পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ে যে রাজবাড়ি
- রনি আহমেদ
রাজশাহী থেকে প্রায় ৪৮ কিলোমিটার পূর্বে নাটোর জেলা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত নাটোর রাজবাড়ি। এটি আঠারো শতকের একদম শুরুর দিকে নির্মিত হয়। কথিত আছে মহারানি ভবানীর স্মৃতিবিজড়িত এই রাজবাড়িতে বসেই কবি জীবনানন্দ দাশ রচনা করেছিলেন তাঁর কালজয়ী কবিতা বনলতা সেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকাজুড়ে যে কয়টি রাজবাড়ি পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ে, এর মধ্যে নাটোরের রাজবাড়ি অন্যতম।
১২০ একর জমির উপর নির্মিত নাটোর রাজবাড়ির প্রথম রাজা হিসেবে রাজা রামজীবন প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। অনেকের মতে তিনি ১৭০৬ অথবা ১৭১০ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতায় আসেন। তিনি রাজত্ব করেন ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তিনি মৃত্যুবরণ করলে ১৭৩৪ খ্রিস্টাব্দে তার দত্তক পুত্র রামকান্ত এই রাজবাড়ীর রাজা হন এবং তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত নাটোরের রাজত্ব করেন।
রাজা রামকান্ত ১৭৩০ সালে বিয়ে করেন রাণী ভবানীকে। পরবর্তীতে ১৭৪৮ সালে রাজা রামকান্তের মৃত্যু হলে সেই সময় নবাব আলীবর্দী খাঁর নির্দেশে জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব নেন রাণী ভবানী। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে একের পর জমিদারি এলাকা বাড়াতে থাকেন। তার সময়ে বর্তমান রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর, রংপুর, পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, বীরভূম এবং মালদহ পর্যন্ত তার শাসন ব্যবস্থা বিস্তৃত হয়। নাটোর রাজবংশের মোট শাসনকাল ছিল প্রায় ২৪১ বছর। তার মধ্যে রাণী ভবানী ৫৪ বছর শাসন করে গিয়েছেন। তার শাসনামলে নাটোর রাজ পরিবারের সুনাম, খ্যাতি, মর্যাদা সবকিছু অর্জিত হয়। আর তখন থেকেই তিনি রানী ভবানী থেকে হয়ে ওঠেন মহারানী ভবানী।
আজও ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজবাড়ি। তবে এখন আর কোনো রাজা নেই রাজবাড়িতে। অর্ধবঙ্গেশ্বরীও আর নেই, নাটোরের মানুষজন যাঁকে এখনো বঙ্গমাতা বলে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। তবে এখনো রয়েছে ইতিহাস আর ঐতিহ্যের জৌলুস, যা দেখতে প্রতিদিনই আসে অগণিত দর্শনার্থী।
এখানে যা দেখা মিলবে
ছায়াঘেরা বিভিন্ন গাছপালায় ভরপুর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। দৃষ্টিনন্দন সব কারুকার্যখচিত ভবন, রাজার আমলের পুকুর। চোখজুড়ানো মন্দিরসহ বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা। রাজবাড়ীতে প্রবেশ করতেই সর্বপ্রথম নজরে পড়বে বিশাল আকৃতির একটা শান বাঁধানো পুকুর। আর তার দু’ধার দিয়ে বিভিন্ন ধরনের বিশাল সব গাছ। রাজবাড়ীর ভেতরে রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকলেই সামনে পড়বে তারকেশ্বর মন্দির। রাজাদের সময়ের মন্দির কত যে সুন্দর হতে পারে, এটা দেখার পর সেই কথাই মনে হবে। এই মন্দির দেখতে দেখতে কয়েক ধাপ এগিয়ে ডান পাশে তাকাতেই দেখা মিলবে বিশাল একটি মাঠ। এই মাঠের প্রান্তর থেকে দাঁড়ালেই নজর কেড়ে নেবে রাজবাড়ির একতলা ভবনটি।
একতলা এই ভবনটিকে পূর্বের নাম অনুসারে এখনো ডাকা হয় ছোট তরফ নামে। এর নাম ছোট তরফ হওয়ার কারণ বিশাল বড় রাজবাড়ির এটা একটা ছোট অংশ তাই। ছোট তরফ দেখতে দেখতে উল্টো পাশে তাকাতেই দেখে মিলবে ঠিক বড় তরফের। দুটি ভবনই রাজ এস্টেটের হিসাব ও জমিদারি শাসন চালানোর জন্য রাজকর্মচারীদের কার্যালয় ছিল। এই ভবন দুটির পাশেই অবস্থিত বিশাল পরিখা। তবে সমস্ত রাজবাড়িজুড়ে মোট পাঁচটি পুকুর রয়েছে।
নাটোরের এই রাজবাড়ির মূল আঙিনায় বিশালাকৃতির আটটি শিবমন্দির রয়েছে। আর এই মন্দিরগুলোতে ধর্মীয় রীতি-নীতি এখনো নিয়মিতভাবে পূজা অর্চনা করা হয়। সব মন্দিরের দেয়ালজুড়ে এখনো দৃশ্যমান প্রাচীন টেরাকোটার সব শিল্পকর্ম। আর এই আটটি মন্দিরকে ঘিরে অবলম্বন করে আছে একটি শিবমূর্তি। এখানে আরো দেখা মিলবে ফণা তোলা সাপের মূর্তি, একজন বাউল সাধকের মূর্তিসহ বিভিন্ন ধরনের শৈল্পিক সব চিত্রকর্ম। উপরে উঠতে সুবিধার জন্যে প্রত্যেকটি ভবনের পাশেই আছে সেই সময়ের লোহা দিয়ে নির্মিত সিঁড়ি।
যেভাবে যাবেন
ঢাকার কল্যাণপুর থেকে বাসের মাধ্যমে নাটোর সদর গিয়ে নামবেন। সেখান থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা এবং রিকশা মাধ্যেমে রাজবাড়ী যাওয়া যাবে। ট্রেনযোগে যেতে চাইলে ঢাকার কমলাপুর অথবা বিমানবন্দর রেলস্টেশন থেকে নাটোরের রেলস্টেশনে এসে নামতে হবে। সেখান থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা এবং রিকশার মাধ্যেম নাটোরের রাজবাড়ী যাওয়া যাবে।