গল্পটা বিশ্বজিতের নাকি শ্যামলকান্তির ?
- লিডারশিপ ডেস্ক
আমার নাম ছিল বিশ্বজিৎ দেবনাথ। বাড়ি যশোর। গ্রামের নাম জঙ্গলবাঁধাল। সদর উপজেলার বসুন্দিয়া ইউনিয়নে। বাবার নাম কৃষ্ণপদ দেবনাথ, মায়ের নাম কদম বৈরাগী। তাঁরা কেউ আর বেঁচে নেই। আমি তাঁদের একমাত্র সন্তান। মা ছিলেন বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী। বাবার বয়স ৫০ যখন, পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গেলেন। কঠিন হয়ে গেল আমাদের দিনগুলো। আয়ের কোনো উৎস ছিল না আমাদের। বাবা মারা যান ১৯৯২ সালে। আমার বয়স তখন সাড়ে তিন বছর মাত্র।
বাড়িহারা হলাম
গ্রামের এক মুদি দোকানদারের কাছে বেশ কিছু টাকা ঋণ ছিল বাবার। মায়ের সামর্থ্য ছিল না তা শোধ করার। মুদি দোকানি স্থানীয় মাতব্বরদের সঙ্গে ঘোঁট পাকিয়ে আমাদের বসতবাড়ি আর বাড়ির ধারের জমিটুকুর দখল নিয়ে নেয়। আমার মা ছিলেন বৈরাগী, মানে নিম্ন গোত্রের। আমার জেঠামশাই আর কাকা কেউ মাকে মেনে নেয়নি কখনোই। আমাকেও তাঁদের বংশের বলে স্বীকার করতে চাইতেন না। বাবার মৃত্যুর পর তাঁরা কেউ ফিরেও তাকায়নি। বাবার প্রথম পক্ষের সন্তানরাও তখন মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু তারা অন্যত্র আলাদাভাবে বসবাস করত। যোগাযোগ রাখত না।
মা পড়লেন অথই জলে
আমার মায়ের পৈতৃক বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার জলিরপাড় ইউনিয়নের বানিয়ারচর গ্রামের বৈরাগীপাড়ায়। কোনো মামা নেই আমার। মায়ের অন্য দুই বোনও আর্থিক কষ্টে ছিলেন। এমন পরিস্থিতিকে দুঃসহ বলা ভালো। মা পড়লেন অথই জলে। প্রতিবেশী আব্বাস মোল্লা ছিলেন বাবার ঘনিষ্ঠ। নিজের বাড়িতে আমাকে ও মাকে আশ্রয় দিলেন। একবেলা-দুবেলা খেয়ে কোনোমতে দিন চলে যাচ্ছিল।
অন্য উপায় না পেয়ে মা মসুর ডাল ভাঙানোর মিলে কাজ নিলেন। শ্রমিকের কাজ।
দৈনিক মজুরি ২৫ টাকা
সকাল থেকে সন্ধ্যা টানা কাজ করতে হতো মাকে। মাত্র ২৫ টাকা মজুরি পেতেন দিনে। এ দিয়ে আমরা খাব, না পাওনাদারের ঋণ শোধ করব? মায়ের দুশ্চিন্তা বাড়তেই থাকল। হাড়ভাঙা খাটুনির ফলে মায়ের শরীরেও নানা রোগ বাসা বাঁধল। একপর্যায়ে তিনি কাজ করার শক্তি হারিয়ে ফেলেন। আমাকে তখন চায়ের দোকান বা হোটেলের কাজে দেওয়ার কথা বললেন অনেকে। কিন্তু মা চাইতেন আমি লেখাপড়া শিখে ভালো কিছু করি।
মিশনারি স্কুলে চলে যেতে হলো
কোনোভাবেই চলছিল না আমাদের। একপর্যায়ে মা আমার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে একটি খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলে পাঠিয়ে দিলেন। সেটি ১৯৯৬ সাল। স্কুলটি খুলনায়। অথচ আমিই ছিলাম মায়ের অন্ধের যষ্ঠি। কিন্তু উপায় কী কাছ ছাড়া না করে? যা-ই হোক, আমার স্কুলটি ছিল খুলনার দৌলতপুর উপজেলার মহেশ্বর পাড়ায়। নাম ক্যালভেরি অ্যাপস্টোলিক চার্চ, স্কুল ও অরফানেজ। মা থাকতে শুরু করেন অভয়নগরের নওয়াপাড়া শিল্পশহরে, বড় মাসির সঙ্গে। বছরে তিন-চারবার মা এসে আমার সঙ্গে দেখা করে যেতেন। মিশনের পরিচালক ছিলেন ফাদার জন হিরা। তিনি আমাকে ‘অ্যারন’ বলে ডাকতেন। অন্য সহপাঠীরাও ডাকত অ্যারন। মিশনে থাকা-খাওয়া সব কিছুই ছিল ফ্রি। পড়াশোনাও হতো ভালো।
মা চলে গেলেন
রোগ ছিল শরীরে। মনে ছিল শোক। মা আর সইতে পারলেন না। ১৯৯৮ সালের অক্টোবরে না-ফেরার দেশে চলে গেলেন মা। মাকে নওয়াপাড়া মহাশ্মশানে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। মাকে শেষবারের মতো দেখার জন্য মাসতুতো দাদারা আমাকে মিশন থেকে নিতে এসেছিলেন। কিন্তু মায়ের মৃত্যু আমি সহজে নিতে পারব না ভেবে মিশন কর্তৃপক্ষ দাদাদের সঙ্গে পরামর্শ করে খবরটি গোপন রাখে। দাদাদের সঙ্গে সেবার আমার যাওয়া হয়নি। জানতে পারি অনেক পরে।
আমার যাওয়ার জায়গা ছিল না
মিশন স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা হতো নভেম্বরের মাঝামাঝিতে। অনাথ আশ্রমের ছেলেরা তখন আত্মীয় বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ পেত। ফিরে আসত জানুয়ারির শুরুতে। কিন্তু এই দেড় মাসও মিশনেই থাকতাম। আমার খারাপ লাগত খুব। নিজেকে খুব অসহায় মনে হতো। একবার ১৯৯৯ সালে মিশন থেকে পালিয়েছিলাম। বড় মাসির বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলাম। পরে আমাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে তাঁরা আবার মিশনে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু মিশন কর্তৃপক্ষ আমাকে আর ভর্তি করাতে রাজি হয়নি।
নাম হলো শ্যামলকান্তি
মিশনে জায়গা না পেয়ে মাসির বাড়িতে থাকতে শুরু করি। কিন্তু সেখানে জীবন সহজ ছিল না। কিছুদিন পর আমি আবার আব্বাস মোল্লার বাড়িতে গিয়ে উঠি। মাঠে গরু-ছাগল চরানো, ঘাস কাটা ইত্যাদি কাজ ছিল আমার। তবে স্কুলে যেতে পারছিলাম। জঙ্গলবাঁধাল মাধ্যমিক বিদ্যালয়। সেখানে সহপাঠীরা আমাকে ‘হারুন’ নামে ডাকত। আমি ইসলাম শিক্ষার ক্লাস করতাম। ভালো ব্যাপার ছিল যে আমি প্রতি ক্লাসেই ফার্স্ট হতাম। তাই স্যারেরা আমাকে সাহায্য করতেন। স্কুলের একজন শিক্ষক সন্তোষ চক্রবর্তী, ২০০২ সালে আমাকে মণিরামপুর উপজেলার মশিয়াহাটী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। তখন আমি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। ভর্তির সময় আমার মা-বাবার নাম লেখা হয় কালিদাস বিশ্বাস ও অমিতা বিশ্বাস। সন্তোষ স্যার তখনো অবিবাহিত ছিলেন। কালিদাস-অমিতা দম্পতি তাঁর বন্ধু ছিলেন। তাঁরা থাকতেন নওয়াপাড়া শিল্পশহরে। আমার নাম রাখা হয় শ্যামলকান্তি বিশ্বাস।
২০০৫ সালে এসএসসি দিলাম
স্কুলের হোস্টেলে থেকেই পড়ালেখা করতাম। খরচাপাতি কালিদাস বিশ্বাসই দিতেন। যেদিন স্কুল বন্ধ থাকত সেদিন মাছের ঘেরে কাজ করতাম। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ২০০৫ সালে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। ভর্তি হই নওয়াপাড়া ডিগ্রি কলেজে। তখন পালক বাবা কালিদাস বিশ্বাসের বাড়িতে থাকতাম। বাড়ির টুকটাক কাজ করতাম। সেখান থেকে বিজ্ঞান বিভাগে ২০০৭ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। ব্যবহারিক পরীক্ষা শেষে কলেজের সহপাঠীরা প্রায় সবাই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য ঢাকায় কোচিং করতে গেল। তখন কালিদাস বিশ্বাসের কাছে আবদার করি, বন্ধুদের সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিং করতে ঢাকা যেতে চাই। ’ তিনি বলেন, ‘তুই ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হবি। পড়ালেখার পাশাপাশি কাপড়ের দোকানে কাজ করবি। ’ কিন্তু আমার মন মানছিল না। আমি কলেজের কয়েকজন শিক্ষককে অনুরোধ করলাম ব্যাপারটি আমার পালক বাবাকে বুঝিয়ে বলতে। তিনি রাজি হচ্ছিলেন না কোনোভাবেই। একপর্যায়ে আমি আবার বাড়ি ছাড়া হলাম।
দেখা হয়েছিল আমিনুলের সঙ্গে
কালিদাস বিশ্বাসের হয়তো ইচ্ছা ছিল, আমাকে মোটামুটি লেখাপড়া করিয়ে তাঁর দোকানের বিশ্বস্ত কর্মচারী করার। যা-ই হোক, আমি তখন খুবই হতাশাগ্রস্ত। ভাবলাম ঢাকায় যাই। কোনো গার্মেন্টে কাজ নেব। পকেটে ছিল মাত্র ২৭০ টাকা। ঢাকায় রওনা দেওয়ার আগে সহপাঠী আমিনুলের সঙ্গে দেখা হলো। আমিনুলদের অবস্থাও তত ভালো ছিল না। কিন্তু সে আমাকে নিজের মেসে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিল। জোগাড় করে দিল টিউশনিও। আমিনুলের জামা-কাপড় দুজনে মিলেই পরতাম। বইপত্র সবই ছিল আমিনুলের। কিছুদিন পর এইচএসসির ফল বেরোল। কিন্তু আমিনুল এক বিষয়ে অকৃতকার্য হলো। ফলে আমিনুল ফিরে গেল নিজের গ্রামের বাড়িতে।
এবার শাফায়াত সাহায্য করল
অনেক কষ্টে যশোর বোর্ড থেকে এইচএসসির প্রবেশপত্র ও রেজিস্ট্রেশন কার্ডের ডুপ্লিকেট বের করলাম। আমার পালক বাবা রাগে ওগুলো ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদনের সময় শেষ হয়ে গিয়েছিল। ভরসা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এদিকে মেসের খরচ জোগানো আমার জন্য দুঃসাধ্য হয়ে উঠল। কলেজেরই আরেক সহপাঠী ছিল শাফায়াত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফরম কিনে দিয়েছিল শাফায়াত। বাড়ি চলে গেলেও আমিনুল আমার খোঁজখবর রাখত। সব সময় সাহস দিত আমিনুল আর শাফায়াত।
এগিয়ে এলেন শরিফুল হাসান ভাই
২০০৮-০৯ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিলাম। ‘ঘ’ ইউনিটে (বিভাগ পরিবর্তন) মেধা তালিকায় ২৬১তম, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বিজ্ঞান বিভাগ) ১১তম এবং ‘ক’ ইউনিটে প্রথম অপেক্ষমাণ তালিকায় ছিলাম। ‘ঘ’ ইউনিট থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তির সুযোগ পাই। কিন্তু ভর্তির টাকা? নওয়াপাড়া ডিগ্রি কলেজের তখনকার অধ্যক্ষ রেজাউল করিম মন্টু স্যারকে বিষয়টি জানাই। তিনি চার হাজার টাকা জোগাড় করে দেন। পাশাপাশি দৈনিক প্রথম আলোর অভয়নগর উপজেলা প্রতিনিধি মাসুদ আলমের মাধ্যমে প্রথম আলোর শরিফুল হাসান ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। হাসান ভাই ভর্তির টাকা দেন এবং আমার ছয় মাসের খাওয়া ও আনুষঙ্গিক খরচ দেন। হাসান ভাইয়ের সহপাঠী সুদীপ দাদার মাধ্যমে জগন্নাথ হলে উঠি।
পড়তে পড়তে কাজ
পড়তে পড়তেই ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রিসোর্সেস ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (এমআরডিআই) নামের এক প্রতিষ্ঠানে সহকারী মনিটরিং অফিসার হিসেবে চাকরি পাই। মোহাম্মদপুর এলাকায় দুটি টিউশনিও করতাম। ২০১০ সালের শুরুতে বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরে শিক্ষানবিশ সহসম্পাদক পদে যোগ দিই। প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণেও কাজ করেছি কয়েক মাস। মাস্টার্সের প্রথম সেমিস্টার পর্যন্ত দৈনিক আট ঘণ্টা অফিস করেছি। পরে হলে ফিরে সরকারি চাকরির জন্য রাত জাগতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই আমি লক্ষ্যস্থির করেছিলাম হয় বিসিএস কর্মকর্তা হব, নইলে কাজ নেব বাংলাদেশ ব্যাংকে। ইংরেজি আর গণিতে আমার ভালো দক্ষতা। অবশেষে ২০১৫ সালের ব্যাচে বাংলাদেশ ব্যাংকে সহকারী পরিচালক পদে যোগদান করি।
একটি বিশেষ ঘটনা
তখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। আমার স্কুল ইউনিফর্ম ছিল না। সহপাঠীদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ ছিল ফারুক আর কালাচাঁদ। ফারুক ক্লাস শেষে চায়ের দোকানে কাজ করত। আর কালাচাঁদ তাদের ছোট মুদি দোকানে বসত। আমিও কাজ করতাম একটা কাঠের দোকানে। একদিন আমাকে অবাক করে দিয়ে ফারুক আর কালাচাঁদ এক সেট স্কুল ড্রেস নিয়ে এলো। বলল, ‘নে, এটা পরে স্কুলে যাবি। কখনো স্কুল কামাই দিবি না। আমাদের অভাবের সংসার। পড়াশোনা আসলে হবে না। তুই পড়াশোনা করলে ভালো কিছু করবি। ’ ফারুক আমার চেয়েও ভালো ছাত্র ছিল। গণিত আর ইংরেজিতে ভালো ছিল, কিন্তু পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেনি। ওদের সংসার বড় ছিল। ওকে ভাইবোনদের টানতে হতো। আমার বিশ্বাস, উপযুক্ত পরিবেশ পেলে ফারুক ইঞ্জিনিয়ার হতে পারত।
কাউকে ভুলিনি
আমিনুল, শাফায়েত, ফারুক, সন্তোষ স্যার ও হাসান ভাই—কাউকে ভুলিনি। আমিনুল এখন সিঙ্গাপুরে। আমার খবর এখনো নেয়। জানতে চায়, টাকা-পয়সা লাগবে কি না, কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না। তবে ফারুক আর কালাচাঁদের খবর পাই না। প্রার্থনা করি, সৃষ্টিকর্তা তাঁদের সুখে রাখুন।
মাকে মনে পড়ে
আমার সব কিছুর পেছনে ছিলেন আমার মা। তিনি লেখাপড়া জানতেন না, কিন্তু চাইতেন আমি শিক্ষিত হই। খুব পরিশ্রমী ছিলেন মা। পরিশ্রম করার শিক্ষা আমি মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছি। আমি আজ প্রতিষ্ঠিত। আমার কোনো অভাব নেই এখন। দুঃখ শুধু, মা নেই!