিতেই গলা বা গলার নিচের কোনো অঙ্গ নিয়ে কাজ করা হয়নি। মস্তিষ্কের সংকেতকে বলা হয় ইইজি। এর পাশাপাশি অন্যান্য পেশির সংকেত (ইএমজি) নিয়ে কাজ শুরু করেন আবদুল্লাহ। কারণ হিসেবে মামুন বলেন, ‘শুধু মস্তিষ্কের সংকেত বিশ্লেষণ করে সঠিক ফল পাওয়া কঠিন। তাই অনেক গবেষক ইএমজি ব্যবহার করেন। স্টিফেন হকিংয়ের ক্ষেত্রে যেমন গালের পেশির নড়াচড়া থেকে সংকেত নেওয়া হয়।’
মামুনের গবেষণার ফল পেতে ইমোটিভ নামে একটি যন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। বাজারে এটি ব্রেইন-সেন্সরভিত্তিক শিরস্ত্রাণ (হেডসেট) হিসেবে জনপ্রিয়। ইমোটিভের ১৪টি সেন্সর মস্তিষ্ক এবং মুখের পেশির নড়াচড়া শনাক্ত করতে পারে। চোখের পাতার কম্পন, ঠোঁটের নড়াচড়া এবং শুধু চিন্তাশক্তি বা মস্তিষ্কের সংকেত—এই তিনটি উপায়ে পরীক্ষা চালান মামুন। সেরা ফল পান চোখের পাতার কম্পন থেকে। হাসি বা ঠোঁটের নড়াচড়ার মাধ্যমেও মামুনের সফটওয়্যার দিয়ে লেখা সম্ভব। এতেও মোটামুটি নির্ভুলভাবেই বাংলা লেখা যায়। শুধু চিন্তাশক্তি ব্যবহার করেও লেখার চেষ্টা করা যায়। তবে সে ক্ষেত্রে ব্যবহারকারীকেও যন্ত্রের সঙ্গে পরিচিত হতে হয়, চর্চারও প্রয়োজন আছে। তবু এতে প্রচুর ভুল হয়।
পুরো প্রযুক্তির দুটি অংশ—যন্ত্র ও সফটওয়্যার। মামুনের গবেষণায় ইমোটিভ ব্যবহার করা হয়েছে। এটা তারহীন ব্লুটুথের মাধ্যমে কম্পিউটারে তথ্য (ডেটা) পাঠায়। দ্বিতীয় অংশ সফটওয়্যার। মামুন বলেন, ‘আমি উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমের জন্য সফটওয়্যার বানিয়েছি।’
মামুনের ইন্টারফেসে অক্ষরগুলো সারি ও কলামে থরে থরে সাজানো থাকে। বাঁ থেকে ডানে এবং ওপর থেকে নিচের দিকে একের পর এক যেতে থাকে কারসর। যে অক্ষরটি লেখা হবে, ঠিক সেখানে মুখের পেশির সামান্য নড়াচড়ার মাধ্যমে লেখার অক্ষর ঠিক করে দেওয়া যাবে। তবে অন্যান্য অঙ্গের নড়াচড়া বা শুধু চিন্তাশক্তির মাধ্যমেও অক্ষর ঠিক করে দেওয়া যায়।
এভাবে একের পর এক অক্ষর ঠিক করে দিয়ে শব্দ এবং শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে বাক্য তৈরি করা সম্ভব। কাজটি বেশ কষ্টসাধ্য। আবদুল্লাহ আল মামুনের ইচ্ছা, দু-একটি অক্ষর লেখা হলেই যেন পুরো শব্দ অনুমান করে তা লেখা হয় সে ব্যবস্থা করা। এতে লিখতে কষ্ট কম হবে, সময়ও কম লাগবে। আর তিনি এ-ও চান, কম খরচে এই প্রযুক্তির যন্ত্র তৈরি হোক, যাতে সাধারণ মানুষ এটা ব্যবহার করতে পারে।
চলমান গবেষণা
খুলনার শেখ আশরাফ উদ্দিন ও আবেদা খাতুন দম্পতির তিন মেয়ে, এক ছেলের মধ্যে আবদুল্লাহ আল মামুন সবার ছোট। রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ থেকে ২০০৭ সালে এইচএসসি পাস করেন। ২০০৮ সালের অক্টোবরে ওআইসির বৃত্তি নিয়ে চলে যান তুরস্কে। ইস্তাম্বুল টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে তড়িৎ কৌশল ও ইলেকট্রনিকস বিষয়ে স্নাতক করেন। বর্তমানে তিনি টিটিজি ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানে গবেষণা প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করছেন। এখন তিনি তুরস্কের একটি হাসপাতালের জন্য মানবদেহের তাপমাত্রার ম্যাপিং নিয়ে গবেষণা করছেন। এ গবেষণা সফল হলে এটি স্তন ক্যানসার চিকিৎসায় কাজে লাগবে। পাশাপাশি বাংলা বিসিআইয়ের আরও উন্নয়নে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।