ডিবেটর সাদ্দাম
সজীব হোসাইন, রংপুর : বন্ধু, আড্ডা, বিতর্ক—এ নিয়েই পথচলা। কৃষি বিজ্ঞানের পড়াশুনা যখন বাঁধাধরা নিয়মে করতে হয়, তখন তিনি বরাবরই বাঁধনহারা। পড়াশোনার শৃঙ্খল বেঁধে রাখতে পারেনি তাঁকে বইয়ের পাতায় আর ফটোকপির শীটে। কারণ বিতর্কের মঞ্চের প্রতি তাঁর প্রবল দুর্বলতা। বলছিলাম হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর বর্ষে অধ্যয়নরত সাদ্দাম হোসেনের কথা। সদা হাস্যোজ্জ্বল সাদ্দাম হোসেন ক্যাম্পাসে পরিচিত ‘ডিবেটর সাদ্দাম’ নামে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্ক অঙ্গনের প্রিয় মুখ সাদ্দাম ইতোমধ্যে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটির (এইচএসটিইউ)। বর্তমানে তিনি সংগঠনটির উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে জাতীয় পর্যায়ের বিতর্ক অঙ্গনে চলছে তাঁর পদচারণা। বর্তমানে তিনি ন্যাশনাল ডিবেট ফেডারেশন বাংলাদেশের (এনডিএফ বিডি) রংপুর বিভাগের প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির শুরু থেকেই বিতর্ক সংগঠনে যুক্ত হন সাদ্দাম। ২০১১ সালে বেসরকারী টেলিভিশন এটিএন বাংলায় আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক প্রতিযোগিতায় হাবিপ্রবির প্রতিনিধি দলের সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএফডিএফ কর্তৃক অনুষ্ঠিত আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক প্রতিযোগিতায় তিনি নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করেন। রংপুর বিভাগীয় বিতর্ক উৎসব’১৩ -এ বারোয়ারি বিতর্কে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন।
এছাড়া ডিবেট ওয়ারির্স কর্তৃক আয়োজিত রংপুর বিভাগীয় ‘ডিবেটরস হান্ট ১৩’- এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন সাদ্দাম। ২০১৪ সালে শিল্প মন্ত্রণালয় কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত ব্রান্ডিং কম্পিটিশনে হাবিপ্রবির প্রতিনিধিত্ব করেন সাদ্দাম হোসেন। তার দল ‘ডাইভার্সিফাইড দিনাজপুর’ কাটারিভোগ চাল নিয়ে প্রতিযোগিতায় বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন হন। ২০১৫ সালে অষ্টম জাতীয় বিতর্ক উৎসবে আঞ্চলিক ভাষায় রংপুর বিভাগের প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি, যা চ্যানেল আই-এ প্রচারিত হয়। ২০১৪ সালে রংপুর বইমেলা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আয়োজিত বিতর্ক প্রতিযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং চ্যাম্পিয়ন হয় তাঁর দল। ২০১৫ সালে আইসিটি মন্ত্রণালয় কর্তৃক আয়োজিত ‘আইসিটি বিতর্ক প্রতিযোগিতা’য় রংপুর বিভাগীয় রানার আপ হন সাদ্দাম।
সম্প্রতি জাতীয় বিতর্ক উৎসব’১৬ -তে রংপুর বিভাগের প্রতিনিধির দায়িত্বপালন করে ‘স্টার অর্গানাইজার’ হিসাবে ক্রেস্ট লাভ করেন।
শুধু বিতার্কিক নন বিচারক হিসেবেও ন্যাশনাল ডিবেট ফেডারেশন বাংলাদেশের (এনডিএফবিডি) স্কুল ডিবেট চ্যাম্পিয়শীপে রংপুর বিভাগের ও বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে অনুষ্ঠিত আন্তঃক্যান্ট বিতর্ক প্রতিযোগিতা’১৫-তে বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন সাদ্দাম। কথা বলতে বলতে নিজের সম্পর্কে এভাবেই জানাচ্ছিলেন সাদ্দাম।
বিতর্ক সংগঠনের পাশাপাশি অন্যান্য সংগঠনেও রয়েছে তাঁর দীপ্ত পদচারণা। বিশ্ববিদ্যালয়ের রোটারেক্ট ক্লাবের ডিরেক্টর অব কমিউনিটি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এছাড়া দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার তত্ত্বাবধায়নে পরিচালিত ‘বন্ধু প্রতিদিন’ -এর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার প্রতিষ্ঠাকালীন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। নিজের এলাকায় বেশ কয়েকজন বন্ধু মিলে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘দ্য থার্ড আই এ্যাসোসিয়েশন’। সংগঠনটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
ছোটবেলার কথা বলতেই মুহুর্তের মধ্যেই হারিয়ে যান মেঠো পথের বাঁকে। লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার জাওরাণী গ্রামেই তাঁর যত গল্প। প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক জীবন কাটে নিজ এলাকাতেই।
বিতর্কমঞ্চের সাদ্দাম পড়াশোনায় ছোট বেলা থেকেই মেধাবী। অষ্টম শেণিতে পেয়েছেন বৃত্তি। মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পেয়েছেন জিপিএ-৫। এরপর ভর্তি হন হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কৃষি বিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক সম্পন্ন করা সাদ্দাম কৃষিবিদ সাদ্দাম হোসেন বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন। সাদ্দামের মতে, ‘কৃষিই কৃষ্টি; কৃষিই প্রাচীতম শিল্প!’
ধীরে ধীরে সাহিত্যক্ষেত্রেও একটু একটু করে এগোচ্ছেন এই বিতার্কিক। ‘বাংলা কবিতা’, ‘তারুণ্য’ সহ কয়েকটি ব্লগে লেখেন তিনি। ব্লগে নিয়ে প্রশ্ন করতেই সাদ্দাম বলেন, ‘ব্লগ নিয়ে আমাদের ভ্রান্ত ধারনা আছে। ব্লগকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়। ব্লগার মানেই খারাপ কিছু নয়।’
বিতর্কমঞ্চের এই বক্তা কবিতা ও গল্প লেখাতেও সিদ্ধহস্ত। ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গল্প ও কবিতা। ২০১৫ সালের বইমেলায় প্রকাশিত ‘রেডিওমুন্না ফিচারিং আমাদের গল্প’ নামক বইয়ে তার লেখা ‘একা’ গল্প ব্যাপক পাঠক সমাদ্রিত হয়। ওই বছরই লেখচিত্র প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘গল্পদ্য’ বইয়ে স্থান পায় ‘সীমান্তের ওপারে’ নামক আরও একটি গল্প। বাংলাদেশ সাহিত্যপ্রেমী পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত ‘কবিতার খাম’ নামক কাব্য সমগ্রে স্থান পায় তার রচিত পাঁচটি কবিতা। এবারের বইমেলায় বিভাস প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘শব্দ ছুঁয়ে স্বপ্ন নিয়ে’ নামক গল্পগ্রন্থে স্থান পেয়েছে ‘বিধবা জননী’ নামক গল্প। সিলেটের সাহিত্যপত্র ‘পিঁপড়া’য় তাঁর লেখা গল্প ধারাবাহিকভাবে ছাপানো হয়।
প্রিয় মানুষ সম্পর্কে জানতে চাইলে দ্বিধাহীন কন্ঠে জবাব দেন, তাঁর প্রিয় মানুষ মা। আর সাথে সাথে বলেন, বাবাই তাঁর জীবনের আদর্শ।
জীবনের লক্ষ্য কী জানতে চাইলে বলেন, ‘একদিন বড় হব।’ জানতে চাইলাম, কত বড়? তিনি বললেন, ‘বড় শব্দটার কোনো মাপ নেই, সীমানাও নেই।’ উত্তরেই বোঝা গেল, জীবনে বড় হবার দৌড়ে ক্ষান্ত হবেন না তিনি।
কিন্তু মেধাবী এই কৃষিবিদ কি বড় কৃষি বিজ্ঞানী হবেন? নাকি এই সফল বিতার্কিক আরো বড় বিতার্কিক হবেন? নাকি গুছিয়ে গল্প-কবিতা লিখা এই লেখক একদিন বড় সাহিত্যিক হবেন? স্পষ্ট উত্তর পাওয়া গেল না তাঁর মুখ থেকে। ধোঁয়াশা যেন থেকেই গেল! তাঁর মতে, ‘কিছু রহস্যের সমাধান না হওয়াই ভালো। না-হলে রহস্যের পিছনে মানুষ ছুটবে না।’