সফল চা ব্যবসায়ী সিরাজুল চৌধুরী

সফল চা ব্যবসায়ী সিরাজুল চৌধুরী

  • লিডারশিপ ডেস্ক 

নিজের কর্মদক্ষতা এবং পরিশ্রমের মাধ্যমে ভাগ্য পরিবর্তন করা শ্রীমঙ্গলের চা-পাতা দোকানি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বর্তমানে ৪টি বিশাল চা বাগানের মালিক। দেশের বিশিষ্ট এই চা-কর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর চা শিল্পের উন্নয়ন কৌশল ও এ শিল্পের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বিষয়ে ভোরের কাগজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে উঠে আসে তার সংগ্রামের জীবন কাহিনী। উঠে আসে এ শিল্পের বিকাশ ও দেশে রুগ্ণ চা বাগানের দুর্নাম মুছে দেয়ার বাস্তবমুখী কিছু পদক্ষেপের চিত্র। একই সঙ্গে বর্তমানে যারা চায়ের সঙ্গে জড়িত এবং ভবিষ্যতে যারা এ শিল্পে জড়িত হবেন তাদের জন্যও রয়েছে তার সফলতার অভিজ্ঞতা ও পরামর্শ।

পরিবারের বড় ছেলে হওয়ার সুবাদে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ওপর নিয়মতান্ত্রিকভাবেই বিশাল দায়িত্ব বর্তায়। পরিবারের হাল ধরতে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তার ভাইদের নিয়ে ১৯৭৭ সালে শ্রীমঙ্গল নতুন বাজারে সবুজ চা-ঘর নামে একটি ছোট চা পাতার দোকান খুলেন। ব্যবসা মোটামুটি ভালো চলায় খুচরার পাশাপাশি কিছু কিছু পাইকারি দোকানেও চা পাতা বিক্রি করতে থাকেন। সে সময় প্রয়োজন পড়ে অকশনার হিসেবে নিবন্ধিত হওয়ার। তার ছোট ভাই মরহুম নজমুল ইসলাম চৌধুরীর উৎসাহে ১৯৭৯ সালে তার প্রতিষ্ঠানটি সবুজ টি প্রাইভেট লিমিটেড নামে চায়ের অকশনার নিবন্ধিত হন।

স্থানীয় চা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চা ক্রয় না করে এবার তিনি এই লাইসেন্স দিয়ে চট্টগ্রাম অকশন হাউস থেকে চা ক্রয় করা শুরু করেন। আস্তে আস্তে তার চায়ের ব্যবসার পরিধি বাড়তে থাকে। সে সময় তার ছোট ভাই প্রয়াত নজমুল ইসলাম চৌধুরী উঠেপড়ে লাগেন চা এক্সপোর্ট করার জন্য। কিন্তু এক্সপোর্ট লাইসেন্স ছাড়া চা রপ্তানি করার কোনো সুযোগ ছিল না। তাই সিদ্ধান্ত নেন এক্সপোর্টের লাইসেন্স করবেন বলে। আর বরাবরই এ বিষয়ে তার উদ্যোগী ভাই প্রয়াত নজমুল ইসলাম চৌধুরী দায়িত্ব নিয়ে কাজ শুরু করেন। ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যভাগে তিনি এক্সপোর্টের চূড়ান্ত কাগজপত্র নিয়ে ঢাকায় যান। ২০ ফেব্রুয়ারি সবুজ টি প্রাইভেট লিমিটেড নামে চায়ের এক্সপোর্ট লাইসেন্স পেয়ে এটি নিয়ে শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু দুর্ভাগ্য ওইদিনই ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা বাস নারায়ণগঞ্জ লাঙ্গলবন্দের কাছে বিশাল দুর্ঘটনায় পড়ে তিনিসহ বাসের প্রায় সবাই মারা যান। খবর পেয়ে সিরাজুল ইসলাম সেখান থেকে ভাইয়ের মৃতদেহ উদ্ধার করেন এবং সঙ্গে পান বিদেশে রপ্তানির জন্য এক্সপোর্ট লাইসেন্স। এরপর বেশ কিছুদিন তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকেন। একসময় ওই বছরের শেষ দিকে তৎকালীন চা বোর্ডের এক সিনিয়র অফিসার ওহিদুজ্জামানের সহযোগিতায় সুযোগ পান বিদেশে চা রপ্তানির। তিনি প্রথম চা রপ্তানি করেন পাকিস্তানে। পরে একে একে বিভিন্ন দেশে চা রপ্তানি করেন।

ব্যবসার পরিসর বাড়ায় তাকে সহায়তা করতে থাকেন তার ছোট ভাই আমিনুল ইসলাম চৌধুরী সুমন, সাকুরুল ইসলাম চৌধুরী মনি ও সাহিরুল ইসলাম চৌধুরী বাপ্পি। সবার আন্তরিকতায় ব্যবসায় দিন দিন উন্নতি হতে থাকে। একসময় খবর পান তাদেরই এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের চা বাগান এম আর খান চা বাগান বিক্রি হবে। আর এ খবর শোনার পর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মনের মধ্যে অনেকটা বড় স্বপ্ন এঁকে ফেলেন। স্বপ্ন দেখতে থাকেন বাগান ক্রয় করার। কিন্তু বাগানের পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে পরিবারের কিছু সদস্য আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে বাধা আসে। কারণ বাগানটি মাত্রাতিরিক্ত লোকসানে ছিল। আর সে কারণেই এম আর খান সাহেব এটি বিক্রি করতে চাইছেন। কিন্তু সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সবার বাধা উপেক্ষা করে অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এম আর খান সাহেবের কাছ থেকে ৬শ একর লিজ ভূমি ও সাড়ে ২৬ একর পাট্টা ভূমি ক্রয় করেন। যখন তিনি এম আর খান চা বাগানটি ক্রয় করেন তখন ওই বাগানের কাঁচাপাতা উত্তোলন হতো ৩০ হাজার কেজি। (মেইড টি ৯ হাজার কেজি) ওই বাগানে কোনো ফ্যাক্টরি ছিল না। পুরো বাগানে শ্রমিকের ঘর ছিল ৮ থেকে ১০টি। বাঁশের বেড়ার একটি অফিস ছিল।

বেশিরভাগ শ্রমিকই অন্য বাগান থেকে এসে কাজ করত। ছোটবেলায় চা বাগানে থাকাতে চা গাছের প্রতি ছিল তার খুব মায়া। তাই চা বাগান ক্রয় করার পর পরই তিনি শ্রমিকদের সঙ্গে নিজে কাজে লেগে পড়েন। প্রথম বছর খুব খাটুনি করে একই চা বাগান থেকে বার্ষিক ক্রপ আসে দ্বিগুণ। অর্থাৎ ৬০ হাজার কেজি। (মেইড টি ১৮ হাজার কেজি) ১৯৮৯ সালের শেষদিকে তিনি তৈরি করেন চা ফ্যাক্টরি। অত্যন্ত যতœসহকারে চা তৈরি করায় ফ্যাক্টরি তৈরির প্রথম বছরেই তার বাগানের চা ২য় সর্বোচ্চ দাম পায়। কেজি প্রতি এম আর খান পায় ৫০.৯০ টাকা ও তার ওপরে জেরিন চা বাগান পায় ৫০.৯৩ টাকা। কিন্তু ফ্যাক্টরিতে তার এ অল্প চা উৎপাদনের পর তা এমনিতেই পড়ে থাকত। তিনি ভাবলেন এই রুগ্ণ চা বাগান থেকে অল্প খাটুনিতে তিনি বেশ লাভবান হচ্ছেন। কিন্তু এম আর খানের মতো অনেক ফ্যাক্টরিবিহীন চা বাগানের মালিক অল্পমূল্যে কাঁচাপাতা বিক্রি করে বছরের পর বছর লোকসান গুনে আসছেন। বিষয়টি তার মনের মধ্যে বেশ নাড়া দেয়।

সে সময় এই পর্যায়ের চা বাগান মালিকরা মাত্র দেড় টাকা কেজি দরে কাঁচাপাতা বিক্রি করে দিতেন। কিন্তু সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দেখলেন তা প্রসেসিং করে বিক্রি করলে উৎপাদন খরচ বাদে এই এক কেজি চা ৮ থেকে ৯ টাকা বিক্রি করা যাবে। আর এই বিষয়টি ভাবার পর তিনি পাশে দাঁড়ান ওই সব চা বাগান মালিকের। তিনি প্রথমেই তাদের দেড় টাকার স্থলে কেজি প্রতি ৫ টাকা দরে নগদ অর্থ দিয়ে কাঁচাপাতা নিয়ে আসেন তার ফ্যাক্টরিতে। এখানে এনে প্রসেস করে চট্টগ্রামে অকশনে বিক্রি করেন। এবং ১২ টাকা তার খরচা রেখে বাকি টাকা ওই বাগান মালিকদের ফেরত দেন। এতে দেখা যায় প্রতি কেজি চায়ের দাম তারা সর্বনিম্ন ৮টা হারে পাচ্ছেন। তিনি অনেকটা চা বাগান মালিকদের চোখ খুলে দেন। তিনি আজগরাবাদ, নেহার, রেহানা, মুরাইছড়া ও কেরামতনগরসহ প্রায় ১৬টি রুগ্ণ চা বাগানের চা এভাবে বিক্রি করে দিয়ে সে বাগানগুলোকে অলাভজনক থেকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কুলাউড়ার পৃথি¦মপাশার জমিদার বাড়ির মালিকানাধীন আজগরাবাদ চা বাগানের মালিক সাবেক এমপি আলী আব্বাস তাদের সে সময় বলেছিলেন আমরা পাতা নেয়ার পর তাদের মনে হচ্ছে যে তারা এখন চা বাগানের মালিক। এদিকে সিরাজুল ইসলাম এম আর খানের পতিত জমিগুলোতে ক্রমশ চায়ের আবাদ বাড়াতে থাকেন। বাগানের উৎপাদনও বাড়তে থাকে। ৮/১০টি শ্রমিক পরিবারের স্থলে শতেক পরিবারকে বাগানে বসতি করে স্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করে দেন।

সে সময় বড়লেখার কেরামতনগর চা বাগানের স্বত্বাধিকারীরা অনেকটা পারিবারিক মতানৈক্যে বাগানের পাতা উত্তোলন বন্ধ করে দেন। বাগানে জঙ্গল লেগে নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়। সিরাজুল ইসলাম জানান, এ খবর পেয়ে তিনি ছুটে যান এই বাগানের মালিকদের কাছে। তাদের পাতা তোলার অনুরোধ জানান। কিন্তু বিক্রি করে পাওয়া অর্থের চেয়ে খরচ অনেক বেশি বলে তিনি পাতা উত্তোলনে রাজি হননি। এ সময় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাদেরও দেড় টাকার পরিবর্তে ৫ টাকা নগদ দেবেন জানালে তারা পাতা তোলা শুরু করে। তারাও লাভের মুখ দেখেন। পরবর্তীতে তারা পুনরায় মতানৈক্যে পৌঁছলে আবারো বাগান বন্ধ হয়ে যায়। পরে তিনি তাদের মোট ১৮ শরিকানের কাছ থেকে ১৯৯২ সালে কেরামতনগর চা বাগানটি নিজে ক্রয় করে নেন। এ সময় তিনি কুলাউড়ার গাজীপুরের রাস্তার পাশে জমি কিনে চা বোর্ডের অনুমতি নিয়ে একটি ফ্যাক্টরি তৈরি করেন। যেখানে ওই এলাকার ফ্যাক্টরিহীন চা বাগানের মালিকরা সেখান থেকে তাদের চা প্রসেসিং করার সুযোগ পান।

এতে তিনি লাভবান হওয়ার পাশাপাশি ওই সব চা বাগানের মালিকরাও লাভবান হতে থাকেন। কয়দিন আগেও টি বোর্ডর ভাষায় যে বাগানগুলো ছিল রুগ্ণ বা অলাভজনক সেগুলো হয়ে ওঠে লাভজনক বাগানে। ১৯৯৯ সালে তিনি ক্রয় করেন নন্দরানী চা বাগান, ২০০৫ সালে তিনি ব্যবসার লাভ দিয়ে ক্রয় করেন কুমারশাইল চা বাগান। এভাবে তিনি সাধারণ একজন চা পাতা ব্যবসায়ী থেকে হয়ে ওঠেন চার চারটি চা বাগানের মালিক। ২০০৬ সালে তিনি কুলাউড়া গাজীপুর থেকে তার ফ্যাক্টরি তুলে নিয়ে যান কেরামতনগরে। আর ২০১৩ সালে তিনি তার ভাইদের নিয়ে দেশের উত্তরাঞ্চল পঞ্চগড়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চা চাষিদের জন্য পঞ্চগড়ে তৈরি করেন আরো একটি অত্যাধুনিক চা ফ্যাক্টরি। যার মাধ্যমে ওই এলাকার ক্ষুদ্র চা-চাষিরা বেশ লাভের মুখ দেখছেন।

এদিকে তার নিজস্ব দক্ষতার বলে তার বাগানগুলোতে প্রতিনিয়তই বাড়ছে উৎপাদন। যে বাগানে তিনি ক্রয় করার সময় উৎপাদন ছিল ৯ হাজার কেজি মেইড টি এই বাগানে বর্তমানে প্রতি বছরে ১ লাখ ৮৫ হাজার কেজি মেইড টি উৎপাদন হয়। দেশে গড়ে যেখানে হেক্টরপ্রতি বছরে উৎপাদন সাড়ে ১২শ কেজি তার বাগানে সেখানে হেক্টরপ্রতি ১৯শ থেকে ২ হাজার কেজি। কোনো কোনো সেকশনে ৪ হাজার ৫শ কেজিও হয়। তিনি বর্তমানে মনেপ্রাণে একজন চা উৎপাদনকারী ও অকশনার। এ পেশায় তার সব ভাই যেভাবে এগিয়ে এসেছেন তেমনি লেখাপড়া শেষে সিরাজুল ইসলামের দুই ছেলে ইয়াছির আশরাফ চৌধুরী সম্রাট ও ইয়াছির জাকারিয়া সাহানও এই পেশায় নজর দিয়েছেন।favicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment