গাজীর গর্জন গাজীর অর্জন
বিজয় মানে সাফল্য, বিজয় মানে অর্জন। বাংলাদেশের ৪৪তম বিজয় দিবসে আমরা এমন এক কীর্তিমানের গল্প শুনবো যিনি একাত্তরে ছিনিয়ে এনছিলেন বিজয়, অর্জন করেছেন বীর প্রতীক খেতাব। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তিনি এক সফল ব্যবসায়ী। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্তৃত প্রকাশিত ২০১৫ সালের শীর্ষ ধনী বাংলাদেশির তালিকায় রয়েছে তাঁর নাম। এনবিআর বলছে, তাঁর নিট সম্পদের পরিমাণ ১০৫ কোটি টাকা। তিনি গাজী গ্রুপের কর্ণধার-গোলাম দস্তগীর গাজী। তাঁর সাফল্যের গল্প শোনাচ্ছেন মারুফ ইসলাম।
উনিশশো একাত্তর সালে গর্জে উঠেছিলেন গোলাম দস্তগীর গাজী। তাঁর গর্জনে কেঁপে উঠেছিল ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকা। বেশ ক’টি সফল অপারেশনের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। তাঁর কারণেই ওইসব এলাকা থেকে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল পাকসেনারা। তখন গাজীর বয়স কত? বাইশ বছর। টগবগে এক যুবক তিনি। আপন অন্তরে কান পেতে শুনতে পেলেন সেই অমোঘ আহ্বান-এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।
শ্রেষ্ঠ সময়কে কাজে লাগাবেন বলে মনস্থির করলেন তরুণ গাজী। সে রাতে চাঁদ ছিল না। অন্ধকারে পা বাড়ানোর আগে দুই লাইনের এক চিরকুট লিখলেন মায়ের কাছে ‘মা, আমি মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছি, বেঁচে থাকলে দেখা হবে’ আর নিজের মনকে বললেন, এ অন্ধকার চিরস্থায়ী হবে না। ভোর হবেই। আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?
সকাল আনতে বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি। ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ফিরে এসে ঢাকার রামপুরায় বেশ ক’টি সফল অপারেশন পরিচালনা করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য অপারেশনের মধ্যে রয়েছে গ্যানিজ ও দাউদ পেট্রল পাম্প উড়িয়ে দেওয়া। এসব বীরত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাঁকে দিয়েছে ‘বীর প্রতীক’ উপাধী।
‘আশাবাদী হও। প্রায় পনের কোটি ভোক্তা যে দেশে রয়েছে সেখানে ব্যবসা বা ক্যারিয়ার গড়ে তোলা কোনো সমস্যা নয়। বিশেষ করে ফুড, রিয়েল স্টেট, টেক্সটাইল এবং হেলথ সেক্টর আগামীতে আরো শক্তিশালী হবে’।
বাইশ বছর বয়সে গোলাম দস্তগীর গাজী যখন যুদ্ধে যান, তখন তিনি বিএসসি পাস করে ল’ কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। ফিরে এসে আর পড়া হয়নি। ভাবলেন ব্যবসা করবেন। কিন্তু ব্যবসা করতে চাই বিদ্যুৎ, চাই অবকাঠামো। অথচ নিজের হাতেই পাওয়ার স্টেশন, ব্রীজসহ তাঁর সেক্টরের (তিনি যুদ্ধ করেছেন ২ নম্বর সেক্টরে) সমস্ত অবকাঠামো ধূলোর সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের আগে এদেশে প্রায় সব ব্যবসীয়ই ছিল পাকিস্তানী এবং বিহারী। বাঙালিরা নামেমাত্র, তাও ছোটখাটো ব্যবসায়। পাকিস্তানী আর বিহারীরা তাদের ব্যবসা ফেলে পালিয়ে গেলে দেখা দিল শূণ্যতা। এরকম সময়ে তিনি শুরু করলেন ট্রেডিং-এর ব্যবসা। বাবার কাপড়ের দোকান ছিল, তিনি তা বিক্রি করে ৭০ হাজার টাকা তুলে দিলেন ছেলের হাতে। ১৯৭৪ সালে ৭০ হাজার টাকা দিয়েই পুরান ঢাকায় তিনি একটি কারখানা স্থাপন করলেন। হাওয়াই চপ্পল তৈরি করতে শুরু করলেন সে কারখানায়। ধীরে ধীরে তাঁর লাভের অংক যেমন বাড়তে থাকলো, তেমনি বাড়তে থাকল কারখানার পরিধি।
একই বছর করলেন বাইসাইকেলের টায়ার তৈরির প্রতিষ্ঠান। ‘গাজী টায়ার’ এখন দেশব্যাপী এক জনপ্রিয় ব্যান্ড। এরপর ১৯৯৫ সালে প্লাস্টিক ট্যাংক-‘গাজী ট্যাংক’ বাজারে আনেন তিনি। ২০০২ সালে শুরু করেন ‘হটপট’-এর ব্যবসায়। এদেশে এই তিন ব্যবসাতেই তিনি পথিকৃৎ।
শুধু গাজী ট্যাংক-ই প্রথম পাঁচ বছর মোটা অংকের লস দিয়েছিল। যে পণ্যের ধারণাই এদেশের ক্রেতার নেই সে পণ্য উৎপাদনের ব্যবসায় জড়ানোর ঝুঁকি তিনি কেন নিলেন। এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যদি যুদ্ধে যেতে পারি তবে ব্যবসা কেন করতে পারব না? বিশ্বাস ছিল, মানুষ একদিন আমার এ পণ্য কিনবেই’।
এরপর এসেছেন অটোমোবাইল টায়ার এবং ব্যাংকিং ব্যবসায়। যমুনা ব্যাংকের তিনি পরিচালক। এছাড়া তিনি ফেডারেশন অফ বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি-এর পরচিালক এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের ভাইস প্রেসিডেন্ট।
২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি নারায়ঙ্গঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসন থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে লড়াই করেন এবং বিজয়ী হন। এরপর ২০১৪ সালের ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
সফল মুক্তিযোদ্ধা ও সফল ব্যবসায়ী গোলাম দস্তগীর গাজীর জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৪ আগস্ট নারায়ণগঞ্জে। তাঁর বাবার নাম গোলাম কিবরিয়া গাজী এবং মায়ের নাম সামসুননেছা বেগম। তাঁর স্ত্রীর নাম হাসিনা গাজী। তাঁদের দুই ছেলে।
নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে এই কীর্তিমান বলেন, ‘আশাবাদী হও। প্রায় পনের কোটি ভোক্তা যে দেশে রয়েছে সেখানে ব্যবসা বা ক্যারিয়ার গড়ে তোলা কোনো সমস্যা নয়। বিশেষ করে ফুড, রিয়েল স্টেট, টেক্সটাইল এবং হেলথ সেক্টর আগামীতে আরো শক্তিশালী হবে’।
তথ্যঋণ : দৈনিক যায়যায়দিন, ১৭ ডিসেম্বর, ২০০৭। প্রথম আলো, ১৮ নভেম্বর, ২০১২। একাত্তরের বীরযোদ্ধা, খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা (দ্বিতীয় খন্ড)। প্রথমা প্রকাশন। পৃ: ২২৭ ও উইকিপিডিয়া।