পর্তুগীজদের দূর্গ কিংবা সাহেবগঞ্জ নীলকুঠি
মো. সাইফ : চাঁদপুরের পরিচিতি মূলত ‘ইলিশের দেশ’ হিসেবেই। তবে চাঁদপুরে রয়েছে এমন কিছু নিদর্শন যার সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানে না নতুন প্রজন্ম! সাহেবগঞ্জের নীলকুঠি এমনই একটি স্থান।
চাঁদপুরকে বলা হতো ‘Gateway of Eastern India’। বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই চাঁদপুর সুপরিচিত। এখানে পর্তুগীজ, ইংরেজরা বাণিজ্য করতে আসবে তৎকালীন প্রেক্ষাপটে এমনটা স্বাভাবিক ছিল। বাণিজ্য করতে এসে তাদের প্রয়োজনেই তারা গড়ে তোলে বিভিন্ন স্থাপনা। অনেক স্থাপনাই কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেলেও সাহেবগঞ্জ নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ এখনো আছে।
চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার রূপসা ইউনিয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ জনপদ হচ্ছে সাহেবগঞ্জ। উপজেলা সদর থেকে সাহেবগঞ্জের দুরত্ব মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। ধারনা করা হয়, সর্বপ্রথম এই অঞ্চলে আসে পর্তুগিজরা। তখন সাহেবগঞ্জ জনপদটি পরিচিত ছিল ‘বংশাল’ নামে। পরবর্তীতে ইংরেজরা আসে। সে সময় ইংরেজদের ‘সাহেব’ বলে ডাকতে হতো এবং সেই সূত্র ধরেই জায়গাটির নাম লিপিবদ্ধ হয়েছে ‘সাহেবগঞ্জ’ নামে। এখানে নীলকুঠিতে বসেই ইংরেজরা নীলচাষী কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতেন। ১৮৬৬ সালের দিকে নীল চাষের ব্যাপক উন্নতি হয়। অবশ্য পরে ১৮৭৩ সালে নীলচাষীদের আন্দোলনের মুখে জনপদটিতে নীল চাষ বন্ধ হয়ে যায়। এখন যদিও নীলচাষ কিংবা ইংরেজদের অত্যাচার কোনোটিই নেই তবুও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে পুরনো লাল ইটের সেই বাড়িগুলোর ধ্বংসাবশেষ এখনো রয়ে গেছে।
নীলকুঠির আড়ালে সাহেবগঞ্জ ধারণ করে আছে আরো অদ্ভুত কিছু ইতিহাস। নীলকুঠিকে ব্যবহার করলেও নীলকুঠি কিন্তু ইংরেজরা নির্মাণ করেনি। মুলত, এটি ছিল একটি দুর্গ। প্রায় দু’শ একর জুড়ে ৫০০ বছর পুর্বে এই দুর্গটি নির্মাণ করেছিলেন পর্তুগীজ সেনাপতি এন্টোনিও ডি সিলভা মেঞ্জিস। তখনকার সময়ে ফরিদগঞ্জের অবস্থান ছিল সমুদ্রের কাছাকাছি। জলদস্যু হিসেবে পরিচিত পর্তুগীজরা তাই তাদের নিরাপত্তার জন্য নির্মাণ করেছিল বিশাল এই দুর্গ। যদিও তারা এটাকে বলতো বাণিজ্যকুঠি। বাণিজ্যকুঠির আড়ালে চলতে থাকে তাদের জলদস্যুতা। দুর্গ নির্মাণের প্রায় তিনশ বছর পর ইংরেজরা দুর্গটিকে নীলকুঠি হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। বর্তমানে সবাই এই দুর্গটিকে নীলকুঠি হিসেবেই জানে। এই এলাকায় এখনো কিছু কিছু পরিবার বাস করে যাদের আদি পুরুষ পর্তুগীজ।
সাহেবগঞ্জ নীলকুঠির অনেক অংশই আজ রক্ষনাবেক্ষণের অভাবে বিলীনের পথে। এখানে একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার বা মিনার রয়েছে। এই মিনারটিই একমাত্র অক্ষত স্থাপনা। ৪৫ ফুট উঁচু এই মিনানের ভিতরের অংশে এক সময় শিলালিপি ছিল বলে জানা যায়। মিনার ছাড়াও এখানে মূল্যবান জিনিসপত্র রাখার জন্য মাটির নিচের ঘর আন্ধারমানিক, হাতি ও ঘোড়াশালসহ অনেক স্থাপনার নজির পাওয়া যায়। আছে ইংরেজ নীলকর চার্লি সাহেবের দীঘি।
বর্তমানে ঝোপঝাড়, জঙ্গল, গাছপালায় ছেয়ে আছে এইসব স্থাপনা। অনেক স্থান আবার বেদখল হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ আবার চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী। এভাবে চলতে থাকলে হয়ত ভবিষ্যত প্রজন্মকে জানানো সম্ভব হবে না বাংলার আদি ইতিহাস। নীল চাষ কিংবা নীলকুঠির ইতিহাস হয়ত হারিয়ে যাবে এইসব নিদর্শন গুলো হারানো মাধ্যমে। তাই সাহেবগঞ্জ নীলকুঠি এবং এর ইতিহাস সংরক্ষণ এর ব্যবস্থা করা এখন সময়ের দাবি।
তথ্যসূত্র: সরেজমিন পরিদর্শন, বাংলাপিডিয়া ও অন্যান্য ওয়েবসাইট।