সাদাসিধে ছেলেটির জাফর ইকবাল হয়ে ওঠা
ইচ্ছে করলে আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারতেন, বিলাসী জীবনযাপন করতে পারতেন, তা না করে দেশের মায়ায়-ভালোবাসায় দেশে পড়ে আছেন-মুহম্মদ জাফর ইকবার সম্পর্কে এ গল্প বেশ পুরোনো। তিনি এখন তুমুল জনপ্রিয় শিশু সাহিত্যিক ও সায়েন্স ফিকশন লেখক। শিশু-কিশোরদের মধ্যে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করতে নিরলসভাবে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। একজন সফল মানুষ, একজন সফল লেখক, একজন সফল শিক্ষক মুহম্মদ জাফর ইকবালের সাফল্যের গল্প শোনাচ্ছেন মারুফ ইসলাম।
২০০২ সালে বাংলাদেশের প্রথম সারির একটি দৈনিক ‘নতুন প্রজন্ম : বই এবং অন্যান্য’ শিরোনামে একটি জরিপ পরিচালনা করে। সেই জরিপে বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে যাঁর নাম উঠে আসে তিনি মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তিনি দেশব্যাপী শিশু সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত হলেও তাঁর আরও কয়েকটি পরিচয় রয়েছে। তিনি একাধারে একজন পদার্থবিদ, কম্পিউটার বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ এবং কলাম লেখক। ‘সাদাসিধে কথা’ নামে শিক্ষা, মুক্তিযুদ্ধ, তরুণ প্রজন্ম ও সমসাময়িক বিষয় নিয়ে তাঁর লেখা কলামগুলো ব্যাপক পাঠকপ্রিয়। বলা হয়ে থাকে তিনি বাংলাদেশে বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখা ও জনপ্রিয়করণে একজন পথিকৃৎ ব্যাক্তিত্ব। তার লেখা বেশ কয়েকটি উপন্যাস চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে। এদের মধ্যে দিপু নাম্বার টু ও আমার বন্ধু রাশেদ উল্লেখযোগ্য। জাফর ইকবাল বর্তমানে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং তড়িৎ কৌশল বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
এই সিলেটেই মুহম্মদ জাফর ইকবারের জন্ম ১৯৫২ সালের ২৩ ডিসেম্বর। বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ফয়জুর রহমান আহমদ এবং মা আয়েশা আখতার খাতুন। বাবা পুলিশে চাকরি করতেন, তাই তার ছেলেবেলা কেটেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায়। পড়ালেখাও করেছেন দেশের বিভিন্ন স্কুলে। অনেক স্কুল ঘুরে শেষে তিনি এসএসসি পাশ করেছেন বগুড়া জিলা স্কুল থেকে ১৯৬৮ সালে। তাঁর এই বহেমিয়ান কিশোরকাল অনেকটাই ধরা আছে দিপু নাম্বার টু উপন্যাসে। এরপর ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৭০ সালে এইচএসসি পাশ করেন। ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। এখান থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর ১৯৭৬ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। তাঁর পড়ার বিষয় ছিল – ‘Parity violation in Hydrogen Atom.। সেখানে পিএইচডি করার পর বিখ্যাত ক্যালটেক থেকে তিঁনি তাঁর পিএইচডি-পরবর্তী গবেষণা সম্পন্ন করেন।
শিক্ষাজীবনে মুহম্মদ জাফর ইকবা প্রখর মেধার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি ১৯৭৫ সালে স্নতকে মাত্র দুই নম্বরের ব্যবধানে প্রথম শ্রেণীতে ২য় স্থান অধিকার করেন। এরপর ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করে ১৯৮২ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়া ইনিস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে পিএচডি-পরবর্তী গবেষণা সম্পন্ন করেন। গবেষণা শেষে তিনি বিখ্যাত বেল কমিউনিকেশনস রিসার্চ (বেলকোর) প্রতিষ্ঠানে গবেষক হিসাবে যোগ দেন এবং ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত সেখানেই কাজ করেন। ওই বছরেই তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগ দেন।
তার প্রথম সায়েন্স-ফিকশন গল্প কপোট্রনিক ভালোবাসা সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়েছিল। গল্পটি পড়ে একজন পাঠক দাবি করেন সেটি বিদেশি গল্প থেকে চুরি করা। এর উত্তর হিসেবে তিনি একই ধরণের বেশ কয়েকটি গল্প বিচিত্রার পরপর কয়েকটি সংখ্যায় লিখে পাঠান। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে তার এই গল্পগুলো নিয়ে কপোট্রনিক সুখ-দুঃখ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। এই বই পড়ে শহীদ-জননী জাহানারা ইমাম খুবই প্রশংসা করেন।
লেখালেখির শুরুটা অবশ্য বেশ অল্প বয়সেই। পিতা লেখালেখির চর্চা করতেন এবং পরিবারের অন্য সদস্যরাও সাহিত্যমনস্ক আবহাওয়ায় জাফর ইকবাল খুব অল্প বয়স থেকেই লিখতে শুরু করেন। বড্ড সাদাসিধে জীবন ছিল তাঁর। বেশিরভাগ সময়ই চুপচাপ থাকতেন। ধীরে ধীরে এই সাধাসিধে মানুষটিই আজকের জাফল ইকবাল হয়ে ওঠলেন। পারিবারিক সাহিত্যিক আবহ ও নিজের অন্তরমুখী স্বভাবই তার সহজ ভাষায় লিখতে পারার কারণ বলে মনে করেন তিনি। এক সাক্ষাৎকারে জাফর ইকবাল বলেছেন, তিনি প্রথম বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখেন সাত বছর বয়সে। তখন তাঁর পারিবারিক নাম ছিল বাবুল। তবে পুরোপুরি লেখক হিসেবে তিনি আবিভূত হন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। তার প্রথম সায়েন্স-ফিকশন গল্প কপোট্রনিক ভালোবাসা সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়েছিল। গল্পটি পড়ে একজন পাঠক দাবি করেন সেটি বিদেশি গল্প থেকে চুরি করা। এর উত্তর হিসেবে তিনি একই ধরণের বেশ কয়েকটি গল্প বিচিত্রার পরপর কয়েকটি সংখ্যায় লিখে পাঠান। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে তার এই গল্পগুলো নিয়ে কপোট্রনিক সুখ-দুঃখ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। এই বই পড়ে শহীদ-জননী জাহানারা ইমাম খুবই প্রশংসা করেন।
লেখালেখির সুবাদে এ পর্যন্ত তিনি অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মননা পেয়েছেন। এসবের মধ্যে রয়েছে বাংলা একাডেমী পুরস্কার (২০০৪), শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে ২০০৫ সালে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার, কাজী মাহবুবুল্লা জেবুন্নেছা পদক (২০০২), খালেদা চৌধুরি সাহিত্য পদক বাংলা (১৪১০), শেলটেক সাহিত্য পদক (২০০৩), ইউরো শিশুসাহিত্য পদক (২০০৪), মার্কেন্টাইল ব্যাংক সম্মাননা পদক (২০০৫), আমেরিকা এল্যাইমনি এ্যসোসিয়েশন পদক (২০০৫), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ্যালাইমনি এ্যাসোসিয়েশন পদক (২০০৫)।
এক নজরে জাফর ইকবাল রচনাবলী :
উপন্যাস :
- আকাশ বাড়িয়ে দাও (১৯৮৭)
- বিবর্ণ তুষার (১৯৯৩)
- দুঃস্বপ্নের দ্বিতীয় প্রহর (১৯৯৪)
- কাচসমুদ্র(১৯৯৯)
- সবুজ ভেলভেট (২০০৩)
- ক্যাম্প (২০০৪)
- মহব্বত আলীর একদিন (২০০৬)
ছোট গল্প :
- একজন দুর্বল মানুষ-(১৯৯২)
- ক্যাম্প ( ? )
- ছেলেমানুষী-(১৯৯৩)
- নুরূল ও তার নোটবই-(১৯৯৬)
- মধ্যরাত্রিতে তিন দূর্ভাগা তরুণ-(২০০৪)
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী :
- কপোট্রনিক সুখ দুঃখ (১৯৭৬)
- মহাকাশে মহাত্রাস (১৯৭৭)
- ক্রুগো (১৯৮৮)
- ট্রাইটন একটি গ্রহের নাম (১৯৮৮)
- বিজ্ঞানী সফদর আলীর মহা মহা আবিস্কার (১৯৯২)
- ওমিক্রমিক রূপান্তর (১৯৯২)
- টুকুনজিল (১৯৯৩)
- যারা বায়োবট (১৯৯৩)
- নি:সঙ্গ গ্রহচারী (১৯৯৪)
- ক্রোমিয়াম অরণ্য (১৯৯৫)
- ত্রিনিত্রি রাশিমালা (১৯৯৫)
- নয় নয় শূন্য তিন (১৯৯৬)
- অনুরণ গোলক (১৯৯৬)
- টুকি ও ঝায়ের (প্রায়) দুঃসাহসিক অভিযান (১৯৯৭)
- পৃ (১৯৯৭)
- রবো নগরী (১৯৯৭)
- একজন অতিমানবী (১৯৯৮)
- সিস্টেম এডিফাস (১৯৯৮)
- মেতসিস (১৯৯৯)
- ইরন (২০০০)
- জলজ (২০০০)
- ফোবিয়ানের যাত্রী (২০০১)
- প্রজেক্ট নেবুলা (২০০১)
- ত্রাতুলের জগৎ (২০০২)
- বেজি (২০০২)
- শাহনাজ ও ক্যাপ্টেন ডাবলু (২০০৩)
- সায়রা সায়েন্টিস্ট (২০০৩)
- ফিনিক্স (২০০৩)
- সুহানের স্বপ্ন (২০০৪)
- অবনীল (২০০৪)
- নায়ীরা (২০০৫)
- বিজ্ঞানী অনিক লুম্বা (২০০৫)
- রুহান রুহান (২০০৬)
- জলমানব (২০০৭)
- অন্ধকারের গ্রহ (২০০৮)
- অক্টোপাসের চোখ (২০০৯)
- ইকারাস (২০০৯)
- রবোনিশি (২০১০)
- প্রডিজি (২০১১)
- কেপলার টুটুবি (২০১২)
- ব্ল্যাক হোলের বাচ্চা (২০১৩)
- এনিম্যান (২০১৪)
- সেরিনা(২০১৫)
কিশোর উপন্যাস :
- হাতকাটা রবিন-(১৯৭৬)
- দীপু নাম্বার টু (উপন্যাস)-(১৯৮৪) (চলচ্চিত্র রূপ, ১৯৯৬)
- দুষ্টু ছেলের দল-(১৯৮৬)
- আমার বন্ধু রাশেদ-(১৯৯৪) (চলচ্চিত্র রূপ, ২০১১)
- টি-রেক্সের সন্ধানে-(১৯৯৪)
- স্কুলের নাম পথচারী-(১৯৯৫)
- জারুল চৌধুরীর মানিকজোড়-(১৯৯৫)
- রাজু ও আগুনালির ভুত-(১৯৯৬)
- বকুলাপ্পু-(১৯৯৭)
- বুবুনের বাবা-(১৯৯৮)
- বাচ্চা ভয়ংকর কাচ্চা ভয়ংকর-(১৯৯৮)
- নিতু ও তার বন্ধুরা-(১৯৯৯)
- মেকু কাহিনী-(২০০০)
- শান্তা পরিবার-(২০০২)
- কাজলের দিনরাত্রি-(২০০২)
- কাবিল কোহকাফী-(২০০৩)
- দস্যি ক’জন-(২০০৪)
- আমি তপু-(২০০৫)
- লিটু বৃত্তান্ত-(২০০৬)
- লাবু এল শহরে-(২০০৭)
- বৃষ্টির ঠিকানা-(২০০৭)
- নাট বল্টু-(২০০৮)
- মেয়েটির নাম নারীনা-(২০০৯)
- রাশা-(২০১০)
- আঁখি এবং আমরা ক’জন-(২০১১)
- দলের নাম ব্ল্যাক ড্রাগন-(২০১১)
- রাতুলের রাত রাতুলের দিন-(২০১২)
- রূপ-রূপালী-(২০১২)
- ইস্টিশন-(২০১৩)
- গাব্বু-(২০১৩)
- টুনটুনি ও ছোটচাচ্চু-(২০১৪)
কিশোর গল্প :
- আমড়া ও ক্র্যাব নেবুলা-(১৯৯৬)
- আধুনিক ঈশপের গল্প-(১৯৯৬)
- তিন্নি ও বন্যা-(১৯৯৮)
শিশুতোষ :
- বুগাবুগা-(২০০১)
- সাগরের যত খেলনা-(২০০২)
- রতন-(২০০৮)
- ঘাস ফড়িং-(২০০৮)
- হাকাহাকি ডাকাডাকি-(২০০৮)
- ভূতের বাচ্চা কটকটি-(২০১১)
ভ্রমণ ও স্মৃতিচারণ :
- আমেরিকা-(১৯৯৭)
- সঙ্গি সাথী পশু পাখি-(১৯৯৩)
- আধ ডজন স্কুল-(১৯৯৬)
- তোমাদের প্রশ্ন আমার উত্তর-(২০০৪)
- রঙিন চশমা-(২০০৭)
- আরো প্রশ্ন আরো উত্তর-(২০১২)
বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ক :
- দেখা আলো না দেখা রূপ-(১৯৮৬)
- বিজ্ঞানের একশ মজার খেলা-(১৯৯৪)
- নিউরণে অনুরণন-(২০০২)
- নিউরণে আবারো অনুরণন-(২০০৩)
- গনিত এবং আরও গণিত-(২০০৩)
- আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড: প্রশ্ন ও উত্তর-(২০০৪)
- একটু খানি বিজ্ঞান-(২০০৭)
- গণিতের মজা মজার গণিত-(২০০৭)
- থিওরি অফ রিলেটিভিটি-(২০০৮)
- কোয়ান্টাম মেকানিক্স-(২০০৯)
- আরো একটু খানি বিজ্ঞান-(২০১০)
কলাম সংকলন :
- দেশের বাইরে দেশ-(১৯৯৩)
- সাদাসিধে কথা-(১৯৯৫)
- নিঃসঙ্গ বচন-(১৯৯৮)
- প্রিয় গগন ও অন্যান্য-(১৯৯৯)
- হিমঘরে ঘুম ও অন্যান্য-(২০০০)
- পৃথিবীর সৌন্দর্য এবং আলফ্রেড সরেন-(২০০১)
- ২০৩০ সালের একদিন ও অন্যান্য-(২০০২)
- দুঃস্বপ্নের রাত এবং দুর্ভাবনার দিন-(২০০৩)
- এখনো স্বপ্ন দেখায়-(২০০৪)
- ক্রসফায়ার এবং অন্যান্য-(২০০৫)
- আরো একটি বিজয় চাই-(২০০৬)
- ভবদহের গল্প এবং অন্যান্য-(২০০৭)
- বৈশাখের হাহাকার ও অন্যান্য-(২০০৮)
- স্বপ্নের দেশ ও অন্যান্য-(২০০৯)
- ঢাকা নামের শহর ও অন্যান্য-(২০১০)
- এক টুকরো লাল সবুজ কাপড়-(২০১১)
- বদনখানি মলিন হলে-(২০১২)
- রাজনীতি নিয়ে ভাবনা ও অন্যান্য-(২০১৩)
ভৌতিক সাহিত্য :
- প্রেত-(১৯৮৩)
- পিশাচিনী-(১৯৯২)
- নিশিকন্যা-(২০০৩)
- ছায়ালীন-(২০০৬)
- ও-(২০০৮)
- দানব-(২০০৯)
টিভি নাটক :
- গেস্ট হাউস
- ঘাস ফড়িঙের স্বপ্ন
- শান্তা পরিবার
- একটি সুন্দর সকাল
- লিরিক
রেডিও নাটক :
- শুকনো ফুল রঙ্গিন ফুল, (২০১১)। সহায়তায় ইউনিসেফ