দিনে চানাচুরওয়ালা রাতে শিল্পী
- লিডারশিপ ডেস্ক
বাপ্পীর বয়স এখন ২৬ বছর। বাবার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে চানাচুর বিক্রি করেন, সঙ্গে নিমকিও। বেশির ভাগ দিন বিকেল হয় বাড়ি ফিরতে, কোনো কোনো দিন রাত। এরপর হাত-মুখ ধুয়ে ভাত খান। খাওয়া হলে বসেন হাতুড়ি-বাটালি নিয়ে। রং-তুলিতেও হাত চলে তাঁর। ডিমের খোসায়ও ছবি আঁকেন বাপ্পী।
ঘর নেই তো বারান্দা
বাপ্পীরা গরিব। ঘরে বেশি জায়গা নেই। তাই বারান্দায় গিয়ে বসেন। নেশাটা কখনো কখনো ভূতের মতো চেপে বসে। রাত গভীর হয়, বাপ্পী ঘুমিয়ে পড়েন বারান্দায়ই। ধান লাগানোর মৌসুমে বাপ্পীর কষ্ট বাড়ে। সকালে ক্ষেতে না গেলে তো কাজে গোলমাল বেধে যায়, শিল্পী তাই ঘুম চোখেই চারা বোনেন আর মনে মনে বোনে জয়নুলের নাক বা রবীন্দ্রনাথের আলখাল্লা।
ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো
লালন, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, রোকেয়া, নজরুল, বঙ্গবন্ধু, জয়নুল, সুলতান প্রমুখকে ফুটিয়ে তুলেছেন বাপ্পী। কাগজে, কাঠে বা মাটিতে। আছেন সাত বীরশ্রেষ্ঠও।
শুরুর কথা
চৌগাছা উপজেলার উত্তর কয়ারপাড়া গ্রাম যশোর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে। বাপ্পীর বাবা জীবন কুমার কুণ্ডু কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন। মা চন্দনা রানীর দিন কাটে অভাব ঠেলে ঠেলে। বড় ছেলে বাপ্পী স্কুলে গেলেন অভাব সঙ্গে নিয়েই। পাঠ্য বইয়ে তিনি শাপলা ফুল, দোয়েল, কাঁঠাল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলকে দেখেছেন। পেনসিলে এঁকে শিক্ষকদের দেখালে তাঁরা বাহবা দিয়েছেন। ছবি আঁকার ক্লাসে বাপ্পী ফার্স্ট। বাপ্পীদের বাড়ির পাশেই কুমারবাড়ি। স্কুলফেরত বাপ্পী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কুমারদের কাজ দেখতেন। চেয়ে আনতেন মাটির ঢেলা। নজরুল, রবীন্দ্রনাথ গড়ে কুমারদেরও তাক লাগিয়ে দিতেন। বাপ্পীকে উৎসাহ দিতেন তাঁর শিক্ষক ইউনুছ আলী আর প্রতিবেশী মুক্তিযোদ্ধা হরিদাস। বলতেন, ‘লেগে থাকো। এক দিন বড় শিল্পী হতে পারবে। গ্রামের মান বাড়াবে। ’ বাপ্পী মাকে গিয়ে বলেছেন, ‘আমি আর্ট কলেজে পড়ব। বড় শিল্পী হব। ’ আড়ালে চোখের পানি ফেলতেন মা।
জীবন এখানে–সেখানে
নিমকি বা দানাদার ঘরেই তৈরি করে দেন বাপ্পীর মা। বাপ্পীকে সঙ্গে নিয়ে বাবা কোনো দিন কয়ারপাড়া মোড়, কোনো দিন সিংহঝুলি হাটে গিয়ে বসেন। ২০০-৩০০ টাকা আয় হয়। বাবা তখনো ভালোই ছিলেন। মানসিক ভারসাম্য হারান হঠাৎ করেই। নানি তখন বাপ্পীকে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার কুণ্ডারদিয়া গ্রামে নিয়ে যান। অন্যের জমিতে মজুরি খাটতেন বাপ্পীর নানা। বাপ্পীও নানার সঙ্গে কাজে লেগে যান। দিন গেলে ৫০ টাকা। একসময় কুণ্ডারদিয়া বাজারে সাইনবোর্ড, ব্যানার লেখা শুরু করেন বাপ্পী। প্রতিদিন ১০০ বা ২০০ টাকা আয় হতো। কোনো কোনো দিন শিকড়-বাকড় দিয়ে ঘোড়া, বক, ব্যাঙ, মাছরাঙা বা জিরাফ বানিয়ে লোকদের তাক লাগিয়ে দিত। আট বছর ছিলেন তিনি কুণ্ডারদিয়ায়। তারপর কয়ারপাড়া ফিরে আসেন। আবার চানাচুর বিক্রির কাজে লাগেন। জমি বর্গা নিয়ে ধান, গম বা পাট আবাদ করেন।
দুঃখের ছবি বেশি
বাপ্পীর ভাস্কর্যের সংখ্যা ৪০টি। মেহগনি কাঠে কাজ করতে ভালোবাসেন। চিত্রকর্মের সংখ্যা শ-এর বেশি হবে। জলরঙ বেশি, তেলরঙও আছে কিছু। হোটেল থেকে ডিমের খোসা কুড়িয়ে এনে রক্তাক্ত বঙ্গবন্ধুর ছবি এঁকেছেন। মোনালিসাও গড়েছেন ডিমের খোসা দিয়ে। বাপ্পীর একটি শিল্পকর্মের নাম মানবজীবন। সাড়ে পাঁচ ফুট উঁচু। বড় একটি কাঠের গুঁড়ি খুঁড়ে তৈরি করেছেন। কয়েকটি অবয়ব আছে এতে, তাদের কেউ গরিব, কেউ বড়লোক। মা আর শিশুও আছে। দুর্ভিক্ষ নামের আরেকটি শিল্পকর্মে ক্ষুধার্ত মানুষের কঙ্কাল ফুটিয়ে তুলেছেন বাপ্পী। রানা প্লাজা নামের একটি শিল্পকর্ম গড়েছেন। আরো গড়েছেন টোকাই।
আছে মুক্তিযুদ্ধ
বিজয় নামের চিত্রকর্মে বাপ্পী এঁকেছেন পতাকা হাতে মুক্তিযোদ্ধার দল। বধ্যভূমি চিত্রকর্মে দেখা যায় নিরীহ বাঙালির লাশ শিয়াল-কুকুরে খাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা হরিদাস বললেন, ‘বাপ্পী খুবই সুন্দর ছবি আঁকে। রাত জেগে কাঠ কেটে কেটে কত কী বানায়। শুধু আর্থিক দৈন্যের কারণে সে সামনে এগোতে পারছে না। ’ মা চন্দনা রানী বললেন, ‘ওর বাবা অসুস্থ। মাঝেমধ্যে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন তাঁর মাথা কাজ করে না। বাপ্পী হাটে গিয়ে মিষ্টি বিক্রি করে। বাড়ি ফিরে ছবি বানায়। এখন ছবি রাখারও জায়গা নেই। ছেলেকে নিয়ে কী করব বুঝতে পারছি না। ’ বাপ্পী চান জাতীয় পর্যায়ে একটি প্রদর্শনী করতে। বঙ্গবন্ধুর ছবিটি প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দিতে চান। ছবিতেই বেঁচে থাকতে চান।