শস্য আবাদে কৃষকের দরিদ্রতা বাড়ছে
- নিউজ ডেস্ক
প্রতি কেজি বোরো ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ হচ্ছে প্রায় সাড়ে ১৮ টাকা। এ ধান বিক্রি থেকে কৃষক পাচ্ছেন ১৫ টাকা ২০ পয়সা। এতে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে কৃষকের লোকসান হচ্ছে ৩ টাকার বেশি।
গম উৎপাদনে বোরো ধানের মতো লোকসান না হলেও কাঙ্ক্ষিত মুনাফা হচ্ছে না। হেক্টরপ্রতি সর্বোচ্চ ফলন পাওয়া গেলে প্রতি কেজি গম উৎপাদনে খরচ পড়ছে প্রায় ১৫ টাকা। বাজার ঠিক থাকলে এ পরিমাণ গম বিক্রি থেকে কৃষক পাচ্ছেন ১৭ টাকা। তবে উৎপাদন কম হলে কেজিপ্রতি উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এতে কমে আসছে মুনাফার পরিমাণ। কখনো কখনো লোকসানের আশঙ্কাও থাকছে। সম্প্রতি গমে ব্লাস্ট রোগের আক্রমণের ঘটনা এ আশঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে।
একই অবস্থা অন্যসব শস্যেরও। কোনো শস্যেই ঠিকমতো মুনাফা ঘরে তুলতে পারছেন না কৃষক। এমনকি লোকসান দিয়েও উৎপাদন করতে হচ্ছে কোনো কোনো শস্য। এতে ঋণের দায়ে জর্জরিত হচ্ছেন কৃষক। দরিদ্রতার মাত্রা বিস্তৃত হচ্ছে তাদের মধ্যে।
শস্যে কৃষকের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে সরকারি সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের (ডিএএম) তথ্যেও। সংস্থাটির দেয়া হিসাব বলছে, পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশে শস্যের গড় দাম কমছে। ২০১০ সালে প্রতি টন শস্যের গড় দাম ছিল যেখানে ১৯ হাজার ১৯১ টাকা, ২০১৪ সালে তা নেমে আসে ১৭ হাজার ৫০০ টাকায়। ২০১৫ সালের হিসাব এখনো চূড়ান্ত করা না হলেও প্রাথমিক তথ্যে তা আরো কমার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। মাঝের বছরগুলোয় ২০১১ সালে প্রতি টন শস্যের গড় দাম ছিল ১৯ হাজার ৬১০ টাকা, ২০১২ সালে ১৭ হাজার ১৬৬ টাকা ও ২০১৩ সালে ১৭ হাজার ৭১০ টাকা।
শস্যের গড় দাম কমলেও প্রতি বছরই বাড়ছে উৎপাদন খরচ। সরকারের খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০১০ সালে প্রতি কেজি বোরো ধানের উৎপাদন খরচ ছিল ১৩ টাকা ৩২ পয়সা। পরের বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ টাকা ৬৫ পয়সায়। ২০১২ সালে উৎপাদন খরচ আরো বেড়ে হয় ১৫ টাকা ৭৬ পয়সা ও ২০১৩ সালে ১৬ টাকা ৮১ পয়সা। পরের দুই বছর এ খরচ আরো বেড়ে ১৭ টাকা ২০ পয়সা ও ২০ টাকা ৭০ পয়সায় দাঁড়িয়েছে।
ধানের মতোই বেড়েছে গমের উৎপাদন খরচও। ২০১৩ সালে প্রতি কেজি গমের উৎপাদন খরচ ছিল ২১ টাকা ৫০ পয়সা। ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৪ টাকা ৫০ পয়সা ও ২০১৫ সালে ২৬ টাকায়। আর ২০১৬ সালের প্রাথমিক হিসাবে এ ব্যয় ২৭ টাকা ছাড়িয়েছে।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) মহাপরিচালক হামিদুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, শস্য আবাদে কৃষকের মুনাফা নিশ্চিত করতে সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। প্রয়োজন অনুযায়ী শস্যের জাত ও উপকরণ সঠিক সময়ে কৃষকদের মাঝে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। যেসব এলাকায় দুটি ফসল আবাদ হয়, সেখানে তিনটি ফসল আবাদের পরিকল্পনা কৃষকদের দেয়া হয়েছে। প্রচলিত শস্য আবাদের পাশাপাশি বাড়তি একটি শস্য আবাদ করেও মুনাফা তুলতে পারছেন কৃষক। অন্যদিকে উৎপাদন খরচ কমাতে কৃষককে ভর্তুকি-সহায়তার পাশাপাশি সার ও উপকরণ পরিমিত মাত্রায় ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এছাড়া উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শ্রম খরচ কমিয়ে আনারও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সম্প্রতি ভারত, চীন ও বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যের ওপর গবেষণায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং আন্তর্জাতিক খাদ্য ও নীতিগবেষণা প্রতিষ্ঠানও (ইফপ্রি) দেখিয়েছে, বাংলাদেশের কৃষকরা ফসলের দাম সবচেয়ে কম পান। গবেষণায় বলা হয়েছে, কৃষকের উৎপাদন খরচ কমাতে সরকারের দেয়া বিভিন্ন ধরনের ভর্তুকি স্বাভাবিকভাবে সঠিক মাত্রায় কার্যকর হচ্ছে না। সুবিধাভোগী নির্বাচনে প্রথাগত পদ্ধতি অনুসরণ করায় এর সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দেশের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক। ভর্তুকির প্রচলিত ব্যবস্থাও প্রান্তিক কৃষককে বঞ্চিত করছে। ফলে উৎপাদন খরচ কমাতে পারছেন না কৃষক।
কৃষক কাঙ্ক্ষিত মুনাফা না পেলেও প্রতি বছরই বাড়ছে প্রধান প্রধান শস্য উৎপাদন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রধান পাঁচ শস্যের মোট উৎপাদন ছিল ৪ কোটি ৫ লাখ ৩০ হাজার টন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রাথমিক হিসাবে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ১৩ লাখ ৯৫ হাজার টনে। অর্থাত্ এক বছরের ব্যবধানে পাঁচটি প্রধান শস্য উৎপাদন বেড়েছে ৮ লাখ ৭৫ হাজার টন। এর মধ্যে চাল উৎপাদন বেড়েছে ৩ লাখ ৫৩ হাজার টন, গম ৪৪ হাজার ৯২৮ ও ভুট্টা ১ লাখ ৪৮ হাজার ৪২৮ টন।
তবে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে না পারলে কৃষক শস্য উৎপাদনে নিরুত্সাহিত হতে পারে বলে জানান বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, কৃষক যদি সঠিক দাম না পান কিংবা ভর্তুকির অর্থের সুবিধা দিয়ে উৎপাদন খরচ কমাতে না পারেন, তাহলে শস্য আবাদে তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হবে না। ফলে আবাদ কমিয়ে তারা অন্য পেশায় স্থানান্তর হতে পারেন, যার প্রভাব পড়বে সার্বিক শস্য উৎপাদনে। এতে দেখা দিতে পারে খাদ্য সংকট। কৃষকের উন্নয়নে তাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
দেশে ২ কোটি ৫৩ লাখ ৫০ হাজার কৃষক রয়েছেন। তার মধ্যে ৮৪ শতাংশ কৃষকই ক্ষুদ্র কিংবা প্রান্তিক, যাদের জমির পরিমাণ শূন্য দশমিক শূন্য ৫ থেকে আড়াই একরের নিচে। ফলে জীবনমানের বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে রয়েছেন এসব কৃষক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্ষুদ্রায়তনের জমি ও প্রযুক্তির অভাব মোকাবেলা করেই শস্য উৎপাদন করতে হচ্ছে কৃষকদের। পাশাপাশি রয়েছে কৃষকের জ্ঞানের স্বল্পতা আর জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিও। ফসলোত্তর ক্ষতি, আবাদে আঞ্চলিক বৈষম্য ও উপকরণ ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় শস্য আবাদে কৃষককে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। আবার উৎপাদন খরচ কমাতে সরকারের দেয়া বিভিন্ন ধরনের ভর্তুকির কার্যকারিতাও খুব কম। একদিকে যেমন কৃষক শস্যের দাম পাচ্ছেন না, অন্যদিকে ভর্তুকির অর্থের সুবিধা ঠিকমতো না পাওয়ায় উৎপাদন খরচও কমানো যাচ্ছে না। তাই শস্য আবাদে কৃষককে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হলে এ খাতের কৃষকদের উপকরণসহায়তা বাড়ানোর পাশাপাশি প্রযুক্তি সম্প্রসারণ, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষণে আরো বিনিয়োগ প্রয়োজন।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া বলেন, বর্তমানে কৃষি উপকরণে সরকারের যেসব সহায়তা রয়েছে, তার বেশির ভাগই যাচ্ছে বোরো ধানে। ফলে ফসলটি আবাদে কৃষককে প্রকৃত খরচের মুখাপেক্ষী হতে হচ্ছে না। এখন সময় এসেছে অন্যান্য ফসল আবাদে জোর দেয়ার। কেননা বোরো ধান আবাদে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ বাড়ছে। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ভয়ানকভাবে নিচে নেমে গেছে। তাই আমন ধান, গম ও ভুট্টা আবাদে জোর দেয়ার কোনো বিকল্প নেই। আর কৃষককে সর্বোচ্চ মুনাফা দিতে হলে নতুন জাত উদ্ভাবন করা ছাড়াও প্রকৃত বাজারমূল্য নিশ্চিত করতে সরকারকে নানামুখী পদক্ষেপ নিতে হবে।