মেধাবীরা উঠে আসছে না বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায়
- সুমন আফসার
সবার আগে দরকার মেধার ক্ষেত্র তৈরি। মেধাবীদের আকৃষ্ট করার পাশাপাশি থাকতে হবে তা পরিচর্যার পরিবেশ। নিশ্চিত করতে হবে তাদের ধরে রাখার মতো পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা। সর্বোপরি থাকতে হবে বৈশ্বিক জ্ঞানলাভের সুযোগ। এসবের মধ্য দিয়েই বেড়ে ওঠে মেধাবীরা। কিন্তু বাংলাদেশ এর সবগুলোতেই রয়েছে অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে। আর এ পিছিয়ে থাকার মূলে রয়েছে দেশের বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থা। এ দুর্বলতার কারণেই উঠে আসছে না মেধাবীরা।
সম্প্রতি ‘দ্য গ্লোবাল ট্যালেন্ট কমপিটিটিভনেস ইনডেক্স ২০১৫-১৬’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যৌথভাবে ব্যবসায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইনসিড, অ্যাডেকো গ্রুপ ও হিউম্যান ক্যাপিটাল লিডারশিপ ইনস্টিটিউট। প্রতিবেদনটি তৈরির ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে ছয়টি স্তম্ভ। এগুলো হলো— এনাবল, অ্যাট্রাক্ট, গ্রো, রিটেইন, লেবার অ্যান্ড ভোকেশনাল স্কিল ও গ্লোবাল নলেজ স্কিল, যার সবগুলোতেই বাংলাদেশ রয়েছে পেছনের সারিতে।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তি, কারিগরি শিক্ষার সুযোগ, উচ্চশিক্ষার মান, বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার মান, প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়ন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার, স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ— মেধাবীদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এগুলোকে ধরা হয় গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসেবে। এগুলোর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। প্রতিবেদনে এগুলোকে প্রকাশ করা হয়েছে গ্রো স্তম্ভের মধ্য দিয়ে।
এনাবল স্তম্ভটির মধ্যে রয়েছে সরকারের দক্ষতা, বেসরকারি খাতের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, ব্যবসার পরিবেশ, গবেষণা ও উন্নয়নে ব্যয়, শ্রমিক-মালিকের পারস্পরিক সম্পর্ক, পেশাগত ব্যবস্থাপনা, তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো, প্রযুক্তি ব্যবহারের মতো বিভিন্ন বিষয়। গত কয়েক বছরে দেশে এগুলোর কিছু ক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটলেও, দুর্বলতা রয়ে গেছে অনেকগুলোতেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বণিক বার্তাকে বলেন, সঠিক পরিকল্পনার অভাব রয়েছে এক্ষেত্রে। আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনা নিতে হবে। কাজের সুযোগ রয়েছে, এমন বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রয়োজন। তা না হলে দক্ষ মানবসম্পদের অভাব যেমন থাকবে, তেমনি মেধার বিকাশও বাধাগ্রস্ত হবে।
মেধাবীদের বিকাশের সুযোগের পাশাপাশি তাদের কাজের ক্ষেত্র তৈরি ও ধরে রাখার বিষয়টিও প্রতিবেদনের সূচকে প্রতিফলিত হয়েছে। এক্ষেত্রে জীবনযাত্রার মান, পেনশন ব্যবস্থা ও কর; বিদেশী বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মক্ষেত্র তৈরি, মেধাবীদের ধরে রাখা ও লিঙ্গসমতা; শ্রমপরিবেশের উন্নয়ন ও শ্রমের উত্পাদনশীলতা এবং উচ্চশিক্ষিত শ্রমশক্তি, গবেষক ও পেশাজীবী তৈরির মতো বিষয়গুলো উঠে এসেছে রিটেইন, অ্যাট্রাক্ট, লেবার অ্যান্ড ভোকেশনাল স্কিল ও গ্লোবাল নলেজ স্কিল স্তম্ভের মধ্য দিয়ে। এসব সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান বেশ দুর্বল।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এনাবল স্তম্ভে ১০৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৫, অ্যাট্রাক্ট স্তম্ভে ৯১, গ্রো স্তম্ভে ১০৮, রিটেইন স্তম্ভে ৯৭, লেবার অ্যান্ড ভোকেশনাল স্কিল স্তম্ভে ৮১ ও গ্লোবাল নলেজ স্কিল স্তম্ভে ৯১তম। আর সব স্তম্ভের ভিত্তিতে ১০৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০০তম। এক্ষেত্রে ১০০-এর মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ৩০ দশমিক ৮৯। তালিকার শীর্ষে রয়েছে সুইজারল্যান্ড। দেশটির স্কোর ৭২ দশমিক ৬৪৮। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে ভারত ও শ্রীলংকা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একটা অবস্থান তৈরি হয়েছে আমাদের। তবে এ অবস্থানেই আটকে রয়েছি কয়েক বছর ধরে। এজন্য মানসম্মত শিক্ষা ও এ খাতে সুশাসন নিশ্চিতের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।
এদিকে সম্প্রতি ‘দ্য হিউম্যান ক্যাপিটাল রিপোর্ট ২০১৬’ প্রকাশ করেছে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ)। প্রতিবেদন অনুযায়ী, শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিতে ১৩০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৪তম। ১০০-এর মধ্যে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর ৫৭ দশমিক ৮৪, যা গত বছর ছিল ৫৭ দশমিক ৬২। গত বছর এ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২৪টি দেশের মধ্যে ৯৯তম।
তালিকায় থাকা দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি দেশের মধ্যে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিতে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় রয়েছে শ্রীলংকা। ৭১ দশমিক ৬৯ স্কোর নিয়ে দেশটির অবস্থান ৫০তম। ৬১ দশমিক ৮৩ স্কোর নিয়ে ভুটান রয়েছে তালিকার ৯১তম স্থানে, ৫৭ দশমিক ৭৩ স্কোর নিয়ে ভারত ১০৫, নেপাল ৫৭ দশমিক ৩৫ স্কোর নিয়ে ১০৮ ও ৫৩ দশমিক ১ স্কোর নিয়ে ১১৮তম স্থানে রয়েছে পাকিস্তান।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক মানবসম্পদের চিত্রটি আগের তুলনায় অনেক বেশি জটিলতর হয়ে উঠেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতিদিন ২৫ হাজার নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। আর এ সময়ে বিশ্বব্যাপী ২০ কোটির বেশি মানুষ কর্মহীন থাকবে। আগামী দশকগুলোয় প্রায় পাঁচ কোটি উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীর ঘাটতি থাকবে।
হিউম্যান ক্যাপিটাল ইনডেক্সে বৈশ্বিকভাবে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে ফিনল্যান্ড। দেশটির স্কোর ১০০-এর মধ্যে ৮৫ দশমিক ৮৬। ৮৪ দশমিক ৬৪ স্কোর নিয়ে দ্বিতীয় নরওয়ে, ৮৪ দশমিক ৬১ নিয়ে তৃতীয় সুইজারল্যান্ড, ৮৩ দশমিক ৪৪ স্কোরে চতুর্থ জাপান ও ৮৩ দশমিক ৪৪ স্কোর নিয়ে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে সুইডেন। শীর্ষ দশে এর পরের অবস্থানগুলোয় রয়েছে যথাক্রমে নিউজিল্যান্ড, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, কানাডা ও বেলজিয়াম।
মূলত দুটি স্তম্ভ শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ভিত্তিতে সূচকটি প্রণয়ন করা হয়েছে। এগুলোর ফলাফল পরিমাপ করা হয়েছে শূন্য থেকে ১০০-এর একটি স্কেলে। সবচেয়ে ভালো অবস্থান প্রকাশ করা হয়েছে ১০০ স্কোরের মাধ্যমে। আর পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন বয়স শ্রেণীর ক্ষেত্রে এ ফলাফল বিবেচনায় নেয়া হয়।
অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, প্রতিবেদনটিতে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিতে বাংলাদেশের অবস্থা যে আশাব্যঞ্জক নয়, এমন চিত্রই উঠে এসেছে। উচ্চশিক্ষার চিত্র এখনো খুবই করুণ। তার ওপর কর্মসংস্থানের সঙ্গে অনেকটাই সামঞ্জস্যহীন অবস্থায় রয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থা।
প্রতিবেদনে প্রতিটি স্তম্ভের অধীনে কয়েকটি উপসূচক রয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষার ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির হার, শিক্ষিতের হার, শিক্ষার গুণগত মান, বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও কাজ করতে গিয়ে শেখার হার। আর কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়গুলো হলো— কর্মক্ষম মানুষের চাকরিতে নিয়োজিতের হার, বেকারত্বের হার, আংশিক বেকারত্ব, দীর্ঘমেয়াদি বেকারত্ব, দক্ষতা, শিশুদের কাজে নিয়োজিতের হার। এর সব ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, সার্বিকভাবে শিক্ষা খাতে কাঠামোগত কিছু দুর্বলতা রয়েছে। শিক্ষার মানের দিক দিয়ে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। এ থেকে বেরিয়ে আসতে শিক্ষার মান, শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় নিয়মিত পরিদর্শনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।