জীবনজয়ী সিরাত
সজীব হোসাইন, রংপুর : জন্মের পর থেকেই হাঁটতে পারেন না। সোজা হয়ে দাঁড়ানো বা হাঁটার সামর্থ্য—কোনোটাই নেই তাঁর। ডান হাতটাও প্রায় অকেজো, লিখতে হয় বাম হাতে। তাই তাঁর বাবা-মা চাননি তাঁকে স্কুলে ভর্তি করতে। জন্মের পরেই ভয়-ভীতি, লোকলজ্জাসহ নানা প্রতিবন্ধকতা। পদে পদে বাধা স্কুলে ভর্তি হওয়াতে। কিন্তু দমে যাওয়ার পাত্র নন তিনি। মনোবল আর ইচ্ছাশক্তিতে ভর করে শত প্রতিকূলতা জয় করে স্কুলে ভর্তি হন তিনি। বলছিলাম রংপুরে অবস্থিত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সালাহ্উদ্দিন আহমেদ সিরাতের কথা।
শারীরিক প্রতিবন্ধকতা জয় করে সিরাত ক্যাম্পাসের বন্ধুদের আড্ডার প্রিয় মুখ। তাঁর হাস্যজ্জ্বল মুখ যেন আড্ডার প্রাণ। ‘বন্ধুদের অকৃত্রিম সাহায্য আর শিক্ষকদের ভালোবাসা আমাকে স্কুল,কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে। পরিবারের পর আমার বন্ধুরাই আমার প্রাণ।’ বলছিলেন সিরাত।
নিজের সম্পর্কে সিরাত বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতাম বড় হয়ে ক্রিকেটার হব। তখনো ভালো মতো বুঝে উঠতে পারিনি শারীরিক অক্ষমতার কথা। ক্রিকেট আমার ভীষণ প্রিয় খেলা। বাংলাদেশ দলের ক্যাপ্টেন মাশরাফি বিন মর্তুজাকে দেখে অনুপ্রেরণা পাই শত বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে চলার।’
পড়াশোনাতে মেধাবী সিরাতের জন্ম রংপুর নগরীর ধাপ হাজীপাড়ায়। তিনি রংপুর মেডিকেল কলেজ পাবলিক হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ-৪.২৫ এবং রংপুর বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৪.৭০ অর্জন করেন। কিন্তু আবারও শারিরীক সীমাবদ্ধতার কারণে দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা নিয়ে। সিরাতের পরিবার ছেড়ে অন্যত্র থাকা সম্ভব নয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার জন্য রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ই ছিল তাঁর একমাত্র ভরসা। অবশেষে মেধা আর কলম নিয়ে ভর্তি যুদ্ধে জয়ী হয়ে পথ চলা শুরু হয় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়েই।
সিরাত বলেন, ‘আমি চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসি। আমি একজন প্রতিবন্ধী, এটা আমার কোনো দুর্বলতা নয়। বরং এটাই আমার এগিয়ে যাওয়ার জন্য চ্যালেঞ্জ। আমার সীমাবদ্ধতাকে চ্যালেঞ্জ করেই সবার রোল মডেল হতে চাই। আমাকে দেখে যেন কেউ লড়াই করার আগেই হার মেনে না নেয়।’
জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে মৃদু হেসে সিরাতের চটপটে উত্তর— ‘ভালো মানুষ হতে চাই। পড়ালেখা করে অনেকে অনেক বড় কিছু হতে পারে কিন্ত ভালো মানুষ সবাই হতে পারে না।’ জীবনে বাবার অবদান সব থেকে বেশি। তার পরেই বিভাগের শিক্ষকদের। সিরাত বলেন, ‘শিক্ষকদের সর্বাত্মক সহযোগিতা আর বন্ধুদের ভালোবাসা না পেলে অনেক আগেই থেমে যেত আমার জীবন যুদ্ধ।’ কথা বলতে বলতেই আনমনা সিরাত বলেন, ‘ইচ্ছা আছে প্রতিবন্ধী ও গরীব এতিম বাচ্চাদের জন্য কিছু করার। এতিমদের প্রতি দুর্বলতা কেন সেটা না হয় অজানাই থাক। সুযোগ পেলে প্রতিবন্ধীর সংজ্ঞাটা পাল্টাতে চাই।‘
‘পড়াশোনায় মেধাবী সিরাতের মধ্যে যে স্বতস্ফূর্তভাব দেখেছি তাতে মনে হয়নি সিরাত জীবনযুদ্ধে হাল ছাড়বে। সিরাত ইতোমধ্যে শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে হার মানিয়েছে।‘ সিরাত সম্পর্কে এভাবেই বলছিলেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ইলিয়াস সাব্বির।