বৈধতা পাচ্ছে কোচিং-টিউশনি, সহায়ক বই থাকবে
- নিউজ ডেস্ক
শিক্ষা আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর যে কটি বিষয়ে আন্দোলন ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল, সেগুলোর বিষয়ে নমনীয় অবস্থান গ্রহণ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। জেল-জরিমানার আওয়াজ তুলে শেষ পর্যন্ত সহায়ক বা অনুশীলন বই প্রকাশের ক্ষেত্রে অনুমোদন নেওয়ার বিষয়টিও বাদ দেওয়া হয়েছে। কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনির বিরুদ্ধে ‘কড়া’ অবস্থান থেকে সরে ‘ছায়া শিক্ষা’ হিসেবে কৌশলে এর বৈধতা দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
শিক্ষা আইনের চূড়ান্ত খসড়ায় এসব বিষয় রয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ইতিমধ্যে খসড়াটি মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আশা করছেন, শিগগিরই এটি মন্ত্রিসভার বৈঠকে উঠবে এবং অনুমোদন হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রণয়ন করা শিক্ষা আইনের চূড়ান্ত খসড়ায় এসব পরিবর্তন আনার ফলে দীর্ঘ মেয়াদে শিক্ষার মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন শিক্ষাবিদদের অনেকে। তাঁরা বলছেন, মন্ত্রণালয়ের হুমকি-ধমকি ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার পরও নোটবইয়ের আদলে ভিন্ন নামে চলা সহায়ক বা অনুশীলন বই এবং কোচিং-প্রাইভেটের দৌরাত্ম্য ঠেকানো যায়নি। এখন কোনো রকম আইনি নিষেধাজ্ঞা বা ন্যূনতম নিয়ন্ত্রণ না থাকলে মূলধারার শিক্ষা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মূল বই পড়া বা শ্রেণিকক্ষে লেখাপড়ার অবস্থা আরও খারাপ হবে।
শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কোচিং ব্যবসায়ী, নোট-গাইডের ভিন্ন নামে সহায়ক বা অনুশীলন বইয়ের প্রকাশক, কওমি মাদ্রাসায় নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠনগুলোর নেতারা এই আইনের ফলে এখন খুশি হবেন। প্রাথমিক খসড়া ওয়েবসাইটে দেওয়ার পর এসব পক্ষ আন্দোলন করেছিল।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয় জেল-জরিমানার বিধান রেখে আইনটির প্রাথমিক খসড়া ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। তখন ওই সব গোষ্ঠী ব্যাপকভাবে ক্ষুব্ধ হয়। সরকারের বিভিন্ন মহলে, বিশেষ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে দেনদরবার করে তারা নিজেদের দাবি আদায়ের চেষ্টা করে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এটা বিস্ময়কর ও দুঃখজনক। নোট-গাইড, সহায়ক বা অনুশীলন বই—যে নামেই বলা হোক, এগুলো শিক্ষার কোনো কাজে আসে না। এগুলো পড়ে নম্বর বেশি পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু আসল শিক্ষা হবে না। কোচিং, টিউশনি ও সহায়ক বইয়ের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের এই নমনীয় মনোভাবের কড়া সমালোচনা করে তিনি বলেন, তাহলে এত বছর ধরে এগুলো বন্ধে জাতীয় সংসদ, উচ্চ আদালত, পুলিশ, প্রশাসন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টরা যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, সেগুলো সঠিক ছিল না বলতে হবে।
কোচিং–প্রাইভেট ‘ছায়া শিক্ষা’!
কোচিং-প্রাইভেট বন্ধ না করে চূড়ান্ত খসড়ায় বলা হয়েছে, প্রাইভেট টিউশনসহ ছায়া শিক্ষা (শ্যাডো এডুকেশন) প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ ও তদারকের জন্য সরকার আলাদা নীতিমালা বা বিধি প্রণয়ন করবে। ছায়া শিক্ষা বলতে সরকারি বা স্বীকৃতি পাওয়া বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে কোনো ব্যক্তি বা শিক্ষকের উদ্যোগে একাধিক শিক্ষার্থীকে কোনো প্রতিষ্ঠানে বা কোনো নির্দিষ্ট স্থানে অর্থের বিনিময়ে পাঠদান কার্যক্রমকে বোঝাবে। কোনো ছায়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রমের অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্ত করে সরকার বন্ধের উদ্যোগ নেবে।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বলেছেন, দেশে এখন ৩২ হাজার কোটি টাকার কোচিং–বাণিজ্য। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে এই কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থানের কথা বলা হয়েছে। এর আগে গত এপ্রিল মাসে মানুষের মতামতের জন্য শিক্ষা আইনের যে খসড়া মন্ত্রণালয় ওয়েবসাইটে দিয়েছিল, তাতেও বলা হয়, কেউ প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং করালে কমপক্ষে দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা ছয় মাসের কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে।
সেই অবস্থান থেকে সরে আসার বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা গতকাল দাবি করেন, চাইলেই কোচিং-টিউশন হঠাৎ করে বন্ধ হবে না। তাই এটি কীভাবে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ ও মনিটর করা যায়, সে জন্যই নীতিমালা বা বিধিমালা প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে।
সহায়ক বা অনুশীলন বই
জেল-জরিমানা দূরে থাক, অনুমোদন নিয়ে সহায়ক পাঠ্যপুস্তক প্রকাশের সুযোগও রাখেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মতামতের জন্য দেওয়া খসড়ায় বলা হয়েছিল, সহায়ক বই প্রকাশে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) অনুমোদন লাগবে। এই বিধান বাদ দিতে প্রকাশকেরা আন্দোলন করে আসছেন।
এখন চূড়ান্ত খসড়ায় নোট বা গাইড বই নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে, যদিও সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হওয়ার পর এই নামের বই আর নেই। এখন অনুমোদন ছাড়াই ‘সহায়ক পুস্তক’ প্রকাশের সুযোগ রাখা হয়েছে, যা নোট-গাইডের একধরনের বিকল্প এবং সহায়ক বই বা অনুশীলন বই নামে পরিচিত।
এ বিষয়ে খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো প্রকাশক বা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি কেবল সহায়ক পুস্তক বা ডিজিটাল শিখন-শেখানো সামগ্রী প্রকাশ করতে পারবেন। কিন্তু কোনো ধরনের নোটবই, গাইড বই বা নকল মুদ্রণ, বাঁধাই, প্রকাশ ও বাজারজাত করা যাবে না। শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নোট-গাইডের কথা বলে ধূম্রজাল সৃষ্টি করে প্রকৃতপক্ষে যেকোনো ধরনের বই নির্বিঘ্নে প্রকাশের আইনি সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
মতামতের জন্য দেওয়া আগের খসড়ার ওপর গত এপ্রিলে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রায় ৩০০ মতামত পাওয়া গিয়েছিল। তখন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেছিলেন, অধিকাংশ মতামতেই প্রাইভেট টিউশন, কোচিং এবং নোট-গাইড বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, যেসব কারণে ছাত্রছাত্রীরা কোচিং-প্রাইভেট টিউশন করতে যায়, সেগুলো দূর করতে হবে। আর এ জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন উপযুক্ত ও চমৎকার বই প্রণয়ন করা। পাঠ্যবই পড়েই যাতে একজন শিক্ষার্থী সবকিছু বুঝতে ও জানতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
কায়কোবাদ বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যাপ্ত ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। তাঁদের প্রশিক্ষণটাও জরুরি। অবকাঠামো বাড়াতে হবে।
জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইন বলেন, মন্ত্রিসভায় পাঠানোর জন্য তিনি এ-সংক্রান্ত ফাইলে সই করেছেন। এ বিষয়ে তিনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আইন ও অডিট) মো. আবদুল্লাহ আল হাসান চৌধুরী বলেন, জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে শিক্ষা আইনের খসড়াটি চূড়ান্ত করে মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। এটি কার্যকর হলে শিক্ষায় ইতিবাচক ফল আসবে বলে মনে করেন তিনি।
শিক্ষা আইনের অন্যান্য প্রসঙ্গ
বর্তমানে প্রাক্-প্রাথমিক (শিশুশিক্ষা) শিক্ষা পাঁচ বছর থেকে এক বছর মেয়াদি। শিক্ষা আইনের চূড়ান্ত খসড়া অনুযায়ী প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা হবে দুই বছর মেয়াদি, চার থেকে ছয় বছর বয়স পর্যন্ত। আর জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে প্রাথমিক শিক্ষা প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি, মাধ্যমিক শিক্ষা হবে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে নিজ নিজ ধর্ম, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাঙালি সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নিজ নিজ সংস্কৃতির বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
খসড়ায় বলা হয়, বিদেশি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আওতায় ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেল বা সমপর্যায়ে শিক্ষাদানের পাঠক্রমেও সাধারণ ধারার সমপর্যায়ের বাংলা, বাংলাদেশের অভ্যুদয়, বাংলাদেশ শিক্ষাসহ সময়ে সময়ে সরকার-নির্ধারিত বিষয়গুলো বাধ্যতামূলকভাবে অন্তর্ভুক্ত হবে। এতে আরও বলা হয়, সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনো অবস্থাতেই কোনো বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। কেউ এটি করলে এ জন্য অনধিক তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা ছয় মাসের কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড ভোগ করতে হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীকে কোনো প্রকার শারীরিক শাস্তি ও মানসিক নির্যাতন করা যাবে না। কেউ তা করলে এই অপরাধের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে চাকরিবিধি অনুযায়ী পেশাগত অসদাচরণের অভিযোগে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। আগের খসড়ায় এই অপরাধের অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা তিন মাসের কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড ভোগের বিধান রাখা হয়েছিল। এ ক্ষেত্রেও নমনীয় হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
সরকার কওমি মাদ্রাসার মানোন্নয়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে খসড়ায় বলা হয়েছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়ে এর বিস্তারিত বলা নেই। প্রাথমিক খসড়া ওয়েবসাইটে দেওয়ার পর কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠনগুলো আন্দোলন শুরু করে। এখন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কিছুটা নমনীয় হয়েছে।
চূড়ান্ত খসড়ায় বলা হয়, সরকার অনুমোদিত বাংলা মাধ্যম ও ইংরেজি ভার্সনের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বেতন ও অন্যান্য ফি সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ডের অনুমোদনে হতে হবে। অনুমোদন ছাড়া কোনো রকম বেতন বা ফি গ্রহণ করা যাবে না। কেউ এটি করলে এ জন্য দায়ীদের অনধিক পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা এক বছরের কারাদণ্ড অথচ উভয় দণ্ড ভোগ করতে হবে।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, শ্রেণিকক্ষের শিক্ষাই আসল শিক্ষা হলেও এই শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা এবং মূল বই পড়ার প্রবণতা এমনিতেই কমে আসছে। তার ওপর যদি এমন সব আইন করা হয় তাহলে শিক্ষা–বাণিজ্যের ব্যাপ্তি আরও বেড়ে যাবে। পড়াশোনা বাদ দিয়ে প্রশ্ন ও পরীক্ষার দিকেই ঝোঁক বাড়তে থাকবে।