নাটোর গেলে যে জাদুঘর দেখতেই হবে
- রনি আহমেদ
ঐতিহ্যের তীর্থভূমি নাটোর জেলার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দর্শনীয় সব স্থান। এর মধ্যে অন্যতম চলনবিল জাদুঘর। ১৯৭৮ সালে নাটোর জেলার গুরুদাসপুর উপজেলার খুবজীপুর গ্রামে এটি প্রতিষ্ঠা করেন অধ্যাপক আব্দুল হামিদ।
শুরুতে এই জাদুঘরের স্থায়ী কোনো জায়গা না থাকায়, খুবজীপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় ভবনে বেসরকারি উদ্যোগে অস্থায়ীভাবে যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীতে, ১৯৮১ সালে সরকারিভাবে এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠার জন্য পাঁচকাঠা জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। ১৯৮৪-৮৫ সালে নরওয়ের দাতা সংস্থা নোরীড ও ১৯৮৫-৮৬ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অর্থিক সাহায্যের ফলে গড়ে তোলা হয় জাদুঘরটির দোতালা ভবন। এরপর ১৯৮৯ সালে প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর জাদুঘরটিকে তাদের নিজস্ব আওতায় নিয়ে নেয়। চলনবিল জাদুঘর প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই উপমহাদেশের অনেক দুর্লভ নিদর্শন সংগ্রহ করে এই জাদুঘরে নিয়ে আসা হয়। এসব সিদর্শন এই অঞ্চলের মানুষের কাছে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল।
এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠার কারণ হিসেবে জানা যায়, চলনবিল অঞ্চল যে প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্যে ভরপুর সেই সব লুপ্ত ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা। এছাড়াও বিভিন্ন কৃষ্টিগত নির্দশন, প্রত্নরাজা, শিলালিপি, টেরাকোটাসহ বিভিন্ন নমুনা সংরক্ষণের জন্য অধ্যাপক আব্দুল হামিদ এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেন।
যা কিছু দেখার আছে
করিডোর দিয়ে হেঁটে মূল ফটক পেরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখের সামনে পড়বে দেয়ালে টাঙ্গানো উটের চামড়া। এরপর উত্তর দিকে নজর পড়তেই একে একে দেখা মিলবে নাটোরের বিখ্যাত পাগলা রাজার উপদেষ্টা শ্রীবরদা প্রসাদ শাস্ত্রীর আবক্ষ মূর্তি, মিসরের পিরামিডের পাথর, বিভিন্ন যুগের স্বর্ণ, রৌপ্য, তামা ও ধাতব মুদ্রা। এক সময় এই অঞ্চলে ডাকাতের উৎপাত ছিল মাত্রাতিরিক্ত, তাই সেই সময়ের ডাকাতের তরবারির দেখাও পাওয়া যায় এই জাদুঘরে।
কয়েক কদম পেরিয়ে মাথাটা একটু বাম দিকে হেলাতেই পশ্চিম পার্শ্বে অবলীলায় নজরে পড়বে ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ব্যবহৃত বুলেট, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লার হাতে লেখা ডায়েরি, বাদশাহ নাসির উদ্দিন ও মোগল সম্রাট আলমগীরের হাতে লেখা কোরআন শরীফ এবং রানি ভবানীর হাতে লেখা দলিল। এসব কিছু দেখতে দেখতে নিজের অজান্তেই জাদুঘরের দক্ষিণ পাশে এসে পৌঁছাবেন। আর সেখানে দেখা মিলবে তুলট কাগজ ও গাছের ছালে লেখা প্রাচীন ও মধ্যযুগের পুঁথির পাণ্ডুলিপি, তিন মাথাযুক্ত বাঁশ, মানুষের মাথার খুলি, বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান, ৮০টি দেশের মুদ্রাসহ প্রাচীন সব উপকরণ। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের প্রস্তর ও পোড়ামাটির ভাস্কর্য ও মূর্তি, রাজা সম্রাট সুলতান নবাবদের ব্যবহৃত তরবারিসহ অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র, মনসামঙ্গলের বেদি ও ঘট।
এসব কিছুর পাশাপাশি এই জাদুঘরে আরো দেখা পাওয়া যায় বগুড়ার মরহুম কবি রুস্তম আলী কর্ণপুরীর দলিল-দস্তাবেজ, ডাকটিকিট, চিত্রকর্ম, চলনবিল অঞ্চলের মানুষের নিত্যব্যবহার্য বিভিন্ন দ্রব্য, তৈজসপত্র, কৃষি ও মাছ ধরার সরঞ্জাম।
সারা বছর দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে দর্শনার্থীরা দেখতে আসেন এই জাদুঘরকে। বিশেষত বর্ষা মৌসুমে প্রায় প্রতিদিন চলনবিলের উপর দিয়ে নৌকায় বেড়াতে আসেন এই জাদুঘরে। একদিকে চলনবিলের সৌন্দর্য যেমন দর্শনার্থীদের চোখের তৃষ্ণাকে পরিপূর্ণ করে, অন্যদিকে চলনবিল জাদুঘরের প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্য তাদের জ্ঞানকে বিকশিত করে। কেয়ারটেকার ও নৈশ্যপ্রহরীর দায়িত্ব পালন করা আবু বক্কর সিদ্দিকী জানান, চলনবিলের ইতিহাস সমৃদ্ধ সংগ্রহ দেখতে প্রতিদিনই বিভিন্ন জায়গা থেকে অসংখ্য মানুষ চলনবিল জাদুঘর দেখতে আসেন। তবে করোনার জন্য মানুষের সংখ্যা অনেক কমে গিয়েছিল। বর্তমানে বর্ষা মৌসুম হওয়ার ফলে আবারো মানুষের উপচে পড়া ভিড় হচ্ছে।
কখন যাবেন
প্রতিদিন সকাল ৯:৩০ থেকে বিকেল ৫.০০ পর্যন্ত চলনবিল জাদুঘর সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকে। প্রতি রবিবার জাদুঘর বন্ধ থাকে। প্রতিদিন দুপুর ১.০০ থেকে ১.৩০ মিনিট পর্যন্ত সাময়িক বিরতি চলে।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে বাসে রওনা দিয়ে নাটোরে পৌঁছানোর আগে কাছিকাটা বাজারে নামতে হবে। সেখান থেকে সিএনজি বা ভ্যানযোগে খুবজীপুর বাজারে গেলে চোখে পড়বে চলনবিল জাদুঘর। এছাড়া নাটোর শহর থেকে গুরুদাসপুর বাসে গিয়ে তারপর ভ্যানে চড়ে সেখানে যাওয়া যায়।