এ যেন দ্বিতীয় কক্সবাজার!
- রনি আহমেদ
সবাই তাকে সম্বোধন করে মিনি কক্সবাজার নামে। যত দূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। এ যেন সমুদ্র! হরহামেশাই ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে এর দু’পাড়ে। এই সৌন্দর্যমণ্ডিত পর্যটন কেন্দ্রটি নাটোর জেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থী বেড়াতে আসেন ‘মিনি কক্সবাজার’ নামে পরিচিত এই হালতি বিলে।
হালতি বিল—যার নাম শুনলেই সবার মনের আয়নায় অথৈ পানি আর ঢেউয়ের কথা খেলা করে। ঢেউয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে অবিরাম ছুটে চলে ইঞ্জিন চালিত নৌকা। কখনো ডিঙি নৌকা ঢেউয়ের তালে আঁকাবাঁকাভাবে একবার উপরে উঠে আবার যেন নিচে পড়ে। দূর থেকে মাঝে মধ্যে সবুজে ঘেরা গ্রামের দেখা মেলে। দেখে মনে হবে যেন এক টুকরো সমুদ্রের মধ্যে সবুজে ঘেরা দ্বীপ।
এই বিলের সবচাইতে বড় আকর্ষণ হলো বর্ষাকালের পাটুল থেকে খাজুরা পর্যন্ত রাস্তা। বর্ষাকালে পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে এই বিল। সেই সময় পাটুল হতে খাজুরা পর্যন্ত রাস্তার দুধার পানিতে ভরপুর থাকে। অল্প বিস্তর পানি রাস্তাতেও উঠে আসে। তখন দর্শনার্থীরা রাস্তার উপর দিয়ে বয়ে চলা এই পানিতে নিজেদের পা ডুবিয়ে শান্তির পরশ খোঁজেন। কখনো দেখা মেলে বাইক নিয়ে পা নিংড়ানো এই পানির উপর দিয়ে মানুষকে আনন্দ করতে। অনেকেই এই বিলের পানিতে নেমে মনের সমস্ত উদ্যম দিয়ে ঝাঁপাঝাপি করেন। অনেকেই শরীর ভিজিয়ে গোসল করে নেন। সব বয়সের মানুষ যেন মেতে উঠেন আনন্দের পসরা নিয়ে।
এই বিলের আকর্ষণের অনেকটা জায়গাজুড়ে রয়েছে হিমেল বাতাস। মানুষের সমস্ত ক্লান্তি যেন নিঃশেষ হয়ে যায় এর শীতল বাতাসের স্পর্শে। এই বিলের পাশ ধরেই মাধনগর এলাকা দিয়ে চলে গেছে রেললাইন। একদিকে বিল, অন্যপাশে বিলের শরীর ঘেঁষে রেললাইন। কি যে মনোমুগ্ধকর দৃশ্য! এ বিলের ঘাটে সবর্দা বাধা থাকে ছোট বড় ইঞ্জিন চালিত অসংখ্য নৌকা। দর্শনার্থীরা সেখান থেকে নৌকা নিয়ে সমস্থ বিল ছুটে বেড়ায়। আর তার ফাঁকে ফাঁকে তাদের সাথে দেখা হয় বিলুপ্তপ্রায় বিভিন্ন ধরনের জলজ গাছের এবং রং-বেরঙের হরেক রকমের পাখির। এসব দেখতে দেখতে কখন যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে তারা টেরও পায় না।
হালতি বিলের মধ্যে দিয়ে সাবমেরিন রাস্তা রয়েছে। বর্ষার শুরুতে পানির মধ্যে রাস্তা গুলো যখন জেগে থাকে। দূর থেকে মনে হয় যেনো সমস্ত পানির মাঝে কিছুটা চর জেগে আছে। বারনই, আত্রাইসহ অনেকগুলো নদীর পানিতে ভরপুর থাকে এই বিল। যার ফলে, এই বিল বছরে প্রায় আট মাস পানিতে পূর্ণ থাকে। সে জন্যে এই এলাকার মানুষদের বেশিরভাগ সময় যাতায়তের মাধ্যম নৌকা।
হালতি বিলে দর্শনার্থীরা একদিকে যেমন এ বিলের সৌন্দর্য উপভোগ করেন অন্যদিকে দেশীয় মাছের স্বাদ নিতেও ভুল করেন না। এই বিল বছরের বেশিরভাগ সময় পানিতে পূর্ণ থাকায় বিভিন্ন ধরনের দেশীয় মাছে ভরপুর থাকে। বলা হয়ে থাকে যে, দেশীয় মাছের প্রজননস্থলের জন্যে বিখ্যাত হালতি বিল। এমনকি চলে যাবার সময়ও তারা হরেক ধরনের মাছ কিনে নিয়ে যান।
বর্ষার সময় এ বিলের যে দৃশ্য থাকে, শুকনো মৌসুমে তা পুরোপুরি বদলে যায়। বর্ষায় সমস্ত বিলজুড়ে পানিতে পূর্ণ থাকে। তবে শুকনো মৌসুমে সমস্ত বিল সবুজে পূর্ণতা পায়। কারণ সে সময় বিলের জমিতে সবাই ফসল ফলায়। তার কয়েক মাস পরেই সমস্ত বিলের মাইলের পর মাইল এলাকাজুড়ে দেখা মেলে সোনালী ধানের। বর্ষা মৌসুমে পানিতে ডুবে থাকা রাস্তাগুলোও জেগে উঠে। আর তখন নৌকার বদলে যাতায়াতের অনেকটা জায়গা দখলে করে নেয় যানবাহন।
বিলের নাম কেন হালতি?
ব্রিটিশ আমলে এই বিলে দেখা মিলত বিরল প্রজাতির ‘হালতি’ নামক পাখি। আর এই পাখি শিকার করতেই ব্রিটিশরা এ বিলে আসতেন। তখন থেকেই এর নাম হয়ে উঠে হালতি বিল। জানা যায়, এ বিলের আয়তন প্রায় ৪০ হাজার একর। এই বিলকে বলা হয় দেশের সবচেয়ে গভীর বিল। বর্ষা মৌসুমে এর গভীরতা অনেক বেশিতে গিয়ে দাঁড়ায়। শুষ্ক মৌসুমে পানির পরিমাণ কম থাকলেও একেবারে পানিশূন্য থাকে না।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে বাসে করে নাটোরের বাই পাসে এসে নামবেন। সেখান থেকে অটোরিকশায় ৩০টাকা ভাড়া দিয়ে পৌঁছে যাবেন হালতি বিলে।