ব্রাজিলের ব্যবসা গুরু
প্রতিষ্ঠান পরিচালন পদ্ধতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে বিশ্ব্যবাপী আলোচিত হয়েছেন রিকার্ডো সেমলার। তাঁর পদ্ধতি দুনিয়াজুড়ে পরিচিতি পেয়েছে ‘সেমলার ওয়ে’ নামে। তিনি ব্রাজিলের শীর্ষ ধনী এবং ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় জয়েন্ট ভেঞ্চার প্রতিষ্ঠান সেমকো পার্টনার্সের সিইও। তাঁর প্রতিষ্ঠান বছরে চার মিলিয়ন ডলার রাজস্ব দেয় ব্রাজিল সরকারকে। এছাড়া একজন লেখক হিসেবেও তিনি সমান জনপ্রিয়। রিকার্ডো রচিত বই টার্নিং ইওর ওন টেবিল ব্রাজিলের ইতিহাসে সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। তাঁর আরও একটি বই দ্য সেভেন ডে উইকেনড আন্তর্জাতিকভাবে বেস্ট সেলার হয়েছে। রিকার্ডো সেমলারের সাফল্যের গল্প শোনাচ্ছেন মারুফ ইসলাম।
ব্যাগের ভিতর বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ ডিগ্রি, চাইলেই যেকোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেওয়া যায়, কিন্তু সে পথে একটুও পা না বাড়িয়ে সোজা বাবার প্রতিষ্ঠানেই যোগ দিয়েছিলেন রিকার্ডো সেমলার। বাবা এন্টোনিও সেমলারের বুক থেকে সেদিন নির্ঘাত একটি দুশ্চিন্তার পাথর নেমে গিয়েছিল এই ভেবে-‘যাক! ছেলের হাতে সমস্ত দায়িত্ব বুঝে দিয়ে এবার আরাম করে অবসর যাপন করা যাবে! বয়স তো আর কম হলো না!’
কিন্তু এন্টোনিওর আশার গুড়ে বালি পড়তে বেশি দিন সময় লাগল না। প্রথম দিনেই অঘটন ঘটিয়ে ফেললেন একুশ বছর বয়সী তরুণ সিইও রিকার্ডো। প্রতিষ্ঠানের ৬০ শতাংশ উর্দ্ধতন কর্মকর্তাকে এক নোটিশে অব্যাহতি দিয়ে দিলেন! এরপর দু’চারদিন পর পরই ছোট-খাটো কোনো না কোনো পরিবর্তন ঘটাতেই থাকলেন কোম্পানিতে।
এভাবে মাস কয়েক যেতে না যেতেই এন্টোনিও বুঝলেন, এ ছেলের মতিগতি মোটেও সুবিধের নয়। এতদিন ধরে যে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠান চালিয়েছেন এন্টোনিও, ছেলে রিকার্ডো প্রথমেই সেই পদ্ধতির গোড়ায় কুঠারাঘাত করেছেন। কর্মীদের দিয়েছেন অবাধ স্বাধীনতা। চাইলেই যখন তখন ছুটি পায় যেকোনো কর্মী। চাইলেই অফিসে না এসে বাসায় বসে কাজ করে তারা। কী অদ্ভূত ব্যাপার! এভাবে চললে তো ব্যবসার ভিটেই ঘুঘু চড়তে দুদিনও লাগবে না! এন্টোনিও কড়া গলায় সাবধান করে দিলেন রিকার্ডোকে-‘হয় আগের মতো কড়া নিয়মে প্রতিষ্ঠান চালাও নয় তো দায়িত্ব ছেড়ে যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাও।’
বাবার দ্বিতীয় অপশনই বেছে নিলেন রিকার্ডো। দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিলেন। তবে দুচোখ যেদিকে যায় সেদিকে গেলেন না। কীভাবে বাবার ব্যাবসাকে আরও লাভজনক করা যায় সেটা নিয়েই ভাবতে থাকলেন। এর চার বছর পর তিনি আবার সেমকোর হাল ধরেন। বাবাকে বললেন, ‘আমার ওপর ভরসা রাখুন। ব্যবসা লাঠে উঠবে না।’
মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়েছে এন্টোনিওর। আর কত ঝক্কি পোহানো যায়। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই বলেছিলেন, ‘আচ্ছা, রাখলাম ভরসা। দেখি তুমি কী করতে পারো।’
বাবার বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছেন রিকার্ডো সেমলার। তিনি প্রতিষ্ঠান পরিচালন পদ্ধতিতে ব্যাপক রদবদল করেছিলেন। নব্বই দশকের শেষের দিক তখন, সারা বিশ্বজুড়ে বইতে শুরু করেছে প্রযুক্তির হাওয়া, সেমলার সেই হাওয়ায় পাল ওড়ালেন। তার প্রতিষ্ঠানে যোগ করলেন প্রযুক্তি ইউনিট। পাশাপাশি যোগ করলেন স্যাটেলাইট ইউনিট। এই দুই ইউনিট ছয় মাস ধরে শুধু পণ্যের ডিজাইন উন্নয়ন করেছিল। সাকূল্যে তারা আঠারোটি ডিজাইন বের করতে পেরেছিল।
ব্যাবসার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য এটি ছিল রিকোর্ডোর প্রথম পদক্ষেপ। আর প্রথম পদক্ষেপেই সাফল্য। এরপর আরও কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি, যে পদক্ষেপগুলো এখন অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো্ও অনুসরণ করে।
সেমলারের পদক্ষেপগুলোর মধ্যে ছিল-
সাত দিনই ছুটির দিন!
- সেমলারের প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের কোনো নির্দিষ্ট ছুটির দিন নেই। চাইলেই যে কেউ যে কোনোদিন ‘ডে অফ’ হিসেবে কাটাতে পারেন। এছাড়া যেকোনো জায়গা থেকে কর্মীদের অফিস করার সুযোগ দিয়েছেন রিকার্ডো সেমলার। তাঁর ভাষ্য, ‘অফিসের কাজ অফিসে বসে করাটা জরুরি নয়, বরং সময়মতো কাজ সম্পন্ন করাটাই জরুরি। কোনো কর্মী যদি বাড়িতে বসে সময়মতো কাজ ডেলিভারি দিতে পারে, তবে তার অফিসে আসার দরকার কী!’ সেমলার মনে করেন, কর্মীদের স্বাধীনতা দিলেই তারা নির্ভার হয়ে যায় কথাটা ঠিক নয়, স্বাধীনতা কখনো কখনো দায়িত্ববোধও তৈরি করে।
সবার জন্য সমানাধিকার
- সেমকোর স্টাফ হলেই তাকে বিজনেস কার্ড রাখতে হবে এমন ধরাবাধা কোনো নিয়ম নেই। কেউ ইচ্ছে করলে রাখতে পারেন আবার কেউ ইচ্ছে করলে নাও রাখতে পারেন। শুধু তাই নয়, কর্মীরা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী নিজেদের পদবীও বেছে নিতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে পদবী বেছে নিতে হয় তার মর্যাদা অনুযায়ী। অফিসে কর্মীদের নিজস্ব কোনো কাজের ডেস্কও নেই। এমনকি সেমকোর কোনো হেড অফিস বা প্রধান কার্যালয় বলেও কিছু নেই। সেমকোর সব কার্যালয় নিয়ন্ত্রিত হয় একটি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে।
সেমকোতে ম্যানেজার নিযোগ দেয় সেমকোর স্টাফরা। সেমকোতে ম্যানেজার পদে যারা আবেদন করেন তাদেরকে কয়েক সপ্তাহ অফিসে এসে কাজ করতে হয়। পরে সেমকোর স্টাফরাই ভোটের মাধ্যমে তাদের কাজের মূল্যায়ন করেন। আর তা দেখে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত প্রতিযোগিকে ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দেন সিইও।
সেমকোর বোর্ড মিটিং হয় উন্মুক্ত স্থানে। কোনো বদ্ধ ঘরে গোল টেবিল বৈঠক করেন না তাঁরা। আর সভায় কোনো একক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় না। যে বিষয়ের ওপর সর্বাধিক ভোট দেন স্টাফরা সেই সিদ্ধান্তই গৃহীত হয় বোর্ড মিটিংয়ে। এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে যে, সেমলার নিজে কোনো সিদ্ধান্তের কথা উত্থাপন করেছেন বোর্ড মিটিংয়ে কিন্তু সর্বাধিক ভোট না পড়ায় সেই সিদ্ধান্ত আর গৃহীত হয়নি।
নিয়ন্ত্রণ খারাপ, বিশ্বাসই আসল
- সেমকো কখনোই তাদের স্টাফদের ইমেইল চেক করে না। স্টাফদের ফোনেও আড়ি পাতেন না। সেমকোতে চাকরি করার পাশাপাশি তাদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে অন্য ব্যবসা করার। কোনো স্টাফ যদি অন্য কোনো ব্যবসায় সাফল্য অর্জ করে তবে সেমকোর পক্ষ থেকে তাকে পুরস্কৃত করা হয়। রিকার্ডো বিশ্বাস করেন, তিনি তাঁর কর্মীদের এই অবাধ বিশ্বাস করেন বলেই কর্মীরা তাদের সর্বোচ্চ উজার করে শ্রম দেয়। এই বিশ্বাসের ভিতরেই লুকিয়ে আছে সেমকোর সাফল্য।
দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য, ফিরে দেখা ছয় মাস পর
- রিকার্ডো সেমলার বলেন, পরিকল্পনা করতে হয় দীর্ঘমেয়াদী, কিন্তু পর্যালোচনা করতে হয় ছয় মাস পর পর। অর্থাৎ ছয় মাসের একটি সংক্ষিপ্ত পরিকল্পনা থাকা উচিত। তারপর ছয় মাস অতিবাহিত হয়ে গেলে পর্যালোচনায় বসা উচিত যে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজের অগ্রগতি কতটুকু হয়েছে তা দেখার জন্য। ফলাফল সন্তোষজনক না হলে পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে হয়। কখনো কখনো পুরো পরিকল্পনাকে ঢেলে সাজাতে হয়।
অর্থ নয়, সুনাম চাই
- ব্যবসায় লাভ আগে নাকি সুনাম আগে? সেমলার বলেন, আগে সুনাম। কারণ সুনাম এলে সে পথে লাভ না এসে পারেই না। তাই ব্যবসায় অর্থিকভাবে লাভবান হতে চাইলে সবার আগে সুনাম অর্জন করা জরুরি। আর একবার সুনাম অর্জন করতে পারলে আপনাকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হবে না। আপনার ব্যবসা তখন শুধু তরতর করে সামনে এগিয়ে যাবে। সেমকো বছরের পর বছর ধরে শুধু এই সুনাম ধরে রাখার কাজটাই করে যাচ্ছে। যার ফলে অর্থ আসছে সয়ংক্রিয়ভাবে।
তথ্যঋণ : স্টার্টআপস ডট সিও ডট ইউকে, ফ্রেইবার্গস ডটকম ও উইকিপিডিয়া।