স্বপ্ন দেখান সাইফুল্লাহ
- লিডারশিপ ডেস্ক
জার্মান প্রবাসী সাইফুল্লাহর প্রতিষ্ঠান অ্যাপলম্বটেকবিডি কাজ করছে ইন্টারনেটভিত্তিক তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য নিয়ন্ত্রণে। ঘরে বসে ইন্টারনেটের সাহায্যে যে কোনো স্থানে ইলেকট্রিক পণ্য নিয়ন্ত্রণে এরই মধ্যে সফল হয়েছেন তিনি। মানুষের জীবনযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে আসার স্বপ্ন দেখানো মানুষটি নিয়ে এই প্রতিবেদন।
এক বিকেলে অ্যাপলম্বটেকবিডির ঢাকা অফিসে পৌঁছলে অভ্যর্থনা জানান সাইফ সাইফুল্লাহ। নিয়ে যান তার রুমে। ‘দূর থেকে এসেছেন; বোধহয় গরম লাগছে’ বলে তার স্মার্টফোনে কী যেন চাপেন। দেখি, আমাদের মাথার উপরের সিলিং ফ্যানটি ঘোরা শুরু করেছে। ‘স্পিড বোধহয় বেশি হয়ে গেছে’- বলে স্মার্টফোনে আবার কী যেন চাপেন। দেখি, ফ্যানের স্পিড কমে গেছে। কথা বলা শুরু হয় আমাদের। কুশল বিনিময় শেষে জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের অ্যাপলম্বটেকবিডির কাজ সম্পর্কে বলুন। উত্তরে বললেন, ‘এই যে দেখলেন। বুঝিয়ে বলি, মোবাইলে চাপ দিলাম, ফ্যান অন হলো, স্পিড কমালাম। শুধু ফ্যান নয়, আমরা যে কোনো ইলেকট্রিক সামগ্রী ইন্টারনেটের সাহায্যে পৃথিবীর যে কোনো স্থান থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। তবে ওই পণ্যের পাসওয়ার্ড আমাদের মোবাইলে থাকতে হবে।’
আমাদের কৌতূহলী মনে প্রশ্ন। ব্যাপারটি তিনি আঁচ করতে পেরেছেন। বলেন, ‘এখন দিনের বেলা। রুমে বাইরে থেকে পর্যাপ্ত আলো আসছে। যখন আকাশ মেঘলা, তখন পর্যাপ্ত আলো আসবে না। চাইলে লাইট জ্বালিয়ে আলো কমবেশি করা যাবে।’ কথাটি বলে তিনি রুমের একটি লাইট জ্বালান মোবাইলের সাহায্যে। এরপর সে লাইটের আলো কমিয়েও দেখান
অ্যাপলম্বটেকবিডির উদ্ভাবনের তালিকায় শুধু লাইট-ফ্যান নিয়ন্ত্রণ নয়, ইলেকট্রিক সামগ্রী পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে ইন্টারনেটের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। একটি লাইট থেকে ২৫৬ রঙের আলো পাওয়া যায়।
অ্যাপলম্বটেকবিডির উদ্ভাবনের স্বীকৃতি মিলছে দেশ-বিদেশ থেকে। বর্তমানে বাংলাদেশ ছাড়াও জাপান এবং জার্মানিতে কাজ করছে অ্যাপলম্বটেকবিডি। জার্মানির আর্মি ইউনিভার্সিটি, জাপানের সর্ববৃহৎ ইলেকট্রিক কোম্পানি ফুরুকাওয়া ইলেকট্রিকসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বর্তমানে অ্যাপলম্বটেকবিডির সঙ্গে কাজ করছে।
বাংলাদেশে ঢাকা ওয়াসার পানির পাম্প নিয়ন্ত্রণ, পানি পরিশোধনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্লোরিন মেশানো, কখন কী পরিমাণ বিদ্যুতের ব্যবহার জানাসহ ঢাকা ওয়াসার ডিজিটালাইজেশন কর্মসূচিতে অ্যাপলম্বটেকবিডি সহযোগিতা করছে।
সহযোগিতা করছে কুমিল্লা পিডিবির স্মার্ট মিটার কার্যক্রম পরিচালনা। এতে কুমিল্লা পিডিবির গ্রাহকরা পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে ইন্টারনেটের সাহায্যে কখন কী পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হলে মেসেজ আসা, বিল পরিশোধ করাসহ বিভিন্ন সুবিধা পাবেন। অ্যাপলম্বটেকবিডির স্মার্ট মিটার উদ্ভাবনের স্বীকৃতি মিলেছে এ বছরের ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে।
ঢাকায় ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডের সমাপনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকসহ উপস্থিত ছিলেন সৌদি আরব, ভুটান, সুইজারল্যান্ডসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশের কয়েকজন মন্ত্রী। অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার স্মারক হিসেবে অ্যাপলম্বটেকবিডিকে হার্ডওয়্যার ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। অ্যাপলম্বটেকবিডি উদ্ভাবিত স্মার্ট মিটারের জন্য এ পুরস্কার দেওয়া হয়। ইন্টারনেটভিত্তিক পণ্য উৎপাদনে সাফল্য পাওয়া সাইফুল্লাহ দেশে পড়েছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। উচ্চশিক্ষা নেওয়ার জন্য জার্মানিতে যান ২০০২ সালে।
অ্যাপলম্বটেকবিডির শুরু হয় জার্মান প্রবাসী সাইফ সাইফুল্লাহর হাত ধরে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক করে উচ্চশিক্ষার জন্য বেছে নেন জার্মানি। ভর্তি হন ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে মাস্টার্সে। কম্পিউটারের ডি র্যাম তৈরির কারণে বহুল প্রচলিত প্রতিষ্ঠান কিমন্ডায় যোগ দেন কনসেপ্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। দুই বছর কাজ করে হেড অব কনসেপ্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পদোন্নতি পান। সবকিছু ঠিকমতোই চলছিল। কিন্তু ২০০৮ সালে বিশ্বমন্দা সব এলোমেলো করে দেয়। দেউলিয়া হয়ে যায় কিমন্ডা। ১২ হাজার কর্মচারীর প্রতিষ্ঠান কিমন্ডা বন্ধ হয়ে যায়।
কিমন্ডা বন্ধ হয়ে গেলে বিকল্প হিসেবে প্রথমে মাথায় আসে দেশে ফিরে যাওয়ার। কয়েক বছর জার্মানিতে থাকার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দেশে হাইটেক প্রতিষ্ঠান তৈরি করার চিন্তা ছিল মাথায়। দেশে হাইটেক প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো সৃষ্টি না হওয়ায় সে চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেন। জার্মানি থেকে নতুন কিছু তৈরি করে দেশে ফেরার কথা ভাবেন।
২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন তার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান সাইনপালস। এ প্রতিষ্ঠান শুরুতে ইনটেল, ইনফিনিয়ন, সিমেন্সসহ কিছু তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের ছোট ছোট কাজ করে দিত। এভাবে আত্মবিশ্বাস বাড়ছিল। কিন্তু সাইনপালসের কাজ মানুষ দেখছিল না। আর এভাবে আড়ালে থাকার ইচ্ছা কখনোই সাইফ সাইফুল্লাহর ছিল না। তাই সাইনপালসের আয়ের একটি অংশ গবেষণা খাতে খরচ করার সিদ্ধান্ত নেন। গবেষণা করার সময় মাথায় রাখতেন, ভবিষ্যতে কী ধরনের পণ্য বাজারে আসবে। সে ধরনের পণ্য তৈরিতেই ছিল তার নিবিষ্ট মনোযোগ। কর্মী নিয়োগ দেওয়ার সময় বাংলাদেশিদের অগ্রাধিকার দেন। হাতেগোনা কয়েকটি পদ ছাড়া সাইনপালসের সব কর্মচারী বাংলাদেশি।
সাইনপালসের সুবিধাগুলো বাংলাদেশের মানুষের কাছে পেঁৗছে দিতে ২০১২ সালে তিনি অ্যাপলম্বটেকবিডি নামে একটি প্রতিষ্ঠান রেজিস্ট্রেশন করেন। ২০১৩ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠানটির অফিস চালু করেন। ইতিমধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করে ইলেকট্রিক পণ্য নিয়ন্ত্রণের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। স্মার্ট ডিমেবল এলইডি, স্মার্ট ডিমেবল রেইনবো, স্মার্ট সুইচ, স্মার্ট ট্যাংক প্রভৃতি পণ্য তৈরি করছেন। এ ছাড়া স্মার্টফোন ব্যবহার করে বাড়ির পর্দা, হিটার, এসি অন/অফ করার প্রযুক্তিও উদ্ভাবন করেছেন। প্রযুক্তিগুলো শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বেও নতুন।
মেড ইন বাংলাদেশ
অ্যাপলম্বটেকবিডির উদ্ভাবিত সব পণ্যে লেখা থাকে মেড ইন বাংলাদেশ। বিশ্বের বিভিন্ন তথ্যপ্রযুক্তি মেলায় এ পণ্যগুলো নিয়ে হাজির হন সাইফ সাইফুল্লাহ। তিনি বলেন, ”ইন্টারনেট ব্যবহার করে প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশও নেতৃত্ব দিচ্ছে। আমাদের ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ স্লোগান বিশ্বদরবারে পজিটিভ বাংলাদেশকেই প্রতিনিধিত্ব করছে।”
পরিচিতি : সাইফ সাইফুল্লাহ ১৯৭৬ সালের ২৫ জুলাই সাতক্ষীরার কলারোয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯১ সালে কলারোয়া পাইলট হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৯৩ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। অ্যাপলম্বটেকবিডির প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বর্তমানে।
যেভাবে কাজ করে এসব পণ্য : স্মার্ট ডিমেবল এলইডি, স্মার্ট ডিমেবল রেইনবো এবং স্মার্ট সুইচ ইন্টারনেটের সাহায্যে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। নিয়ন্ত্রণের কাজটি হয় মোবাইল অ্যাপের সাহায্যে। পণ্যের প্যাকেটে দেওয়া ঠিকানা অনুসারে গুগল প্লে স্টোর এবং অ্যাপ স্টোর থেকে অ্যাপ ডাউনলোড করা যাবে। অ্যাপ ইনস্টল করে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হলে অ্যাপের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। মোবাইল অ্যাপের সঙ্গে ইন্টারনেট না থাকলে ৩০ মিটার দূর থেকে পণ্য নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। ইন্টারনেট থাকলে যে কোনো জায়গা থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।