তাহাদের উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প
- লিডারশিপ ডেস্ক
কাকলী আক্তার। স্বামী নাসির উদ্দিনের টেক্সটাইল মিলে চাকরির আয় দিয়ে টেনেটুনেই চলত সংসার। স্বচ্ছতা আনতে উদ্যোগী হন কাকলী আক্তার। ব্র্যাকের সহায়তায় প্রশিক্ষণ নিয়ে ঢাকার ইসলামপুর থেকে অর্ডার নিয়ে মেয়েদের ওড়নায় কারুকাজ করে স্বচ্ছতা এনেছেন তিনি। স্বামীর আয়ের বাইরে ঘরে বসেই প্রতি মাসে ৩৫-৪০ হাজার টাকা আয় করেন কাকলী। ঢাকা থেকে কাপড় ও কারুকাজের অর্ডার নিয়ে যান। স্থানীয় নারীদের সহায়তায় হাতের কাজ শেষ করে ব্যবসায়ীদের সরবরাহ করেন।
এভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুঁজির উদ্যোগে সাবলম্বী হয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ, সোনারগাঁও ও আড়াইহাজার উপজেলার কয়েক শ নারী। একজন নারী উদ্যোক্তা পরিবারের অভাবকে বিদায় জানিয়ে এনেছেন সচ্ছলতা। আবার কেউ কেউ নিজেদের সচ্ছলতার পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী অন্য নারীর অর্থ উপার্জনের সুযোগ করেছেন। একদিকে পরিবারের অভাব দূর হচ্ছে, অন্যদিকে নারীর অর্থনৈতিক-সামাজিক ক্ষমতায়নও হচ্ছে। কেউ কাপড়ে কারুকাজ ও বিউটি পার্লার দিয়ে অভাব ঘুচিয়েছেন, আবার কেউ কেউ মোমবাতি ও নেট ব্যাগ তৈরির মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর করেছেন। স্বল্প পুঁজির উদ্যোগী নারীদের মুখে এখন সফলতার হাসি।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্র্যাকের ‘ইকোনমিক এমপাওয়ারমেন্ট ফর পুওর অ্যান্ড ভালনারেবল উইমেন ইন বাংলাদেশ (ইইপি)’ শীর্ষক প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। নারায়ণগঞ্জের তিনটি উপজেলায় দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ নারীদের অর্থনৈতিক কাজে সম্পৃক্ত, আর্থসামাজিক ক্ষমতায়ন ও নারী উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে প্রকল্প চালু করে। ইতিমধ্যে এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে।
প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানায়, নারায়ণগঞ্জের প্রকল্প এলাকায় নারীদের আর্থিক অবস্থা খুবই ভঙ্গুর ছিল। পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা ছিল না। অভাবগ্রস্ত পরিবারের উন্নয়নে তিনটি উপজেলার ৬০টি গ্রামে তিন হাজার ৬০০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এদের তিন হাজার ৩৩৮ জন অর্থাৎ ৯২.৭২ শতাংশ নারী ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
সূত্র জানায়, তিন উপজেলার প্রত্যেকটিতে ২০টি করে গ্রামে এক হাজার ২০০ জনকে প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে নেওয়া হয়। নির্বাচিতদের কমিউনিটি এমপাওয়ারমেন্ট গ্রুপ সভা, কমিউনিটি এডুকেটর জেন্ডার প্রশিক্ষণ ও জীবিকা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ব্যবসার প্রয়োজনে নারীদের বাজারের সঙ্গে সম্পৃক্তকরণ, এলাকায় জেন্ডার সচেতনতামূলক নাটক প্রদর্শন, ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি করপোরেশন, বিডাব্লিউসিসিআই ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কর্মশালা করা হয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় কাপড় কেটে পোশাক তৈরি (টেইলারিং), প্যাকেজিং, মোমবাতি ও আগরবাতি, এমব্রয়ডারি, ব্লক-বাটিক, হস্তশিল্প, গরু মোটাতাজাকরণ ও ছাগল পালন, হাঁস-মুরগি পালন, নেট টিস্যু কাপড় ও পাটের ব্যাগ তৈরি, নার্সারি ও সবজি চাষ, বিউটি পার্লার, খাদ্যসামগ্রী তৈরি ও মাশরুম চাষে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর স্বল্প পুঁজিতে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠেন কেউ কেউ। অন্য সদস্যরা উদ্যোক্তাকে সহায়তা করেন। প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর রূপগঞ্জের এক হাজার ২০০ প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীর মধ্যে এক হাজার ১০৫ জন ব্যবসায় সম্পৃক্ত হয়েছেন। শতকরা হিসাবে ৯২.০৮ শতাংশ। সোনারগাঁও উপজেলায় এক হাজার ১০২ জন (৯১.৮৩%) ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, আর আড়াইহাজার উপজেলায় এক হাজার ১৩১ জন (৯৪.২৫%) ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন।
১. ওড়নায় হাতের কাজ করেন কাকলী : সম্প্রতি রূপগঞ্জের কয়েকটি গ্রামে উদ্যোক্তাদের কাজকর্ম পরিদর্শনকালে বড়ালু গ্রামের কাকলী আক্তার বলেন, ‘কেবল নিজের পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে এমনটি নয়, আশপাশের শতাধিক নারীও স্বাবলম্বী হয়েছে। সংসারের কাজ শেষে অবসর সময়ে ওড়নাতে হাতের কাজ করে প্রতি মাসে তিন হাজার থেকে চার হাজার টাকা আয় করছে। ’
কাকলী জানান, ঢাকার ইসলামপুরের কাপড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতিটি ওড়নায় কাজ করাতে ৩০ টাকা চুক্তিতে অর্ডার নেওয়া হয়। হাতের কাজ করতে স্থানীয় নারীদের প্রতিটি কাপড়ে ১০ টাকা করে দেওয়া হয়। সংসারের কাজ শেষে অবসর সময়ে নারীরা এক দিনে ১০-১২টি কাপড়ে হাতের কাজ করতে পারে। এক মাসে একজন স্থানীয় নারীর আয় তিন হাজার থেকে চার হাজার টাকা। পুঁতি, সুতা, সুতার রং ও যাতায়াত বাবদ কাকলীর খরচ প্রায় ১৪-১৫ টাকা। সেই হিসাবে প্রতিটি কাপড়ে কাকলীর আয় থাকে পাঁচ-ছয় টাকা। প্রতি মাসে প্রায় ১০ হাজার কাপড়ে হাতের কাজ করার অর্ডার পান কাকলী। কখনো কখনো অর্ডার কমও হয়। সেই হিসাবে প্রতি মাসে কাকলীর গড়ে আয় ৩৫-৪০ হাজার টাকা।
২. নেট ব্যাগের কারিগর শিলা রানী : ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ে হয় শিলা রানীর। স্বামী শ্রী কালিপদ সরকার দুধ বিক্রি করে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করতেন। স্বামীর সংসারে গিয়েই মুখোমুখি হতে হয় অভাব-অনটনের। উপায়ান্তর না দেখে শিলা রানীও গ্রাম থেকে দুধ সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করতেন। স্বামীর অসুস্থতায় শিলার জীবন আরো কঠিন হয়ে পড়ে। জীবন বদলানোর চেষ্টায় প্রশিক্ষণ নিয়ে নেট ব্যাগ তৈরির কাজে নেমে পড়েন তিনি। স্থানীয় বাজার থেকে ৪৭০ টাকায় এক থান নেট কিনে ৪০০ ব্যাগ তৈরি করেন। প্রতিটি ব্যাগ বিক্রি করেন এক টাকা ৬০ পয়সায়। মাসিক বেতনে চারজন কারিগর এক দিনে এক হাজার ৫০০ ব্যাগ তৈরি করতে পারে। স্থানীয় বাজারে নেট ব্যাগ বিক্রি করে স্বাবলম্বী তিনি। সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতি মাসে ২৫-৩০ হাজার টাকা আয় থাকে।
৩. বিউটি পার্লারে জহুরার সাফল্য : ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ে হয়ে এক সন্তানের মা হওয়ার পর তালাকপ্রাপ্ত হন জহুরা বেগম। সন্তানকে নিয়ে বাপের বাড়িতে ফিরে এসে কঠিন অসহায়ত্বের মুখোমুখি হয়েছেন জহুরা বেগম। ঘরে বসে হাতের কাজ করে সামান্যই আয় করতেন। ব্র্যাকের প্রশিক্ষণ নিয়ে বাড়িতে বিউটি পার্লার সেবা চালু করেন তিনি। উদ্যোক্তা হওয়ার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে জহুরা বেগম বলেন, ‘পরিবার ও স্থানীয় মানুষের সমালোচনা সত্ত্বেও পার্লার চালু করি। গ্রামে পার্লারের তেমন প্রচলন না থাকায় অনেকের সমালোচনাও সহ্য করেছি। শুরুতে তেমন সাড়া না থাকলেও ব্র্যাকের ইইপি প্রকল্পের সদস্যরা নিয়মিতই আসতেন। সেই থেকে যাত্রা শুরু। ক্রমেই পরিসর বাড়তে থাকে। ক্ষুদ্র পরিসরের উদ্যোগে বিনিয়োগ পাঁচ লাখ টাকা ছাড়িয়েছে। এ বছর জয়িতা পুরস্কার পেয়েছি। ’
৪. মোমবাতি তৈরি করে স্বাবলম্বী সাবিকুন্নাহার : সাবিকুন্নাহারের স্বামী আজিজুর রহমান রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। রূপগঞ্জের জাহাঙ্গীর বাজারের পাশেই তাদের বসবাস। স্বামী কাজে চলে যাওয়ার পর কোনো কাজ থাকে না। অবসর সময় কাজে লাগিয়ে বাড়তি আয়ের উদ্দেশ্যে ব্র্যাকের সহায়তায় মোমবাতি তৈরির প্রশিক্ষণ নেন তিনি। ঢাকা থেকে উপকরণ কিনে নিয়ে বাড়িতে মোমবাতি তৈরি করেন। ৫ ও ১০ টাকা মূল্যের মোমবাতি তৈরি করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন। তবে ব্র্যাকের সহায়তায় বড় বড় দোকানেও মোমবাতি সরবরাহ করেন তিনি।
সাকিবুন্নাহার বলেন, ‘ছয়টি মোমবাতি তৈরিতে খরচ হয় প্রায় ১৫ টাকা। পাইকারিতে তা বিক্রি হয় ২০ টাকায়। দোকানদার সেই মোমবাতি ৩০ টাকায় বিক্রি করে। প্রতিদিনই ৬০০ থেকে ৭০০ মোমবাতি তৈরি করি। তিনি আরো বলেন, নারী হয়ে মোমবাতি তৈরি করে আয় করব এটা স্বামী চাননি। এখন মোমবাতির উপকরণ আনা, বাজারে মোমবাতি দিয়ে আসার কাজ তিনিই করেন। ’
নারীদের উন্নয়নে ইইপি প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও ব্র্যাকের প্রশিক্ষণ বিভাগের তত্ত্বাবধানে এই কর্মসূচি চালিয়ে নেওয়া হবে বলে জানালেন প্রকল্প সমন্বয়কারী খালেদা খানম। তিনি বলেন, দরিদ্র নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ও পরিবারের উন্নয়নের নতুন কিছু করার লক্ষ্যে এই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। হতদরিদ্র নারীদের দক্ষতা উন্নয়নের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।