পাথরকুচি থেকে বিদ্যুৎ
- লিডারশিপ ডেস্ক
নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন পন্থা বা উৎসের খোঁজ করছেন। ঠিক তেমনি দেশের বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ভিন্নধর্মী উদ্ভাবন ঘটিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও সৌরশক্তি গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ড. কামরুল আলম খান।
দেশের অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ এখনও বিদ্যুৎ সুবিধার বাইরে। কেরোসিনের কুপি আর সৌরবিদ্যুৎই তাদের একমাত্র ভরসা। আমাদের দেশে প্রাকৃতিক সম্পদের স্বল্পতা রয়েছে। একই সঙ্গে রয়েছে বিদ্যুতের সমস্যা। পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কেবল নির্দিষ্ট উৎসের ওপর নিভর্রশীল না হয়ে আমাদের উচিত বিকল্প শক্তির উৎস খুঁজে বের করা। আর এই বিকল্প শক্তির উৎসের কথা মাথায় রেখে ড. কামরুল আলম খান উদ্ভাবন করেছেন ভিন্নধর্মী এক উৎস_ পাথরকুচির পাতা থেকে বিদু্যুৎ উৎপাদন।
বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে কীভাবে স্বল্প খরচে, নবায়নযোগ্য পদ্ধতিতে ও নতুন কোনো উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় তা নিয়ে এক সময় ভাবতে শুরু করেন ড. কামরুল আলম খান। প্রাথমিক গবেষণায় তিনি তেঁতুল, লেবু, আলু, আম, কাঁঠাল, টমেটো, বটের পাতা দিয়েও পরীক্ষা চালান। পরিশেষে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কাঙ্ক্ষিত উপাদান পেয়ে যান পাথরকুচি পাতা থেকে।শুরুটা ২০০৮ সালে, এক ছাত্রকে দিয়ে মুন্সীগঞ্জ থেকে এক কেজি পাথরকুচি পাতা নিয়ে আসেন তিনি। এরপর শুরু হয় গবেষণা। কয়েক মাসের মধ্যেই আশানুরূপ ফল পেলেন। প্রথমে ১২ ভোল্টের ক্ষুদ্র আকৃতির বাতি জ্বালিয়ে তিনি আশার আলো দেখতে পান। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে শিল্প মন্ত্রণালয়ে এই উদ্ভাবনের মেধাস্বত্ব নিবন্ধন (প্যাটেন্ট) করেন তিনি। এরপর দীর্ঘ গবেষণার পর বর্তমানে বৈদ্যুতিক বাতি, পাখা, টেলিভিশনসহ বিভিন্ন ধরনের বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি চালাতে সক্ষম হচ্ছেন তিনি।
বাংলাদেশে পাথরকুচি পাতা নামে পরিচিত হলেও (বৈজ্ঞানিক নাম ইৎুড়ঢ়যরষষঁস বা ব্রায়োফাইলাম) বিভিন্ন দেশে এটি ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত। ভেষজ গুণের কারণে অনেকে পাথরকুচিকে ‘মিরাকল লিফ’ও বলেন। পেটের ব্যথা কমাতে দেশের অনেক অঞ্চলে এই পাতার ব্যবহার আছে।
পাথরকুচির পাতায় কী আছে, যা বিদ্যুৎ উৎপাদন করে? এমন প্রশ্নের উত্তরে কামরুল আলম খান বলেন, ‘পদার্থের মধ্যে এসিডিক (অম্লীয়) হাইড্রোজেন আয়ন ও ক্ষারীয় হাইড্রোক্সিল আয়ন থাকে। এসিডিক (অম্লীয়) হাইড্রোজেন আয়ন বেশি পরিমাণে থাকলে সেই পদার্থ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। পাথরকুচি পাতায় হাইড্রোজেন আয়নের পরিমাণ প্রায় ৭৮ শতাংশ, যা বিদ্যুৎ উৎপাদনে খুবই সহায়ক। পাথরকুচি পাতা থেকে তৈরি দ্রবণই বিদ্যুৎ তৈরির মূল উপাদান। পাথরকুচি পাতার মধ্যে এসিডিক (অম্লীয়) হাইড্রোজেন আয়ন থাকে। যে পদার্থে এসিডিক (অম্লীয়) হাইড্রোজেন আয়ন বেশি থাকে সেই পদার্থ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। পাথরকুচি পাতায় সাইট্রিক এসিড, আইয়োনো সাইট্রিক এসিড, মেলিক এসিড ও অন্য আরও কিছু অজানা জৈব এসিড রয়েছে। এ সবই দুর্বল জৈব এসিড। এই এসিড থেকে হাইড্রোজেন আয়নের নির্গমন খুবই ধীরগতিতে হয়। ফলে পাথরকুচি পাতার বিদ্যুতের স্থায়িত্বকাল বেশি, যা বিদ্যুৎ উৎপাদনে খুবই সহায়ক। পাথরকুচি পাতা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন পদ্ধতিও খুব সহজ। প্রথমে পাথরকুচি পাতা সংগ্রহ করে ব্লেন্ডার মেশিনে দিয়ে দ্রবণ তৈরি করে নিতে হবে। গবেষণার প্রথম পর্যায়ে দ্রবণে পাতা ও পানির পরিমাণ ৮ঃ১ রাখা হতো। কিন্তু পরে দ্রবণের এই অনুপাত পরিবর্তন করে পানির পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং দ্রবণকে ছেঁকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। ওই দ্রবণ প্লাস্টিকের পাত্রে, সাধারণত এ ক্ষেত্রে ব্যাটারির প্লাস্টিকের খোলস ব্যবহার করা হয়। সেই ব্যাটারির খোলসের ভেতরে পাতার দ্রবণ ঢেলে তার মধ্যে একটি তামা ও একটি দস্তার পাত ডুবিয়ে দেওয়া হয়। দ্রবণের সংস্পর্শে আসামাত্রই রাসায়নিক বিক্রিয়ার কারণে তামার পাতে ধনাত্মক ও দস্তার পাতে ঋণাত্মক পটেনসিয়াল সৃষ্টি করে। কারণ দ্রবণে রয়েছে বিদ্যুৎবাহী আয়ন। বিপরীতমুখী এই বিভবের দ্বারাই দুই পাতের মধ্যে বিভব পার্থক্য হয়। এতেই বিদ্যুৎ প্রবাহ সৃষ্টি হয়। বেশি বিদ্যুৎ পেতে হলে একাধিক তামা ও দস্তার পাত ঘন করে সমান্তরালভাবে বসাতে হবে। এই উৎপাদিত বিদ্যুৎকে ডিসি বিদ্যুৎ বলা হয়। এর সঙ্গে ইনভার্টার সংযোগ দিয়ে এসি বিদ্যুতে পরিণত করে সহজেই সব কাজে ব্যবহার করা যাবে এবং তা জাতীয় গ্রিডেও যোগ করা যাবে।
পাথরকুচি পাতার চাষ : পাথরকুচি পাতার চাষ বেশ সহজ। পাথরকুচির শুধু পাতা মাটিতে ফেলে রাখলেই সেখান থেকে গাছ জন্মায়। পতিত জমি, বাড়ির ছাদে, উঠানে, টবে, যে কোনো জায়গায় এই পাতার চাষ সম্ভব।
কামরুল আলম বলেন, ‘দেশের পতিত জমিতে সহজেই প্রচুর পাথরকুচি পাতার চাষ সম্ভব। আর চাষের এক মাসের মধ্যেই পাতা কাজে লাগানো যায়। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ তৈরি করতে এক মাসের মধ্যে নতুন করে পাথরকুচির দ্রবণের প্রয়োজন পড়ে না।
খরচ : কামরুল আলম বলেন, পাথরকুচি পাতা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হবে কম। এটা সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন খরচের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ।
সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি : এই প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বহনযোগ্য বৈদ্যুতিক পাখা তৈরি করেছেন কামরুল আলম। ১২ ভোল্টের এই বৈদ্যুতিক পাখা টানা এক মাস হাওয়া দিতে পারে। এক মাস পর শুধু দ্রবণ পাল্টে দিলেই পাখা আবার ঘুরবে। কামরুল আলম বলেন, দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় এলেও লোডশেডিংয়ে তারা বিপর্যস্ত। তিনি বলেন, পল্লী অঞ্চলে এ প্রযুক্তি সহজেই ব্যবহার করা সম্ভব হবে। প্রতিটি পরিবার নিজেদের প্রয়োজনের বিদ্যুৎ নিজেরা উৎপাদন করতে পারবে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর দ্রবণের বর্জ্য অন্য কাজেও ব্যবহার করা যাবে। পাথরকুচির বর্জ্য কোনো পাত্রে বদ্ধ অবস্থায় রাখলে তা থেকে মিথেন গ্যাস পাওয়া যায়। এই গ্যাস দিয়ে রান্না করা সম্ভব। গ্যাস উৎপাদনের পর বর্জ্য আবার জৈব সার হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে।
বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার শুরু না হলেও স্বল্প পরিসরে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন পেশাজীবীর মানুষ বিভিন্ন কাজে এর ব্যবহার করছেন। তিনি আশা করেন, সামনের দিনগুলোতে এর ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে। সরকারি-বেসরকারি আর্থিক সহায়তায় এর বিস্তর ব্যবহার সম্ভব।
অর্জন ও সাফল্য : ভিন্নধর্মী এই উদ্ভাবনের জন্য তিনি ইতিমধ্যে দেশে ও দেশের বাইরে অর্জন করেছেন অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা। তিনি পাথরকুচি পাতা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এইচএসবিসি উদ্যোক্তা পুরস্কার ২০০৯-১০-এর বাংলাদেশ পর্বে রৌপ্যপদক অর্জন করেন। ২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মৌলিক গবেষণার জন্য পদার্থবিজ্ঞানে রাজ্জাক-শামসুন গবেষণা বৃত্তি/পুরস্কার অর্জন, করেন। ২০১২ সালে আমেরিকার টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক এনভায়রনমেন্ট সাসটেইনেবিলিটির ওপর বেস্ট ইনোভেশনের জন্য টোমবার্গ পুরস্কার অর্জন করেন। এ ছাড়াও তিনি বিশ্বের অনেক দেশে নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই প্রজেক্ট নিয়ে প্রেজেন্টেশন দিয়েছেন। এ বছর ২৮ থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ওয়াশিংটন ডিসিতে আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটি আয়োজিত ইন্টারন্যশনাল কনফারেন্সে পেপার প্রেজেন্টেশনে অংশ নেবেন ড. কামরুল আলম খান।