আভিজাত্যে টাঙ্গাইল তাঁতের শাড়ি
“নদী-চর, খাল-বিল, গজারীর বন,
টাঙ্গাইল শাড়ি তার গর্বের ধন।”
আকলিমা আক্তার রিক্তা : সুপ্রাচীনকাল থেকেই টাঙ্গাইলের শাড়ি আমাদের ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির অংশ। টাঙ্গাইলের দক্ষ কারিগররা তাদের বংশ পরম্পরায় তাঁতের নানা ধরনের কাপড় তৈরি করছেন। টাঙ্গাইলের বস্ত্র শিল্প অর্থাৎ তাঁত শিল্পের উল্লেখ রয়েছেন বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ও হিউয়েন সাং- তাদের ভ্রমণ কাহিনীতে। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির জন্যই টাঙ্গাইলের সুনাম বা পরিচিতি দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী সুখ্যাতি অর্জন করেছে।
ঐতিহ্য:
তাঁতের শাড়ির জনপ্রিয়তা রক্ষায় কাজ করে চলছে টাঙ্গাইলের বসাক শ্রেনীর তাঁতপল্লীর তাঁতীরা। ঠিক কবে এই অঞ্চলে তাঁতশিল্প গড়ে উঠেছিল তা জানা যায়নি। তবে এটা জানা যায় যে, এই তাঁতপল্লী হাজার বছরেরও পুরোনো! বংশ পরম্পরায় তারা তাঁতের কাজ করেন। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি এতটাই জনপ্রিয় যে, তাঁতের শাড়ি বলতে অনেকে শুধু টাঙ্গাইলের শাড়িই বোঝেন! তাঁতীদের হাতে একের পর এক শাড়ির জন্ম হয় সুতি সুতাকে উপজীব্য করে । এই শাড়ি অত্যন্ত মোলায়েম ও আরামদায়ক হয়, কারন এই শাড়ি তৈরীতে অতিমিহি সুতা ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি শাড়ি তৈরির সময় এর গুণগত মানের দিকে লক্ষ্য রাখা হয়। শাড়ির বুননকৌশল, রং, ডিজাইন ও দৈর্ঘ্য অন্য যেকোনো শাড়ি থেকে আলাদা ধরনের হয়।
বৈশিষ্ট্য:
টাঙ্গাইলের শাড়ির বৈশিষ্ট্য হলো- পাড় বা কিনারের কারু কাজ। বিদেশী বণিক চক্রের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মসলিন কাপড় কালের প্রবাহে হারিয়ে গেছে। কিন্তু তার সার্থক উত্তরাধিকারী হয়ে আজও টিকে রয়েছে টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি। টাঙ্গাইল তাঁতশিল্পে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে নব্বই দশকের প্রথম দিকে। এ সময়ে টাঙ্গাইল কটন শাড়ির পাশাপাশি টাঙ্গাইল সফট সিল্ক শাড়ি তৈরি শুরু হয়। এ শাড়ি দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে, একমাত্র তার আকর্ষনীয় ডিজাইন ও উন্নত বুনন এর কারনে। মাধবীলতা, পদ্মপাড়, কুঞ্চলতা, তেরবি, মরবি, লতাপাতা পাড়ের শাড়ি বেশি জনপ্রিয় ছিল তখনকার সময়ে। এখনকার যুগে টাঙ্গাইলের তাঁতীরা তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও যুগের চাহিদার সাথে সাথে বুননে এনেছে বৈচিত্রতা। সফট সিল্ক ,হাফ সিল্ক ছাড়াও টাঙ্গাইলে তৈরী করা হয় বালুচরি, জরিপাড়, স্বর্ণচুড়, ইককাত, আনারকলি, দেবদাস, কুমকুম, সানন্দা, হাজারবুটি, সূতিপাড়, কটকি, নীলাম্বরী, ময়ুরকন্ঠী ইত্যাদি শাড়ি।
খুব দরদ, গভীর মনোসংযোগের সাথে টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি তৈরি করা হয় এবং কারুকাজ করা হয় অত্যন্ত সুক্ষ্ণ ও সুদৃশ্য ভাবে। পুরুষ এবং মহিলা উভয় মিলেই শাড়ি প্রস্তুত করে থাকেন তাদের আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে। পুরুষেরা তাঁত বোনে; আর চরকাকাটে। রঙকরা এবং জরির কাজে সহযোগিতা করে বাড়ির মহিলারা। শাড়ির জমিনে নানা ডিজাইন করে বা নকশা আঁকে, ফুল তোলে – তাকে আরো মনোমুগ্ধকর করে তোলে তাঁতীরা।
দরদাম :
শাড়ির বুনন, রং, দৈর্ঘ্য, কারুকাজ ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে দাম ভিন্ ভিন্ন হয়। সমাজের সব ধরনের মানুষের ব্যবহারের উপযোগী করে এর দাম নির্ধারন করা হয়েছে। তবে জামদানী এবং সিল্ক এর দামটা তুলনামুলক বেশী। দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে টাঙ্গাইলের তাতের শাড়ি বিদেশে সুনাম অর্জন করছে। এর খ্যাতি যেন বিশ্বজোড়া। ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন দেশ, জাপান, সৌদিআরব, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যসহ বিভিন্ন স্থানে এর সুখ্যাতি রয়েছে।
টাঙ্গাইলের শাড়ি দেশের বিভিন্ন শপিং মল, মার্কেট, ফ্যাশন হাউসে পাওয়া যায়।উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সব শ্রেনীর মানুষ নিজেদের পছন্দ ও সাধ্যের মধ্যে কিনে নিয়ে যায় টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি।
সফট সিল্ক, হাফ সিল্ক ছাড়াও টাঙ্গাইলে তৈরী করা হয় বালুচরি, জরিপাড়, স্বর্ণচুড়, ইককাত, আনারকলি, দেবদাস, কুমকুম, ইত্যাদি। এসব শাড়ির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটির দাম নিম্নে দেয়া হলঃ
শাড়ি দাম
- সফট সিল্ক ৯৫০-৫০০০ টাকা,
- সফট কটন ৬৫০-৩৫০০ টাকা
- বালুচরি ১৪০০-২৮৫০ টাকা
- তসর সিল্ক ১৯০০-৪৫০০ টাকা
- সম্বলপুরী ৭৫০-৩০০০ টাকা,
- সিল্ক কাতান ২৫০০-১০০০০ টাকা,
- অন্যান্য শাড়ি ৬০০-৫০০০ টাকার মধ্যে।
শাড়ি যেন ভারতীয় উপমহাদেশের আভিজাত্য। শাড়ির চাহিদা মেটাতে অনন্য ভূমিকা রাখে টাঙ্গাইলের শাড়ি।টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্ন উপজেলার মধ্যে টাঙ্গাইল সদর, কালিহাতী, নাগরপুর, সখীপুর উপজেলা তে তাতশিল্পের কাজ বেশী হয়।এছাড়া গোপালপুর ও ভূঞাপুর উপজেলার কিছু কিছু গ্রামে তাঁত শিল্প রয়েছে। দিন-রাত এই সব গ্রামে শোনা যায় মাকুর খটখট শব্দ। টাঙ্গাইল যেন শাড়ি উতপাদনের ভান্ডার।আর টাঙ্গাইলকে তথা দেশকে শুধুমাত্র শাড়ি দিয়ে বিশ্বের বুকে সুপরিচিত করে তুলতে যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তাঁদের কে উপযুক্ত পারিশ্রমিক, উৎসাহ ও সরকারী অনুদান দিয়ে সাহায্য করায় এগিয়ে আসলে আরো সম্প্রসারিত হবে এই শিল্পটি।