উদ্যোক্তা হতে কী ডিগ্রি লাগে ?
তিনা বোডেন একজন সফল উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী। অনুপ্রেরণাদায়ী বক্তা এবং লেখক হিসেবেও রয়েছে তাঁর সুখ্যাতি। তিনা অবশ্য নিজেকে ‘যুক্তরাজ্যের তৃতীয় প্রজন্মের নবীন কণ্ঠস্বর’ হিসেবে পরিচয় দিতে বেশি পছন্দ করেন। তাঁর সাফল্যের গল্প শোনাচ্ছেন মারুফ ইসলাম।
তিনা বোডেনকে নাকি প্রায়ই একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। ‘উদ্যোক্তা হতে হলে কী বিশ্ববিদ্যালয় পাশ হতে হয়?’ ভারি জ্বালা! এই এক প্রশ্নের উত্তর আর কত দেওয়া যায়। তিনা এবার তাই একটি ব্লগ লিখে ফেলেছেন। তাঁর ভাষ্যমতে, তিনি তথাকথিত কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেননি। তারপরই প্রশ্নকর্তার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘আমি কি উদ্যেক্তা হিসেবে সফল হইনি?’
উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রির প্রয়োজন নেই-এ কথাই বলতে চেয়েছেন তিনা তার ব্লগে। কেন প্রয়োজন নেই তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বারবার উঠে এসেছে তার সফল হওয়ার কাহিনী। তিনা লিখেছেন, ‘চলুন ফিরে যাওয়া যাক আশির দশকে। তখন আমি একটি কারিগরি কলেজের শিক্ষার্থী। হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করি। আমার তখন লক্ষ্য একটাই-যেকোনো উপায়ে পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হবে।’
ঠিক এই সময়েই তিনার বাবা একটি ছোট ব্যবসা শুরু করেন। তাকে সাহায্য করার আর কেউ ছিল না একমাত্র তিনার মা ছাড়া। তিনা সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি মা-বাবাকে সাহায্য করবেন। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির চেয়ে বাবার ব্যবসাকে দাঁড় করানো বেশি জরুরি। অতএব আর দেরি কেন, এখনই ফিরে যাওয়া যাক মা-বাবার ডেরায়। ‘যথা সিদ্ধান্ত তথা বাস্তবায়ন’ মনে মনে জপ করতে করতে এমা ও অ্যানির (হোস্টেলে তিনার সবচেয়ে কাছের বন্ধু)কাছ থেকে চোখ মুছতে মুছতে বিদায় নেন তিনা। আর কখনো ফিরে যাননি সেই কলেজ হোস্টেলে।
বাবার ব্যাবসা দাঁড় করাতে রাতদিন পরিশ্রম শুরু করেন তিনা। ঠিক এরকম সময়ে, যখন তাঁর বয়স একুশ, তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ততদিনে বাবার ব্যবসা মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছে। তিনা চান এবার নিজেই কিছু করতে। সেই চাওয়াকে পূর্ণতা দিতে কিনে ফেলেন একটি ‘প্রপার্টি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি’, বাংলায় যাকে বলা যেতে পারে সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা সংস্থা। কিন্তু বাধ সাধে স্বামীর পরিবার। তারা চায় না তিনা কিছু করুক। এই দ্বন্দ্বের ভেতরেই পেরিয়ে যায় আরও কতগুলো বছর। তিনার কোলজুড়ে আসে একটি ফুটফুটে ছেলে সন্তান। শ্বশুর বাড়ির লোকেরা ভাবল, এবার নিশ্চয় স্বপ্নের পিছু ছোটা বন্ধ হবে তিনার। কিন্তু তিনার অভিধানে তো ‘পরাজয়’ বলে কোনো শব্দ নেই। তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে তালাকনামা পাঠিয়ে দেন স্বামীর ঠিকানায়।
‘যখন আমার হাতে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপত্র আসে তখন আমি রীতিমতো এক সফল ব্যবসায়ী। এখন আমি ইফিসিয়ন্সি অ্যাঞ্জেলের প্রতিষ্ঠাতা এবং এন্টারপ্রাইজ রকার্সের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কাজ করছি বিজনেস অ্যাডভাইসরি ব্যুরোতে। এসব অর্জনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির জন্য অপেক্ষা করতে হয়নি।’
ছোট্ট শিশু সন্তানকে নিয়ে তারপর শুরু হয় তিনার নতুন সংগ্রাম। একদিকে সন্তান প্রতিপালন অন্যদিকে ব্যবসা দাঁড় করানো। উদয়াস্ত পরিশ্রম, তবু হার মানতে নারাজ। সময় পেরিয়ে যায়, ছেলে বড় হতে থাকে একটু একটু করে। চার বছর বয়স যখন ছেলের তখন একদিন সে হুট করে প্রশ্ন করে বসে, ‘তুমি কেন পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিলে মা?’
এরপর তিনা তার ব্লগে লিখেছেন, ‘এই এক প্রশ্নই আমাকে দাঁড় করিয়ে দেয় আরেক সত্যের সামনে। আমি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হয়ে আমি কি ভুল করেছি? একটা বিশ্বদ্যিালয়ের ডিগ্রি থাকলে আমি কী আরও ভালো করতাম? ওই মধ্য-কুড়ি বয়সে এই প্রশ্নগুলো আমাকে খুব ভুগিয়েছে। এখন অবশ্য আমি জানি, জীবনে সফল হওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি মোটেও কাজে লাগে না। এখন আমার প্রতিষ্ঠানে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়-গ্রাজুয়েট চাকরি করেন, তাদেরকে আমি কাজ শেখাই।’
চল্লিশ বছর বয়সে তিনা আবার বিয়ে করেন। দ্বিতীয় স্বামীর কল্যাণে তিনার কোলজুড়ে আসে আরও একটি সন্তান। শুরু হয় তাঁর জীবন সংগ্রামের দ্বিতীয় অধ্যায়। এই দুই কুড়ি বছর বয়সী জীবনে তিনাকে সবচেয়ে বেশি যে তীর বিদ্ধ করেছে সেটি হচ্ছে, তোমার তো কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। তুমি তো বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করতে পারোনি। তিনা তাই সিদ্ধান্ত নেন, এই কলঙ্ক মোচন করবেন তিনি। সিদ্ধান্ত মোতাবেক ব্যবসায় প্রশাসন বিষয়ে ভর্তি হন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে। ‘সে ছিল এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা’-লিখেছেন তিনা বোডেন।
তিনার এখন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি আছে। তবে এই ডিগ্রি তাঁর উদ্যেক্তা হওয়ার পূর্ব শর্ত ছিল না। এই ডিগ্রি তাঁর সফল ব্যবসায়ী কিংবা সফল লেখক হওয়ারও পূর্ব শর্ত ছিল না। তিনা লিখেছেন, ‘যখন আমার হাতে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপত্র আসে তখন আমি রীতিমতো এক সফল ব্যবসায়ী। এখন আমি ইফিসিয়ন্সি অ্যাঞ্জেলের প্রতিষ্ঠাতা এবং এন্টারপ্রাইজ রকার্সের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কাজ করছি বিজনেস অ্যাডভাইসরি ব্যুরোতে। এসব অর্জনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির জন্য অপেক্ষা করতে হয়নি।’
‘এখন বলি, কীভাবে আমি সফল হলাম।’ এই বাক্য লেখার পর তিনা বোডেন লিখেছেন, ‘একই সঙ্গে আমাকে একজন মা, একজন স্ত্রী এবং একজন শিক্ষার্থীর জীবনযাপন করতে হয়েছে। আমাকে সময়মতো বাচ্চাকে খাওয়াতে হয়েছে, সময়মতো সংসারের অন্যান্য কাজ করতে হযেছে, আবার সময়মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসাইমেন্ট জমা দিতে হয়ছে। অর্থাৎ আপনারা বুঝতেই পারছেন, সময়ের কাজ সময়মতো করতে পারা আমার সফল হওয়ার অনুঘটক। আমি এখন দৃঢ় গলায় সবখানে বলতে পারি, সময়ের কাজ সময়ে করলেই সফল হওয়া যায়।’
তথ্যসূত্র : স্মলবিজনেস, লিংকড ইন এবং তিনা বোডেনের নিজস্ব ওয়েবসাইট অবলম্বনে