সফলদের শুরুর গল্প
- লিডারশিপ ডেস্ক
বিশ্বের সব বিখ্যাত মানুষ সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মায়নি। এসব সফল মানুষের অনেকেরই জন্ম হয়েছে দরিদ্র পরিবারে। লড়তে হয়েছে অভাবের সঙ্গে, নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে। এদের অনেকেই কাজ করেছেন পরিচ্ছন্নতা কর্মী, কাঠুরিয়া, মুচি কিংবা মুদি দোকানদার হিসেবে। দিনযাপন করেছেন ফুটপাতে। কিন্তু শুরুটা যে কর্মেই হোক না কেন, তাদের ছিল লক্ষ্য আর দু’চোখে ছিল বড় হওয়ার স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন ও স্বপ্নের পথে অবিচল থাকার ক্ষমতাই তাদের সাফল্যের উচ্চশিখরে পৌঁছে দিয়েছে। তারা হয়েছেন অনুকরণীয় ব্যক্তি।
মার্কিন ধনকুবের অ্যান্ড্রু কার্নেগির কথাই ধরা যাক। তিনি তার সময়ের সবচেয়ে বড় ধনকুবের ছিলেন। কিন্তু একসময় তিনি ছিলেন বস্তির ছেলে। ১২ বছর যখন তার বয়স, তার পোশাক এত মলিন ও নোংরা ছিল যে, দারোয়ান তাকে পাবলিক পার্কে প্রবেশ করতে দেয়নি। তখন তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, একদিন তার টাকা হবে, সেদিন তিনি পার্কটি কিনে ফেলবেন। তিনি সে পার্কটি কিনেছিলেন। পার্কে নতুন একটি সাইনবোর্ড লাগিয়েছিলেন, যাতে লেখা ছিল_ আজ থেকে দিনে বা রাতে যে কোনো সময়ে যে কোনো মানুষ যে কোনো পোশাকে এই পার্কে প্রবেশ করতে পারবে। মৃত্যুর আগে তিনি তার সব সম্পদ জনহিতকর কাজে দান করে যান।
নোবেল পুরস্কারজয়ী আইরিশ নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ’মাত্র পাঁচ বছর স্কুলে লেখাপড়া করেছেন। দারিদ্র্যের কারণে মাত্র ১৫ বছর বয়সে স্বল্প বেতনে কেরানির কাজ নেন। কিন্তু তিনি লেখক হতে চেয়েছিলেন। এবং বিশ্বাস করতেন, একদিন তিনি একজন বড় লেখক হবেন। লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে তার ৯ বছর সময় লেগেছিল। তার বিশ্বাসই তাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। লেখক হিসেবেই পরবর্তী জীবনে উপার্জন করেছেন লাখ লাখ টাকা। তার চেয়েও বড় কথা, বিশ্বব্যাপী শাশ্বত কালের খ্যাতি তার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার।
দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী কিংবদন্তি নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাও তীব্র দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে ওঠেন। ম্যান্ডেলার বাবা যখন মারা যান, তখন তিনি ছিলেন নয় বছরের শিশু। এরপর মা ম্যান্ডেলাকে নিয়ে কুনু গ্রামে চলে আসেন। ক্ষুদ্র একটি কুটিরে বসবাস করতেন। কোনোরকমে শাকসবজি খেয়ে জীবনধারণ করতেন। তখন কে ভেবেছিল, এই ছোট্ট ছেলেটিই একদিন বিশ্বব্যাপী কিংবদন্তি হয়ে উঠবে।
ব্রাজিল একসময় ছিল দেনার ভারে নুয়ে পড়া দেশ। লুলা ডি সিলভা সে দেশের প্রেসিডেন্ট হয়ে দেশের মানুষের ভাগ্যের চাকাকে ঘুরিয়ে দেন। কে ছিলেন এই লুলা? জন্ম ১৯৪৫ সালে। তিনি প্রথম পড়তে শেখেন ১০ বছর বয়সে। এরপর মাত্র চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। সাত বছর বয়সে বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এরপর সংসারের আয়-রোজগারের দায়িত্ব পড়ে তার ওপর। বন্ধুরা যখন স্কুলে, ১৪ বছরের কিশোর লুলা ডি সিলভা তখন রাস্তার মোড়ে বসে আছেন রঙ-পলিশ নিয়ে। পথচারীর জুতা পলিশ করতেন তিনি। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা ডি সিলভা সেদিন ছিলেন রাস্তার মুচি! পরে কাজ করেন লেদ ফ্যাক্টরিতে।
একদিন কাজ করতে গিয়ে তার বাঁ হাতের কড়ে আঙুলের অর্ধেকাংশ কেটে গেল। কাটা আঙুল নিয়ে দৌড়ে গেলেন পাশের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার জন্য। ঝরঝর করে রক্ত ঝরছে। কিন্তু বিনা পয়সায় তো আর চিকিৎসা হয় না! এ ঘটনা তাকে প্রচন্ড রকম নাড়া দেয়। শ্রমিকদের নিয়ে সংঘ গড়ে তোলেন। পরে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন তিনি। প্রাইমারি স্কুল ডিঙানোর সৌভাগ্য না হলেও ব্রাজিলের মতো একটি বৃহৎ দেশের সফল প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্যতা তিনি দেখিয়েছেন।
জাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট মাইকেল সাটা। পরিচ্ছন্নতা কর্মী বা সুইপার বলে যাদের অভিহিত করা হয়, সাটা ছিলেন তাদেরই একজন। লন্ডনের ভিক্টোরিয়া স্টেশনে অন্যসব পরিচ্ছন্নতা কর্মীর মতো তিনিও ঝাড়া-মোছার কাজ করতেন। পরে কাজ করেছেন কুলি হিসেবে। কাজের ফাঁকে খন্ড কালীন পড়াশোনাও করেছেন। সুইপারের কাজ করলেও মাইকেল সাটারের চোখে ছিল বড় হওয়ার স্বপ্ন। সেই মাইকেল সাটা জাম্বিয়ার সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। একজন ঝাড়ূদার নিজের যোগ্যতায় দেশের সর্বোচ্চ পদে পৌঁছেছেন।
বিশ্ব ইতিহাসের আরেক নায়ক স্তালিন ছিলেন সামান্য এক মুচির ছেলে। বড় হয়েছেন অত্যন্ত দারিদ্র্যের মধ্যে। ১৮৮৮ সালে গোরি শহরে একটা চার্চ স্কুলে লেখাপড়া শুরু করেন। ১৮৯৪ সালে টিফিলিস যাজক প্রশিক্ষণ কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু ১৮৯৯ সালে নাশকতামূলক ধ্যান-ধারণা প্রচার করার দায়ে কলেজ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। কলেজ থেকে বের করে দেওয়ার পর স্তালিন আশপাশের এলাকার মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুদের পড়াতে শুরু করেন। এ সময় রাশিয়ার সাধারণ শ্রমজীবী মানুষকে বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত করতে শুরু করেন।
ভিয়েতনামের নেতা হো চি মিন একসময় বাসন মাজার কাজও করতেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন প্রথম জীবনে ছিলেন কাঠুরিয়া। অসামান্য মেধা ও কর্তব্যপরায়ণতা তাকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে উন্নীত করে। মার্কিনিদের মতে, লিংকন শুধু প্রেসিডেন্টই নন, এক আদর্শেরও নাম। নয়া চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও সে তুং ছিলেন গরিব মুদি দোকানির ছেলে। সীমাহীন দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হয়েছেন এই বিপ্লবী নেতা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দিক থেকেও তিনি ছিলেন পিছিয়ে। স্কুল পর্যন্ত পড়াশোনা করেই তাকে ক্ষান্ত দিতে হয়েছে। কিন্তু রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব ও দর্শনশাস্ত্রের ক্ষেত্রে মাওয়ের কৃতিত্ব তার সমালোচকরাও স্বীকার করেন। মাওয়ের এ শ্রেষ্ঠত্ব পৈতৃক পরিচয়ের সূত্রে আসেনি। অর্জিত হয়েছে নিজের কৃতিত্ব ও অধ্যবসায়ের গুণে।
কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকার মুক্তি আন্দোলনের এক মহান নাম শ্যাম নাজোমা। স্বাধীন নামিবিয়ার রাষ্ট্রপিতা ও প্রেসিডেন্ট নাজোমা একসময় ছিলেন সামান্য নাপিত। সেলুনে চুল-দাড়ি কাটতে কেউ এলে তিনি তাদের সঙ্গে কীভাবে দেশের স্বাধীনতা অর্জন করা যায়, এ নিয়ে মতবিনিময় করতেন। অবশেষে একদিন সেলুন ফেলে দেশের কাজে নেমে পড়েন। গড়ে তোলেন রাজনৈতিক দল। সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামও শুরু হয় তার নেতৃত্বে। অবশেষে আসে স্বাধীনতা।
একসময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না। এই ব্রিটেনেরই সাবেক প্রধানমন্ত্রী জন মেজর। বাবা ছিলেন সার্কাস দলের সামান্য কর্মী। অর্থাভাবে অষ্টম শ্রেণীর বেশি পড়াশোনা করতে পারেননি। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি বাসের কন্ডাক্টর হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু অঙ্কে কাঁচা এ যুক্তিতে চাকরি হয়নি। পরে এই জন মেজরই ব্রিটেনের অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী হন। যে যুবকটি অঙ্কে পারদর্শী নয় বলে বাসের কন্ডাক্টর হতে পারেনি, পরবর্তী সময়ে তিনিই ব্রিটেনের মতো দেশে অর্থনীতির হাল ধরেন।
এ পি জে আবদুল কালাম ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও পরমাণু কর্মসূচির জনক, তিনি ছিলেন গরিব ঘরের সন্তান। তার বাবা ছিলেন একজন মাঝি। কিন্তু দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী হয়েছেন তিনি। বিখ্যাত গায়ক বন জোভি প্রথম জীবনে বাড়িঘর সাজানোর ডেকোরেটরের কাজ করতেন। এই ডেকোরেটরের কাজ করতে করতেই গানের চর্চা করতেন তিনি। স্বপ্ন দেখতেন গায়ক হওয়ার। হলিউড অভিনেতা ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো খ্যাত জনি ডেপ হকার ছিলেন। ছোটবেলায় রাস্তায় রাস্তায় বলপয়েন্ট কলম বিক্রি করতেন। ফুটপাত ছিল তার আশ্রয়স্থল।
বিশ্বখ্যাত বিপণন কর্মকর্তা সুজে ওরম্যান তার গৃহহীন অবস্থায় ভ্যানে করে রাত কাটাতেন। বর্তমানে তিনি প্রায় ২৫ মিলিয়ন ডলারের মালিক। জেমস বন্ড তারকা ড্যানিয়েল ক্রেইগ যখন অভিনেতা হওয়ার যুদ্ধে নেমেছিলেন, তখন কোনো স্থায়ী ঠিকানা ছিল না তার। রাত কাটাতেন পার্কের বেঞ্চে শুয়ে শুয়ে। গায়ক এলভিস প্রিসলি প্রথম জীবনে ট্রাক চালাতেন। ফোর্ড মোটরের মালিক হেনরি ফোর্ড ঠিকভাবে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেননি, তবুও তিনি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গাড়ি কোম্পানির মালিক হতে পেরেছিলেন। সে চেষ্টায়ও প্রথমবারের মতো সফল হননি তিনি। গাড়ির ব্যবসায় নেমে প্রথম পাঁচ দফায় প্রায় ফতুর হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু হাল ছাড়েননি।
বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী নারী অপরাহ উইনফ্রে। জন্ম মিসিসিপির এক কুমারী মায়ের ঘরে। বাবা নরসুন্দর এবং মা গৃহপরিচারিকা ছিলেন। তার শৈশবজীবন ছিল খুবই দারিদ্র্য ও যন্ত্রণাদায়ক। স্কুলে পড়াকালীন সান্ধ্যকালীন খবরের উপস্থাপিকা হিসেবে টেনিসি রাজ্যের স্থানীয় একটি রেডিও স্টেশনে চাকরি পান। পরে তাকে দিবাকালীন টক শো এএম শিকাগো উপস্থাপন করতে দেওয়া হয়।
শিকাগোর এ তৃতীয় সারির টক শোটি তার হাত ধরে প্রথম সারিতে জায়গা করে নেয়। বর্তমানে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে দামি উপস্থাপক। তিনি বছরে প্রায় ২৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেন। তিনিই বিশ্বের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ বিলিয়নেয়ার। কিছু না বলেই যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন বিশ্বকে হাসিতে মাতিয়ে রেখেছিলেন চার্লি চ্যাপলিন। চলচ্চিত্রের নির্বাক যুগের এই কিংবদন্তি অভিনেতা শৈশবে ছিলেন খুই বিষণ্ন। তার জীবন ছিল দুঃখক্লিষ্ট। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘আমি বৃষ্টিতে হাঁটতে ভালোবাসি, কারণ তখন কেউ আমার কান্না দেখতে পায় না।
হ্যারি হুডিনির নাম কে না জানে। এই জাদুকর যেন জাদু দিয়েই পাল্টে দিয়েছেন নিজের জীবন। ১২ বছর বয়সে কাজের খোঁজে ঘর ছাড়তে হয় তাকে। যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন থেকে মিসৌরি, অবশেষে নিউইয়র্কে আসেন তিনি। দুই বছর তাকে ফুটপাতে থাকতে হয়েছে। হলিউডের অস্কার বিজয়ী অভিনেত্রী হ্যালি বেরি। প্রথম দিকে তিনি গৃহহীন ছিলেন। কেউ তাকে কাজ দিতে চাইত না। তারকা সঙ্গীতশিল্পী জেনিফার লোপেজ ও রিহান্না দু’জনেই ছিলেন গৃহহীন।
শৈশবে কত রঙের স্বপ্ন দেখি আমরা। এটা হবো, ওটা করব- আকাশ ছুঁয়ে দেব! কিন্তু বড় হতে হতে বাস্তবের হাত গলে কবে, কখন সেসব স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে যায়, তার হদিস অনেকেই রাখি না। আমরা যারা নিয়তিবাদী, তারা নিছক কপালের দোষে সেসব ঘটে বলাতেই স্বস্তি খুঁজি; শান্তি পেতে চাই। নিয়তিবাদীমাত্রই পলায়নপর। কিন্তু নিয়তিকে কাঁচকলা দেখিয়ে নিজের ভাগ্য নিজেই গড়ে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়ে যে বা যারা ‘নেভার সে নেভার’ বলে এগিয়ে যেতে পারে, শেষ বাজিতে জিতটা তাদেরই হয়।