ঘুরে আসুন উত্তরা গণভবন
- রনি আহমেদ
নাটোর শহর থেকে তিন কিলোমিটার উত্তরে ৪১ দশমিক ৫ একর জমির উপর স্থাপিত উত্তরা গণভবন। এটি দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি নামে আড়াইশ বছর ধরে ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে অবস্থান করছে। দেশের উত্তরাঞ্চলসহ সারাদেশের মানুষের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র এই উত্তরা গণভবন।
জানা যায়, নাটোরের রাণী ভবানী তার নায়েব দয়ারামের উপরে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে দিঘাপতিয়া পরগনা উপহার দেন। পরবর্তীতে ১৭৩৪ খ্রিস্টাব্দে দয়ারাম রায় নাটোরের দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৭ সালের প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় রাজপ্রাসাদ। পরবর্তীতে ১১ বছর ধরে বিদেশি বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী, চিত্রশিল্পী ও কারিগরদের পরিশ্রমের ফলে সৃষ্টি হয় এই দৃষ্টিনন্দন রাজবাড়ীর।
১৯৪৭ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত ঘটায়। ফলে ১৯৫২ সালে দিঘাপতিয়ার শেষ রাজা প্রতিভানাথ রায় সপরিবারে রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে কলকাতায় চলে যান। পরবর্তীতে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত রাজ প্রাসাদটি পরিত্যক্ত থাকে। এরপর এটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ১৯৬৬ সালে ইস্ট পাকিস্তান হাউস ও ১৯৬৭ সালে গভর্নর হাউজ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উত্তরা গনভবনে বেড়াতে আসেন। সেই সময় তিনি এটাকে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন হিসেবে ‘উত্তরা গণভবন’ নাম দেন।
যা কিছু দেখার আছে
উত্তরা গণভবনের মূল ফটক পেরিয়ে সামনের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেই দু’পাশে বিভিন্ন প্রজাতির সারি সারি ফুলের গাছের দেখা মিলবে। এগুলোতে ফুটে আছে নানান রঙের দৃষ্টিনন্দন ফুল। এসবের সঙ্গে মিনি চিড়িয়াখানা এবং তার সংগ্রহশালা যে কারো মনকে তৃপ্ত করবে। রাজপ্রাসাদের চারপাশ ঘিরে থাকা ১০ ফুট উঁচু সীমানা প্রাচীর ও ১৪ একর আয়তনের লেক, সিংহদুয়ারের উপর স্থাপন করা বিশাল ঘড়ির ঘণ্টা, ইতালিয়ান গার্ডেনে শ্বেতপাথরের অপরূপ চারটি ভাস্কর্য, মার্বেল পাথরের আসনসহ সভা মঞ্চ, হৈমন্তী, পারিজাত, ম্যাগনোলিয়াসহ অসংখ্য দুষ্প্রাপ্য বৃক্ষ দর্শনার্থীদের সবচাইতে বেশি আকৃষ্ট করে।
উত্তরা গণভবনের মিনি চিড়িয়াখানা বানর, ময়ূরসহ দেশী-বিদেশী পাখি, সাপের অভয়ারণ্য। এছাড়াও রাণী মহলে দেশী-বিদেশী আকর্ষণীয় ফুলের গাছগুলোর থোকা থোকা ফুল, মাঝে পায়ে হাঁটার পথ রেখে দুদিকে ফুলের গাছ লাগানোর ফলে স্থানটি দৃষ্টি কাড়ে ভ্রমণপ্রেমীদের। আর এর পাশেই দর্শনার্থীদের চোখে ধরা দেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে রোপণ করা ‘হৈমন্তী’ গাছটি।
মূল প্যালেস ও ইতালিয়ান গার্ডেনের মাঝের ভবনটিতে বিশাল সংগ্রহশালা রয়েছে। রাজা-রাণীর ছবি, রাজকুমারী ইন্দুমতির নিজ হাতে লেখা ২৮৫টি চিঠি, রাজপরিবারে ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী, চাকাওয়ালা চেয়ার, টেবিল, সিংহাসন, দিঘাপতিয়া রাজপরিবারের ঐতিহাসিক সব জিনিসপত্র রয়েছে। সংগ্রহশালার করিডোরে রয়েছে রাজা প্রমদানাথ রায় ও সস্ত্রীক রাজা দয়ারাম রায়ের ছবি, সঙ্গে রাজবাড়ির সংক্ষিপ্ত বিবরণ। রয়েছে মার্বেল পাথরের রাজকীয় বাথটাব। রাজার পালঙ্ক, ঘূর্ণায়মান চেয়ার, টেবিল, আরাম চেয়ার আর ড্রেসিং টেবিল দিয়ে পাশের ঘরটি যেন রাজার শয়নকক্ষের প্রতিরূপ। বাঁ-পাশের দ্বিতীয় কক্ষের শোভা রাজ সিংহাসন, রাজার মুকুট ও গাউন। আরও আছে মার্বেল পাথরের থালা, বাটি, কাচের জার, পিতলের গোলাপ জলদানি আর চিনামাটির বিভিন্ন ধরনের ডিনার সামগ্র। আর এই কক্ষেই রয়েছে রাজপরিবারের লাইব্রেরির সব বইগুলো এবং দিঘাপতিয়ার শেষ রাজা প্রতিভানাথ রায়ের ইন্স্যুরেন্স বিষয়ক বিভিন্ন কাগজপত্র।
পাশের কক্ষটি রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা চৌধুরানির বিভিন্ন সামগ্রীতে সুশোভিত। ইন্দুপ্রভার একটি ছবি রাখা হয়েছে পিতলের একটি ফ্রেমে। তার ব্যক্তিগত ডায়েরি, আত্মজীবনী, পান্ডুলিপি, তাকে লেখা স্বামী মহেন্দ্রনাথ চৌধুরীর রাশি রাশি চিঠি ও সেগুলো রাখার পিতলের স্যুটকেস দেখার অভিজ্ঞতা অন্যরকম। ইন্দুপ্রভার লেখা ‘বঙ্গোপসাগর’ কবিতাটি ফ্রেমে বাঁধাই করে দেয়ালে টাঙ্গানো হয়েছে। ৬৭ লাইনের এই কবিতায় বঙ্গোপসাগরের অপরূপ সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন তিনি। সংগ্রহশালার ১০টি কক্ষের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে দিঘাপতিয়া রাজপরিবারের ব্যবহৃত দৃষ্টিনন্দন সব আসবাবপত্র। এর মধ্যে রয়েছে ডিম্বাকৃতি, গোলাকার, অষ্টভুজাকৃতি, চতুর্ভুজাকৃতি ছাড়াও দোতলা, প্রসাধনী ব্যবহারের উপযোগী ও কর্নার টেবিল, গার্ডেন ফ্যান কাম টি-টেবিল।
উত্তরা গণভবনের সংগ্রহশালায় আরো রয়েছে ১৬৭ বছরের পুরনো ‘বানিয়ানস পিলগ্রিনস প্রোগ্রেস’ নামক সোনার প্রলেপযুক্ত বই। এর প্রচ্ছদ ও পৃষ্ঠার বাঁধানো পাশ ছাড়া অন্য তিন পাশ সোনার প্রলেপযুক্ত। বইটির সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানচিত্র ‘ভিক্টোরিয়া অ্যাটলাস অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ রাজার স্মৃতিবিজড়িত একটি দেয়াল ঘড়ি ও কলিংবেল সংগ্রহশালাকে দান করে দিঘাপতিয়া পিএন উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও, স্কুলের পক্ষ থেকে প্রভাত কুমার রায়ের ১৯৯৭ সালের দুটি ছবি দেওয়া হয়।
দীর্ঘদিন ধরে সরকারি কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় ঐতিহ্যবাহী ভবনটিতে দর্শনার্থীদের প্রবেশের সুযোগ সংকুচিত ছিল। ২০১২ সালে এই রাজবাড়ি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। তখন প্রবেশমূল্য ছিল ১০ টাকা। কিন্তু তখন দর্শনার্থীরা রাজবাড়ির মাত্র ৩০ ভাগ এলাকা দেখতে পেতেন। পরে প্রবেশের মূল্য নির্ধারণ করা হয় ২০ টাকা। ২০১৮ সালের ৯ মার্চ সাবেক জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন রাজবাড়ির ট্রেজারি ভবনের সমস্ত সংগ্রহশালা আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। আর সেই সময় গণভবনের মোট ৮০ ভাগ এলাকা দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত ঘোষণা করেন তিনি।
কখন যাবেন
গ্রীষ্মকালে সকাল ১০.০০ থেকে বিকাল ৬.০০ পর্যন্ত খোলা থাকে উত্তরা গণভবন। শীতকালে সকাল ১০.০০ থেকে বিকাল ৫.০০ পর্যন্ত খোলা থাকে। এখানে প্রবেশমূল্য মাত্র ২০টাকা।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে বাস ও ট্রেনযোগে নাটোর যাওয়া যায়। সেখান থেকে নাটোর বাসস্টপ ও রেল স্টেশন থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা এবং সিএনজি করে উত্তরা গণভবনে যেতে ১৫ মিনিট সময় লাগবে।