আউটসোর্সিংয়ে বাংলাদেশি চমক
- লিডারশিপ ডেস্ক
এ এস এম মহিউদ্দিন মোনেম। আব্দুল মোনেম লিমিটেডের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তিনি। এ ছাড়া বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং কোম্পানি সার্ভিসইঞ্জিন লিমিটেডের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। আইএওপির ‘দ্য গ্লোবাল আউটসোর্সিং ১০০’ তালিকায় রাইজিং স্টার হিসেবে স্থান পেয়েছে তার আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান সার্ভিসইঞ্জিনবিপিও।
আউটসোর্সিংয়ে বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই অর্জন বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। ‘সার্ভিসইঞ্জিন’ দেশের সেরা শিল্প গ্রুপ আব্দুল মোনেম লিমিটেডের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান। গত জুনে সর্বশেষ, ২০১৬ সালের বিশ্বের সেরা ১০০ আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশ করেছে আইএওপি। প্রতিষ্ঠানের আকার এবং প্রবৃদ্ধি, গ্রাহক মতামত, স্বীকৃতি ও সনদ, উদ্ভাবনী কর্মসূচি ও সামাজিক দায়বদ্ধতা— এসব বিবেচনায় সেরা প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করা হয়। ২০১৪ সাল থেকে সার্ভিসইঞ্জিনবিপিও ধারাবাহিকভাবে এ স্বীকৃতি পেয়ে আসছে।
মহিউদ্দিন মোনেমের পথচলা শুরু হয় উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফিরে এসে। যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি (বোস্টন) থেকে ১৯৯১ সালে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ১৯৯৪ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজমেন্ট অনুষদে মাস্টার্স ডিগ্রিও লাভ করেন। দেশে ফিরে পারিবারিক ব্যবসাতেই মন দেন তিনি। তার বাবা বিশিষ্ট শিল্পপতি আব্দুল মোনেম। তিনি ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন আব্দুল মোনেম লিমিটেড। কোকা-কোলার বোতলজাতকরণ, ইগলু আইসক্রিম, চিনি পরিশোধনাগার, রাইস ব্র্যান অয়েল, ঔষধ, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবারসহ বিভিন্ন ধরনের খাবারও তৈরি করছে আব্দুল মোনেম লিমিটেড। তার সন্তান মহিউদ্দিন মোনেমের নেতৃত্ব ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা দিয়ে পারিবারিক ব্যবসার আরও বিস্তৃতি ঘটান।
সেই ধারাবাহিকতায় ২০০৬ সালে মাত্র ছয়জন কর্মী নিয়ে সার্ভিসইঞ্জিনবিপিও কার্যক্রম শুরু হয়। ২০০৬ সালে যখন কেউ বাংলাদেশ থেকে আউটসোর্সিংয়ের কথা ভাবতেও পারেননি তখন যুক্তরাষ্ট্রের পার্টনারের সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারে যাত্রা শুরু করেন তিনি। শুরুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পাইলট প্রকল্পের আওতায় আর্থিক সেবাধর্মী কিছু কাজ করেন। পাইলট প্রকল্পটি বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতকে দেওয়া হয়। নির্ধারিত সময়ে কাজটি শেষ করা ছিল বড় একটি চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তিনি তরুণদের ওপর আস্থা রাখেন। প্রায় ৬০ জন তরুণকে ট্রেনিং দিয়ে কাজটি নির্ধারিত সময়ে শেষ করেন। ওই প্রকল্পের কাজের মান, উৎপাদন দক্ষতা এবং যথাযথ ব্যবস্থাপনা দেখে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানটি তাদের সঙ্গে স্থায়ীভাবে কাজ করতে সম্মত হয়।
সেই গল্প নিজেই বলেন, শুরুর দিকে আমার কোম্পানির কর্মীদের বলেছিলাম সার্ভিসইঞ্জিনবিপিওর ভবিষ্যৎ কী হবে তা তোমাদের হাতে। তোমরা পারলে প্রতিষ্ঠান বাঁচবে, বাংলাদেশ পাবে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের আরেকটি ক্ষেত্র। তারা আমাকে জোর গলায় বলেছিল, ‘ইয়েস স্যার, উই ক্যান ডু ইট’। হ্যাঁ, তারা পেরেছে। এরপর শুরু সাফল্যের গল্প।
মাত্র ছয়জন নিয়ে শুরু করা প্রতিষ্ঠানের কর্মী সংখ্যা এখন পাঁচ শতাধিক। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও যুক্তরাজ্যের কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আউটসোর্সিংয়ের কাজ করছে এই প্রতিষ্ঠানটি। দেশের শীর্ষস্থানীয় বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং কোম্পানি সার্ভিসইঞ্জিনের দেশের বাইরেও বিভিন্ন স্থানে সেবাকেন্দ্র রয়েছে। তারা বিভিন্ন দেশে ব্যাক অফিস প্রসেসিং, ডিজিটাল অ্যাডভারটাইসিং অপারেশন, ওয়েব এবং সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ডেটা এগ্রিগেশন, কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স এবং ফিনেনশিয়াল রিস্ক কমপ্লায়েন্স সেক্টরে সেবা প্রদান করে থাকে।
মহিউদ্দিন মোনেম এর ভাষায়, আউটসোর্সিং সেবায় বিশ্ববাজারে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে আমাদের তরুণরা যথেষ্ট ভালো করছে। ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাও অনেক ভালো। রপ্তানি বহুমুখীকরণ ও শিক্ষিত তারুণ্যনির্ভর জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে আউটসোর্সিং ইন্ডাস্ট্রি। এজন্য সরকারকে কিছু প্রণোদনা দিতে হবে। বিভিন্ন শিল্পে সরকার যেভাবে প্রণোদনা দিয়ে থাকে, তারুণ্যের মেধার মূল্যায়ন করতে সেভাবে এ ক্ষেত্রেও প্রণোদনা দেওয়া উচিত। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি তরুণদের কাজের উন্নত মান ও নির্দিষ্ট সময়ে সম্পন্ন করার যে ইতিবাচক ইমেজ রয়েছে সেটি সম্প্রসারিত করতে সরকারকে আরও আন্তরিক হওয়া উচিত। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে ভিশন নিয়ে সরকার কাজ করছে সেখানে আউটসোর্সিংয়ে নগদ রপ্তানি প্রণোদনা দেওয়া হলে বহু উদ্যোক্তা এ কাজে যোগ দিতে উৎসাহিত হবে। ভবিষ্যতে এ খাত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বড় ভূমিকা রাখবে। এ খাতে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এমনকি পোশাক শিল্প খাতকেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছাড়িয়ে যেতে পারে। প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ তরুণ কাজের খোঁজে নামছেন। আউটসোর্সিংয়ে আসা তরুণদের সৃজনশীলতা প্রশংসনীয়। তারা শিক্ষিত ও দক্ষ। আউটসোর্সিংয়ের মতো কাজে তাদের সুযোগ করে দিতে সরকারের প্রণোদনা বড় ভূমিকা রাখবে।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পাশাপাশি জাতীয়ভাবেও স্বীকৃতির পুরস্কার পেয়েছেন মহিউদ্দিন মোনেম। হাইটেক শিল্পে অবদানের জন্য তিনি এরই মধ্যে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার, তথ্যপ্রযুক্তি ও সফটওয়্যার রপ্তানিতে অবদানের জন্য জাতীয় রপ্তানি ট্রফিতে স্বর্ণপদক ও বিগত কয়েক বছর সর্বোচ্চ করদাতা হিসেবেও পুরস্কৃত হয়েছেন।
মহিউদ্দিন মোনেম বাংলাদেশে চেক সরকারের সম্মানসূচক দূত হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া কয়েক বছর ধরে তিনি সরকারের মনোনীত সিআইপি।
আইসিটি মন্ত্রণালয় তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি আয়ের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে তা অবশ্যই অর্জন করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে আইটি আউটসোর্সিং অনুঘটক হিসেবে একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। এ বিষয়ে মহিউদ্দিন মোনেম বলেন, রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য অর্জনে এবং এ খাতকে আরও প্রতিযোগিতা সক্ষম করে তোলার জন্য নগদ রপ্তানি প্রণোদনার পাশাপাশি প্রয়োজন যথাযথ মার্কেটিং ও ব্র্যান্ডিং।
তার প্রতিষ্ঠানের সাফল্য সবাইকে অনুপ্রাণিত করবে। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমেও যে শিক্ষিত তরুণরা তাদের ক্যারিয়ার গড়তে পারে—তিনি সেটাই করে দেখিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, তরুণরাই আমাদের সত্যিকারের নায়ক। তারাই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশি তরুণরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল হচ্ছে। আউটসোর্সিংয়ে তাদের সাফল্যের কথা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত।