গ্রাফিক্সে সফল গোলাম ফারুক
- লিডারশিপ ডেস্ক
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাল্টিমিডিয়া ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি বিভাগের প্রভাষক গোলাম ফারুক। বাংলাদেশি এই নাগরিকের পরিচয় এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। শিক্ষকতা পেশার পাশাপাশি সৃষ্টিশীল কর্মদক্ষতার গুণে পরিচয় ছড়িয়েছেন বিশ্বের দরবারে। গোলাম ফারুক নিজের নাম লিখেছেন সেরাদের তালিকায়। গ্লোবাল ফ্রিল্যান্সিং প্লাটফর্ম আপওয়ার্কের বিবেচনায় গোটা বিশ্বের লক্ষাধিক ফ্রিল্যান্সার গ্রাফিক্স ডিজাইনারের মধ্যে গোলাম ফারুক দ্বিতীয়। এ ছাড়াও লোগো ডিজাইনার ও গ্রাফিক্স ডিজাইনারদের তালিকায় চতুর্থ অবস্থানটিও গোলাম ফারুকের। আগস্ট মাসে আপওয়ার্ক ‘ইলাস্ট্রেশন ক্যাটাগরি’তে বিশ্বের সেরা ১১ জন ফ্রিল্যান্সার গ্রাফিক ডিজাইনারের তালিকা প্রকাশ করেছে। প্রায় ৬৫৩ ঘণ্টার শ্রম ব্যয়ে ১২৩টি প্রজেক্ট সফলভাবে শেষ করার পর সেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন ফারুক।
গোটা বিশ্বের কয়েক লাখ ফ্রিল্যান্সারের মধ্য থেকে কাজের দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে প্রতি মাসে এই তালিকা প্রকাশ করে আপওয়ার্ক। ফারুক আপওয়ার্কে প্রতিটি কাজের জন্য বর্তমানে প্রতি ঘণ্টায় ৩৫ ডলার করে ফি নিচ্ছেন। তালিকার প্রথম পাঁচজনের মধ্যে সবচেয়ে কম ঘণ্টা কাজ করেও তিনিই শীর্ষে আছেন।
গোলাম ফারুক জানান, ‘সরকারি চাকরিজীবী বাবার ৫ সন্তানের মধ্যে আমি তৃতীয়। গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর। ছোটবেলা থেকে ছবি আঁকার প্রতি ছিল প্রবল আগ্রহ। মায়ের কাছে আঁকাআঁকির হাতেখড়ি হয়ে যায় স্কুলজীবনে। এরপর থেকে নিজের ইচ্ছায় আঁকাআঁকি চলে। বাড়ির অমতে লুকিয়ে ভর্তি হই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে। সে কারণে বাড়ি থেকে কোনো রকম খরচই পেতাম না।’
প্রথম বছর মা লুকিয়ে নিজের হাতখরচ থেকে টাকা দিতেন। দ্বিতীয় বছরে খরচ বেড়ে যাওয়ায় মা টাকার জোগান দিতে অপারগ হন। তখন বাধ্য হয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি ছবি আঁকার টিউশনি শুরু করি। রং আর ক্যানভাস বাবদ পাঁচ হাজার টাকা নিজেকে আয় করতে হতো। অপরদিকে ইউনিভার্সিটির বেতন আর অন্যান্য খরচ চলত শিক্ষাবৃত্তি থেকে। ১৯৯৪ সালে ব্যাচেলর পরীক্ষা দিয়ে কালারস্ক্যানে খণ্ডকালীন চাকরির শুরু।
দুই বছর এভাবে চলার পর ১৯৯৬ সালে গ্রে গ্লোবাল গ্রুপে যোগ দিই। তারপর পেপার রাইম নামের একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ শুরু। এরই মাঝে একই অনুষদ থেকে ড্রয়িং ও পেইন্টিংয়ের ওপর স্নাতকোত্তর শেষ করি। চাকরির পাশাপাশি পড়াশোনা চালানোটা আমার জন্য বেশ কষ্টের ছিল। তবু লক্ষ্য ছিল ভালো কিছু করার। ব্যস্ততার মাঝেও ২০১১ সাল থেকে চলছিল অনলাইনে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ। ফ্রিল্যান্সিং পোর্টাল ওডেস্কে প্রথম একটি কুকুরের ডিজিটাল ছবি এঁকে যাত্রা শুরু।
প্রথম কাজ করে পেয়েছিলেন আট ডলার, সঙ্গে উপহার হিসেবে আরও দশ ডলার। মাত্র পাঁচ-ছয় বছরের ব্যবধানে কাজের ধারাবাহিকতায় সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫০০ ডলারের কাজও করেছেন গোলাম ফারুক।
নানা ধরনের ইলাস্ট্রেশনে দক্ষতা রয়েছে তার। এর মধ্যে ‘ডিজিটাল পেনসিল স্ক্যাচ, পেইন্টিং, জিআইএফ অ্যানিমেশন, টি-শার্টের নকশা, লেবেল ডিজাইনিং, লোগো ডিজাইনিং, ফটো এডিটিংসহ অনলাইনে যেসব কাজের চাহিদা বেশি, সব দিকেই রয়েছে সমান দক্ষতা। নিয়মিত এক ভারতীয়-মার্কিনের কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। এই এক ক্লায়েন্টের জন্যই এখন পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজার ডলারের কাজ করেছেন।
শুধু দেশেই নয়, বিদেশের অনেক প্রতিষ্ঠান আর অনুষ্ঠানের জন্য কাজ করেছেন তিনি। তার করা নকশা ব্যবহার করে ২০১০ সালে প্যারিস ফ্যাশন ফেয়ারের আয়োজন করা হয়। এ ছাড়াও নিয়মিত বিভিন্ন একক ও যৌথ শিল্প প্রদর্শনীতে তিনি অংশ নেন।
গোলাম ফারুকের লক্ষ্য
কাজকে ভালোবেসেছেন, পরিশ্রম করেছেন অকাতরে। গোলাম ফারুকের মতে, ‘সফলতার কোনো সংক্ষিপ্ত পথ নেই। পরিশ্রম আর একাগ্রতার মাধ্যমেই সফল হওয়া সম্ভব’। তিনি মনে করেন, সাফল্য সেই ভালোবাসার হাত ধরে আজ আমার কাছে এসেছে। তবে সবসময় শুধু চেষ্টা ছিল ভালো কাজ করার। দর্শকদের অবাক করার মধ্যেই সাফল্য খুঁজে পেতাম। জীবনধারণে টাকার প্রয়োজন অনেক। সে কারণে যে কাজই করি টাকার বিষয়টিও মাথায় থাকে। তবে এই পেশায় যত টাকা আয় করি না কেন নিজেকে একজন সফল শিক্ষক হিসেবেই দেখতে চাই। যতটুকু শিখেছি ততটুকু পরবর্তী প্রজন্মকে দেওয়ার চেষ্টা করছি। ক্লাসের পড়ার বাইরেও আমার ছাত্রদের ফ্রিল্যান্সিংয়ের নানা বিষয়ে শেখানোর চেষ্টা করি। তাদের কাজের জন্য উদ্বুদ্ধ করি। গোলাম ফারুক বলেন, ছাত্রছাত্রীর সফলতাতেই আমার সার্থকতা। তাদের হাত ধরেই আমার দেশ দারিদ্র্যমুক্ত হবে।
আগ্রহীদের জন্য পরামর্শ
ফ্রিল্যান্সিংয়ে প্রবল আগ্রহ থাকলে যে কেউ ভালো করতে পারে। সে জন্য কাজের বিষয়ে সততা থাকতে হবে। কাজের জন্য পাওয়া সময়ের মধ্যে নিজের কাজটি সম্পন্ন করতে হবে। শক্তিশালী ও দৃষ্টিনন্দন পোর্টফোলিও বানানোটা এই কাজের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কাজকে ভালোভাবে বুঝে-শিখে তারপর অনলাইনে কাজের জন্য আবেদন করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, যে দেশে কাজের আবেদন করতে হবে, আগেই তার উৎসব বা অর্থনৈতিক উত্থান-পতনের বিষয়টি জেনে নিতে হবে। যেমন আমেরিকায় বড়দিনের এক মাস আগে কাজের বাজারে ভাটা পড়ে। ফলে এ সময় আবেদন করলে কাজ তেমন পাওয়া যাবে না, পেলেও কম মূল্যের। বারবার আবেদন করে কাজ না পেলেও হতাশ হওয়া যাবে না। দরকার হলে ফ্রিল্যান্সিংয়ে অভিজ্ঞ কারও পরামর্শ নিতে হবে। এ ছাড়াও ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার পাশাপাশি ভালো যোগাযোগের ক্ষমতা থাকতে হবে।
ছাত্রদের জন্য করণীয়
ছাত্রজীবন শিক্ষার সর্বোৎষ্ট সময়। গোলাম ফারুকের মতে, ফ্রিল্যান্সিং করতে গিয়ে শিক্ষার মহামূল্যবান সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। অবসর সময় মোবাইল, ফেসবুক ও কম্পিউটার গেমস খেলে নষ্ট না করে সেই সময়টুকু ফ্রিল্যান্সিং করলে আয়ের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা আসবে। প্রতিযোগিতামূলক পৃথিবীতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে এটি খুবই দরকার।
বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সিংয়ের সম্ভাবনা
আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার বেশির ভাগই যুবসমাজ। ছোট দেশ অথচ মানুষ বেশি, কর্মসংস্থানের সুযোগ কম। আমি মনে করি, আউটসোর্সিং ফ্রিল্যান্সিং-ই আমাদের ভবিষ্যৎ উত্তরণের প্লাটফর্ম। তিনি বলেন, আমাদের দেশে যারা গ্রাফিক্স ডিজাইনে এক্সপার্ট আছে, সরকার তাদের দিয়ে যুবকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করাতে পারে। সেই সঙ্গে আরও দরকার নিরবচ্ছিন্ন ও হাইস্পিড ইন্টারনেট এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ। আরও দরকার অনলাইনে টাকা আদন-প্রদান সুবিধাজনক পর্যায়ে আনা। আমাদের দেশে শুধু ডলার আনা যায়, পাঠানো যায় না। তাই বড় ধরনের একটি কাজে দ্বিতীয় বা তৃতীয় ধাপে যখন বিদেশি এক্সপার্ট হায়ার করতে হয়, তখন আমরা তাকে ডলারে পারিশ্রমিক দিতে পারি না। ফলে অনেক কাজ আমাদের ছেড়ে দিতে হয়। এটা কাজের জন্য বড় ধরনের একটি প্রতিবন্ধকতা। উল্লেখ্য, ব্যবসা শুধু আদানে হয় না প্রদানও করতে হয়। এখন আমাদের শুধু আদান আছে, কিন্তু প্রদানের সুবিধা নেই। যেদিন দুটো সুবিধাই চালু হবে সেদিন থেকে বাংলাদেশ উন্নতির পথে হাঁটবে।
নতুনদের সচেতনতা
বিশেষ কিছু ব্যাপারে নতুনদের সচেতন থাকার পরামর্শ দেব। প্রথমেই খেয়াল রাখতে হবে যাতে, প্রোফাইল ছবিটা হাস্যোজ্জ্বল হয়। ওভারভিউ গুছিয়ে লিখতে হবে, দরকার হলে কয়েকটি ভালো ওভারভিউ নমুনা দেখে নিজের মতো করে সাজিয়ে লেখা উচিত। জব পোস্টটি ভালো করে পড়ে ও বুঝে জব অ্যাপ্লিকেশন লিখতে হবে। জব অ্যাপ্লিকেশনে জবের ওপর অভিজ্ঞতা ও সংক্ষিপ্ত বায়োডাটা দিলে ভালো। সর্বোপরি সততা, নিয়মানুবর্তিতা, একাগ্রতা, কথার হেরফের না করা এবং সময়মতো কাজ দেওয়াই হলো ফ্রিল্যান্সিং সাফল্যের মূলমন্ত্র।
আপওয়ার্ক
বর্তমান গ্লোবাল ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটের প্লাটফরম হিসেবে আপওয়ার্ক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ২০১৫ সালে প্রসিদ্ধ ফ্রিল্যান্সিং প্লাটফরম ওডেস্ক ও ইল্যান্স দুটি একসঙ্গে সংযুক্ত করে আপওয়ার্ক নামে ব্র্যান্ডিং করা হয়। এটি পরিচালিত হয় ক্যালিফোর্নিয়ার সানফ্রানসিসকো ও মাউন্টেনভিউ থেকে। এখানে এক কোটি ২০ লাখ রেজিস্ট্রার্ড ফ্রিল্যান্সার কাজ করেন। ৫০ লাখ রেজিস্ট্রার্ড ক্লায়েন্ট বছরে প্রায় ৩০ লাখ জব পোস্ট করে থাকেন। বিপুলসংখ্যক এই কাজের মূল্য প্রায় এক বিলিয়ন ইউএস ডলারের সমান। কাজের বাজারের দিক থেকে আপওয়ার্ক বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফ্রিল্যান্সিং মার্কেট।
নতুনের জয়গান
আপওয়ার্ক ইলাস্ট্রেশন ক্যাটাগরিতে বিশ্বের সেরা ১১ জন ফ্রিল্যান্সার গ্রাফিক্স ডিজাইনারের তালিকা প্রকাশ করেছে। প্রায় ৬৫৩ ঘণ্টার শ্রম ব্যয়ে ১২৩টি প্রজেক্ট সফলভাবে শেষ করার পর সেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন ফারুক। নানা ধরনের ইলাস্ট্রেশনে দক্ষতা রয়েছে তার।