প্রবাসে সফল নাফিসা
- লিডারশিপ ডেস্ক
গাইবান্ধার মেয়ে নাফিসা ইয়াসমিন। তার স্বামী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ওয়ালিউল হাসনাত ফিনিস একাডেমির বৃত্তি নিয়ে ডক্টরাল প্রোগামে ফিনল্যান্ডের ল্যাপল্যান্ডে অবস্থান করছিলেন। তিনিও শিক্ষকতা ছেড়ে স্বামীর উচ্চ শিক্ষার সঙ্গী হতে ২০০৬ সালে দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে পাড়ি দেন ফিনল্যান্ডে। কিন্তু ফিনল্যান্ডে গিয়ে স্বামী, সন্তান সংসার নিয়েই সময় কাটাতে চাচ্ছিলেন না তিনি। নিজেরও কিছু একটা করতে মন চাইছিল তার। নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে নাফিসা ঘর-সংসার সামলানোর পাশাপাশি ল্যাপল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি কোর্সে ভর্তি হন। তার স্বামী ওয়ালিউল হাসনাতের সুপারভাইজার তিমু কইমুরোভার অধীনেই গবেষণার কাজ শুরু করেন তিনি। ফিনিস ভাষাটাও দ্রুত রপ্ত করেন। এর ফলে স্থানীয় একটি এনজিওতে কালচারাল কো-অর্ডিনেটর হিসেবে খণ্ডকালীন চাকরি পেতেও তার সমস্যা হয় না। এখানে কাজ করতে এসে নাফিসা বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে জড়িয়ে পড়েন।
এ প্রসঙ্গে নাফিসা ইয়াসমিন বলেন, ফিনল্যান্ডে বসবাসরত কয়েকজন উচ্চ শিক্ষিত বাংলাদেশী যুবকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তাদের মধ্যে দু’তিনজন ঢাকার শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি লাভ করা প্রতিভাবান যুবক রয়েছেন। তারা ফিন্ডল্যান্ডের বাংলাদেশী রেস্তোরাঁয় কাজ করছিলেন। আমি তাদের নিয়ে কিছু একটা করার চিন্তা করি। এ ব্যাপারে আমার স্বামীর সঙ্গে পরামর্শও করি। ওদের অভিজ্ঞতাকেও গুরুত্ব দিই। ওদের সহযোগিতায় ফিনল্যান্ডে একটি ইন্ডিয়ান ফুডের রেস্তোরাঁ স্থাপনের পরিকল্পনা করি।সেই অনুযায়ী আমরা কাজ শুরু করি। অল্প সময়ের মধ্যে রেস্তোরাঁটি ভোজনরসিকদের কাছে খুবই পরিচিত এবং জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু এ কাজে জড়িয়ে পড়ায় আমার পিএইচডি প্রোগ্রাম সময় মতো চালিয়ে যেতে সমস্যা হয়। আমি শুধু এ কাজ করেই থেমে থাকতে চাইনি, আমি পিছিয়ে পড়া একটি দেশের নারী হিসেবে পরিশ্রম, মেধা ও কর্মদক্ষতার মাধ্যমে কল্যাণমুখী কাজ করে বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে চেয়েছি।
নাফিসা ইয়াসমিন সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কাজে নিজেকে যুক্ত করেন। তার কাজের প্রশংসাস্বরূপ ফিনল্যান্ডের পত্র-পত্রিকায়ও অনেক লেখা প্রকাশ হয়।
রেস্তোরাঁ পরিচালনা করতে গিয়ে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের সংস্পর্শে আসার সুযোগ লাভ করেন। সেই সঙ্গে সারা বিশ্বের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট অনুধাবনের সুযোগ সৃষ্টি হয় তার। ফিন্ডল্যান্ডে তখন ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ফিলিস্তিনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শরণার্থীদের অভিবাসনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। তিনি অভিবাসনের কাজে নিজেকে জড়িত করেন। তিনি স্থানীয় এনজিওদের মাধ্যমে এ সব মানুষকে সহায়তা দানের কাজ বেছে নেন। এ সময় তিনি ফিনিস নাগরিকত্বও লাভ করেন। সেই সুবাদে তিনি ফিনল্যান্ডের রাজনীতির সঙ্গেও সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পান। এ সব কাজে জড়িয়ে পড়ার কারণে তার প্রতিষ্ঠিত রেস্তোরাঁটির দিকে তিনি নজর দিতে পারছিলেন না। ইতিমধ্যে তার এক দেবর রফিউল হাসনাত বাংলাদেশ থেকে ফিনল্যান্ডে চলে আসেন। নাফিসা তাকেই রেস্তোরাঁটি পরিচালনার দায়িত্ব দেন এবং পুরোপুরি সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িত করার পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে থাকেন। বাংলা ছাড়াও উর্দু, হিন্দি, ফিনিস এবং ইংরেজি ভাষা রপ্ত করায় বিভিন্ন সময়ে তিনি দোভাষীর কাজও করেন। ২০১২ সালে তিনি রোভানিয়েমী সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সিটি কর্পোরেশনের তৎকালীন মেয়র তার কর্মদক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে ডেপুটি কাউন্সিলর হিসেবে নিয়োগ দিয়ে সেখানে তার দায়িত্ব পালনের সুযোগ করে দেন।
২০১৩ সালে তাকে ফিনল্যান্ডের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জারকি কাটাই এবং একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। সে সব খবর সেখানকার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এ সময় নাফিসা তার পিএইচডি প্রোগ্রাম আইন অনুষদ থেকে সোসাল সাইন্স অনুষদে পরিবর্তন করেন। এর মাধ্যমে তিনি ‘ইন্টারন্যাশাল রিলেশন অব ইমিগ্রেশন অ্যান্ড সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্স’ বিষয়ে গবেষণার সুযোগ পান। তার এ গবেষণার মাধ্যমে ফিনল্যান্ডসহ বর্তমান বিশ্বে অভিবাসন বিষয়ে নতুন ধারণা সৃষ্টির পাশাপাশি এ বিষয়ে নতুন মডেল ও কৌশলপত্র রচনার দ্বার উন্মোচিত হয়। ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণার বিষয়ে অধিক অভিজ্ঞতা অর্জনে নাফিসা ২০১৪-১৫ সালে আমেরিকা, কানাডা এবং ব্রিটেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনার এবং অন্যান্য প্রোগ্রামে অংশ নেয়ার সুযোগ পান। সে সব প্রোগ্রামে তার গবেষণার বিষয় তিনি তুলে ধরেন। পিএইচডি’র বিষয়বস্তুর ওপর সফল গবেষণার জন্য এ বছরের ২ মার্চ ল্যাপল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের বিশেষ ‘ভাইস-চ্যান্সেলর অ্যাওয়ার্ড’ আনুষ্ঠানিকভাবে তার হাতে তুলে দেন। এর আগে তিনি সহনশীলতা ও সমতা বিষয়ে গবেষণার পাশাপাশি অভিবাসন কাজের জন্য ফিনল্যান্ডের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাতিগত সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা বোর্ডের কাছ থেকে বিশেষ সম্মাননা পুরস্কার লাভ করেন।
নাফিসা ইয়াসমিন বর্তমানে ফিনল্যান্ডের আর্কটিক ইমিগ্রান্টের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সেই সঙ্গে তিনি রোভানিয়েমি সিটি কর্পোরেশন এবং গবেষকদের ট্রেড ইউনিয়ন বোর্ডেরও একজন সদস্য। তিনি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের এএমআই (Asylum, migration and Integration) ফান্ডেরও সদস্য। তিনি আগামীতে ফিনল্যান্ডের আর্কটিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত নর্দান ইমিগ্রেট রিচার্স নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হতে যাচ্ছেন।
নাফিসার বাবা এমদাদুল হক খন্দকার বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক ও মা মনোয়ারা হক একজন কর্মজীবী নারী।