মেঘের রাজ্য ‘সাজেক’ ভ্রমণ
- তুষার হাওলাদার
আকাশ ছোঁয়া পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে মেঘের রাজ্য ‘সাজেক’ দেখতে অতুলনীয়। যেদিকেই চোখ যায় দেখা মিলবে সারি সারি পাহাড় আর মাঝে মাঝে সাদা তুলোর মত মেঘের ভেলা। সাজেকের পাহাড়ে মেঘের আড়াল থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের দৃশ্য যেন এক স্বর্গীয় রূপ।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে রাঙামাটি জেলায় অবস্থিত সাজেক। সাজেকের একপাশের পাহাড়গুলো পড়েছে বাংলাদেশে আর অপর পাশের পাহাড়গুলো পড়েছে ভারতে। সাজেক থেকে ভারতের মিজোরাম মাত্র আট কিলোমিটার দূরে। ঢাকা থেকে সাজেক যেতে হলে প্রথমে ২৬১ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে খাগড়াছড়ি শহরে যেতে হবে। খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকে যেতে হবে জীপ গাড়িতে। যা চান্দের গাড়ি নামেই পরিচিত। ১০৫০০ টাকা খরচ করলেই পেয়ে যাবেন দুইদিন ঘুরার জন্য ১২ আসনের একটি চান্দের গাড়ি।
আর হ্যাঁ, মনে করে খাগড়াছড়ি শহর থেকে খাবার পানি কিনতে ভুলবেন না। যেই কয়দিন থাকবেন তার হিসাব করে খাবার পানি কিনে নিয়ে যাবেন। কারণ ওখানে পানির সংকট অনেক। তাই বলে ভাববেন না যে, পানি পাওয়া যাবে না। পানি ঠিকই পাবেন, কিন্তু খরচটা বেড়ে যাবে।
সাজেক যেতে হলে প্রথমে চান্দের গাড়িতে ২৩ কিলোমিটার পর পাড়ি দিয়ে যেতে হবে দীঘিনালায়। এরপর বাকি পথ যেতে হবে সামরিক বাহিনীর এসকোর্টে। দীঘিনালা থেকে সেনাবাহিনীর এসকোর্ট শুরু হয় সকাল ১০ টায়। তাই আপনাকে খাগড়াছড়ি থেকে দীঘিনালায় সকাল ১০টার আগেই পৌঁছাতে হবে। পাহাড়ে যাতে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে; তাই নিরাপত্তার স্বার্থে সেনাবাহিনী এই পদক্ষেপ নিয়েছে। দিঘীনালা পৌঁছে হাতে সময় থাকলে ঘুরে দেখে আসতে পারবেন হাজাছড়া ঝর্ণা।
দিঘীনালা থেকে বাগাইহাট, মাচালং বাজার, তারপর রুইলুই পাড়া হয়ে পৌঁছে যাবেন সাজেকে। খাগড়াছড়ি শহর থেকে সাজেক যেতে সময় লাগবে দুই থেকে তিন ঘন্টা। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তাধরে পথ চলা সাজেক ট্যুরের অন্যতম আকর্ষণ। পুরো রাস্তা জুড়ে চারপাশের দৃশ্য আপনাকে এক অপূর্ব শান্তি দেবে। সেই সাথে আপনার মন গাইতে থাকবে,
“লাল পাহাড়ির দেশে যা, রাঙামাটির দেশে যা
ইতাক তোকে মানাইছে না রে, ইক্কেবারে মানাইছে না রে।।”
সাজেক পৌঁছাতে দুপুর হয়ে যাবে। পৌঁছে ঠিক করে নিতে হবে রাত কাটাবার জন্য কটেজ। বিভিন্ন দাম ও মানের কটেজ রয়েছে। তবে ভালো হয় আগে থেকে কটেজ বুকিং করে নিলে। কটেজে এক রাতের খরচ জনপ্রতি ২০০ টাকা থেকে শুরু করে ১০,০০০ টাকা।
খাবার জন্য রয়েছে আদিবাসী ও বাঙ্গালি দুই ধরনের হোটেল। ভাত, মুরগী, ডিম, ডাল, ভর্তা সহ অন্যান্য খাবারও পাওয়া যাবে এখানে। চাইলে আদিবাসী হোটেল থেকে ‘ব্যাম্বু চিকেনের’ স্বাদও নিয়ে আসতে পারেন। তবে যেখানেই খান না কেন আপনাকে আগে থেকে অবশ্যই তা অর্ডার করে রাখতে হবে। আরেকটি মূল্যবান কথা সাজেকে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। সবকিছু সোলার পাওয়ারে চলে। এছাড়া নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জেনারেটর সার্ভিস দেয়া হয়। তাই মোবাইলের জন্য সাথে একটি পাওয়ার ব্যাঙ্ক থাকলে আর চিন্তা করতে হবে না। আরেকটি কথা সাজেকে রবি এবং টেলিটক ছাড়া কোনো অপারেটরের নেটওয়ার্ক নেই। তাই এই দুটি অপারেটরের যেকোন একটি সাথে রাখবেন।
এখন আসি ঘোরাঘুরির পর্বে। বিকালে রোদ পড়ে গেলে ঘুরে আসতে পারেন হ্যালিপ্যাড থেকে। সেখান থেকে উপভোগ করতে পারবেন সূর্যাস্ত। দেখবেন নীল আকাশ থেকে মেঘের ভেলা গুলো অন্ধকার আচ্ছন্ন হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে আর মিটমিট করে জ্বলে উঠছে তারা। সে কি অপূর্ব দৃশ্য। চাঁদের আলো, তারা ভরা আকাশ, সেই থাকে শরীর ছুঁয়ে যাওয়া মেঘের শীতল অনুভব সব মিলে তৈরি হবে স্বর্গীয় সুখ।
রাতে চাইলে বারবিকিউ পার্টি করতে পারেন। সাথে চলবে জমপেশ আড্ডা আর গান। রাত পার করে ভোরে সূর্যোদয় দেখতে চাইলে আবার চলে যাবেন হ্যালিপ্যাডে। উপভোগ করতে পারবেন সাদা মেঘের উপর সোনালি আভা পড়ার মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। তারপর নাস্তা শেষ করে চলে যেতে পারেন কংলাক পাহাড়ে।
কংলাক পাহাড় ঘোরা শেষ করে চলে যেতে পারেন কংলাক ঝর্ণায়। পাহাড়ি উঁচুনিচু রাস্তা পার করে যেতে হবে কংলাক ঝর্ণায়। প্রায় এক ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যাবেন কাঙ্ক্ষিত ঝর্ণায়। সেখানে ঝর্ণার শীতল জলে স্নানও করে নিতে পারেন। সাজেকে সাধারণত একরাতের বেশি থাকার প্ল্যান নিয়ে তেমন কেউ যায় না। তবে চাইলে থাকতে পারেন যতদিন খুশি ততদিন।
ফেরার দিন আবার সকাল ১০ টায় এসকোর্ট ধরে ফিরতে হবে। খাগড়াছড়ি ফিরতে ফিরতে দুপুর হয়ে যাবে। খাগড়াছড়ি শহরে এসে আলুটিলা গুহায় যেতে ভুলবেন না। এই গুহায় এক রোমাঞ্চকর অভিযান হবে আপনার। গুহার ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার, তাই সাথে টর্চ লাইট নিতে ভুলবেন না। অবশ্য স্মার্ট ফোন সাথে থাকলে আলাদা টর্চেরও প্রয়োজন নেই।
আলুটিলা যাওয়ার পথে কিছুক্ষণের জন্য ঘুরে আসতে পারেন টিলার উপর থেকে। এখান থেকে পুরো খাগড়াছড়ি শহর দেখতে পাওয়া যায়। খাগড়াছড়ি শহরে একটি ছোট্ট ঝুলন্ত ব্রীজ আছে। চাইলে দেখে আসতে পারেন সেটিও।
হাতে সময় থাকলে রিসং ঝর্ণাও ঘুরে আসবেন। রিসং গেট থেকে এক থেকে দেড় ঘন্টা পথ হেঁটে অতিক্রম করলেই দেখা মিলবে রিসং ঝর্ণার। তবে এর একটি বিশেষ দিক হল ঝর্ণার পথে ২৩৫ ধাপের সিঁড়ি দিয়ে নামতে হয়। এই ঝর্ণার উচ্চতা প্রায় ১০০ ফুট। চাইলে এখনেও গোসল করে নিতে পারেন। ঘোরাঘুরি শেষে ফিরে আসতে হবে খাগড়াছড়ি আর সেখান থেকেই পেয়ে যাবেন ঢাকা ফেরার বাস।
প্রকৃতির এই সৌন্দ্যর্য যারা উপভোগ করতে চাইছেন, তারা ঘুরে আসতে পারেন সাজেক। এক যুগ আগেও নিরাপত্তার অভাবে সাজেকে সেভাবে যেতেন না পর্যটকরা। এখন সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় পর্যটকদের সেখানে যাওয়া অনেকটাই সহজ হয়েছে। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হল পর্যটকদের অসতর্কতা এবং বেখেয়ালীপনায় অনেক জায়গাতে নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। তাই ময়লা আবর্জনা যথাযথ জায়গা ফেলার দিকে আমাদের সচেতন হতে হবে নয়তো একদিন বিলুপ্ত হবে এই মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।