দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ফারুকের জীবন জয়
- লিডারশিপ ডেস্ক
আমাদের চারপাশে অনেক মানুষ আছে যাদের কারও হাত, কারও পা আবার কারও চোখ নেই। কেউবা আবার কথা বলতে পারে না, কেউ কানে শোনে না। কিন্তু এত সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অনেক মানুষ নিজগুণে নিজেদের করেছেন সফল। তেমনই একজন হলেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ভূল্লী এলাকার ফারুক আহম্মেদ। তিনি স্বাভাবিকভাবে জন্মগ্রহণ করলেও নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় (১৯৯৬ সালে) তিনি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। পরে অদম্য সাহস আর ইচ্ছাশক্তির কাছে হার মানে সমস্ত প্রতিকূলতা। ঘর থেকে বের হয়ে বাজারসহ বিভিন্ন কাজ পর্যন্ত করেন এই দৃষ্টিহারা মানুষটি।
পথে পরিচিত কেউ কথা বললে ঠিকঠাক চিনেও ফেলেন। কিন্তু ফারুক আহম্মেদের আসল সাফল্য তার পেশায়। তিনি ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা বড় বালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। নয়নে অচল কিন্তু মননে সচল ফারুক আহম্মদ। তার বাসা ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ভূল্লী বালিয়া এলাকায়। ৩৫ বছর বয়সী মানুষটি সব প্রতিবন্ধকতা জয়ের জীবন্ত এক উদাহরণ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। লিখিত পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে তিনি মৌখিক পরীক্ষাতেও অংশগ্রহণ করেন। মৌখিক পরীক্ষার প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েও ক্যাডার বা ননক্যাডার পদে উত্তীর্ণ হতে পারেননি তিনি।
ফারুক আহম্মদ বলেন, বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় পাস করার পর আমি মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি চলতি বছরের ১৫ মার্চ। প্রস্তুত হয়ে ভাইভা বোর্ডে গিয়েছি। প্রথমে আমার বিষয়ে সব কিছু ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করি।
বোর্ডের চেয়ারম্যান আমাকে বলেন, ফারুক সাহেব আমরা আপনার প্রতি সহানুভূতিশীল। তারপর যদি আপনি ক্যাডার হোন আপনার কর্মস্থলে কীভাবে যাতায়াত করবেন, সমস্যা হবে কিনা, নানা ধরনের প্রশ্ন করতে থাকেন।
এক পর্যায়ে একজন জাহানারা ইমাম সম্পর্কে, সংবিধানের মূলনীতি বিষয়ে, ধর্ম নিরপেক্ষতা নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন। আমি সব কিছুই ভালো করে ব্যাখ্যা দিয়েছি। পরে চেয়ারম্যান সাহেব বললেন ‘বেস্ট অব লাক’ ফারুক সাহেব। মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে আশা করেছিলাম, আমি ক্যাডার বা নন ক্যাডার পেয়েই যাব।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক গত ১৭ আগস্ট ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল প্রকাশ হয়েছে। আমি যখন আমার রোলটি ক্যাডার অথবা ননক্যাডার লিস্টে না দেখি তখন মর্মাহত ও খুবই বিচলিত হই। তিনি আরও বলেন, আমি আবার এই ধাপে কখন পৌঁছাব। ৩৭তম বিসিএস পরীক্ষায় আবার অংশগ্রহণ করব। পরবর্তীতে আবার প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারি কিনা শঙ্কা বোধ করছি। আমি আমার জীবন চলার পথে যে ধাক্কা খেলাম, মনোবাসনা ছিল সেখান থেকে পিছিয়ে গেলাম এখন নিজেকে খুবই অসহায় মনে করছি। হয়তো আমার জীবনের পথ চলা কিছুটা হলেও থমকে গেল।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ফারুকের পড়াশোনা ও বেড়ে ওঠা
সদর উপজেলা ভূল্লী বালিয়া এলাকায় এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয় ফারুক আহম্মেদ। স্বাভাবিকভাবে জন্মগ্রহণ করলেও নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় (১৯৯৬ সালে) তিনি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। সুচিকিৎসার অভাবে ধীরে ধীরে অন্ধ হয়ে যান। দৃষ্টিশক্তি হারানোর পর পরিবারের উৎকণ্ঠা ও হতাশার মধ্যেই শুরু হয় ফারুকের পথ চলা। ফারুক বলেন, ৫ বছর পর ২০০১ সালে জেনেছি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে গেলেও পড়াশোনা করা যায়। তারপর একটু আশান্বিত হয়ে জীবনটা নতুন করে সাজানোর স্বপ্ন দেখা শুরু করি। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের পড়া ব্যয়বহুল অপরদিকে পারিবারিকভাবে তেমন সচ্ছল ছিল না। ফারুক নিজ উদ্যোগে দিনাজপুর জবলি স্কুল রিসোর্স সেন্টারে মোহাম্মদ হাফিজ উদ্দিনের তত্ত্বাবধানে পড়াশোনা শুরু করেন। এরপর ২০০৩ সালে ওই প্রতিষ্ঠান থেকে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। পরবর্তীতে ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজ থেকে ২০০৫ সালে এইচএসসি পাস করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করে ফারুক।
ফারুকের পেছনে যার অবদান
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হওয়ার পর বাবা-মার পরে ফারুকের এতদূর অগ্রসর হওয়ার পেছনে যার সবচেয়ে বড় অবদান তিনি তার স্ত্রী তাহমিনা আহম্মেদ। এইচএসসি পরীক্ষার পর ফারুক বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি এখন দুই সন্তানের জনক। তার স্ত্রী ঢাকায় একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে পড়াশোনা ও সংসার চালান। বিসিএস পরীক্ষা পর্যন্ত ফারুকের পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার পেছনে তার স্ত্রীর অবদান বেশি। গর্ভবতী অবস্থায় পরীক্ষার আগে প্রতিটি বই পড়ে শোনাত স্ত্রী তাহমিনা। স্ত্রীর চোখ দিয়ে পৃথিবী দেখত বলে ফারুক জানান। স্ত্রীর অবদান চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে বলে দৃষ্টিহীন ফারুক বলেন, এ রকম বন্ধন যেন প্রতিটি মানুষের জীবনে হয়। তাহলে সমাজ অবশ্যই একদিন আলোকিত হয়ে উঠবে।