পুলিশ ক্যাডারে পদ ও পদোন্নতি বাড়ছে?
- নিউজ ডেস্ক
প্রশাসন ক্যাডারের আদলে পদ ও পদোন্নতি চায় পুলিশ ক্যাডার। বছরের পর বছর পদোন্নতিবঞ্চিত পুলিশের অনেক ক্যাডার কর্মকর্তা তাদের প্রাপ্য সম্মানও চান। নতুন পদ সৃষ্টি ছাড়াও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতরে প্রেষণে নিয়োগের মাধ্যমে সমতায় ফিরতে চান তারা। পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবি, রাজনৈতিক মতাদর্শের ‘খোঁড়া যুক্তিতে’ আগের সরকারগুলো অনেক কর্মকর্তাকে প্রাপ্য সম্মান দেয়নি। পদোন্নতি তো দূরের কথা, বছরের পর বছর বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে বসিয়ে রাখা হয়। সরকারি চাকরি ছেড়ে অনেকে মনঃকষ্টে অন্য পেশায় চলে গেছেন। পরে কেউ কেউ চাকরিতে ফেরার সুযোগ পেলেও প্রাপ্য পদোন্নতি পাননি।
এবারের পুলিশ সপ্তাহে পুঞ্জীভূত এমন নানা ক্ষোভ-অসন্তোষের বিষয়টিও প্রকাশ পেয়েছে। বিশেষ করে মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে পুলিশের পক্ষ থেকে সেসব দাবি-দাওয়া জানানো হয়। উল্লেখযোগ্য দাবির মধ্যে সরকারি বিভিন্ন দফতরে প্রেষণে (ডেপুটেশন) পুলিশ কর্মকর্তা নিয়োগ ও পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তাদের জন্য সুপারনিউমারারি (সংখ্যাতিরিক্ত) পদ সৃষ্টির বিষয়টি জোরালোভাবে উঠে আসে। একই সঙ্গে ক্যাডারের পদ বাড়ানোসহ যথাসময়ে পদোন্নতি প্রদান এবং প্রশাসন ক্যাডারের ন্যায় সচিব ও সিনিয়র সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তার সংখ্যা গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে উন্নীত করার দাবি জানানো হয়। পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপকালে এসব দাবির পক্ষে তাদের সরব মন্তব্য জানা যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও পিএসসির চেয়ারম্যান ড. সা’দাত হুসাইন বলেন, ‘এগুলো খামখেয়ালি কথা, সঠিক নয়। এটি পর্যালোচনা করে দেখার বিষয়।’ কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘প্রশাসন সর্বব্যাপ্ত একটি ক্যাডার সার্ভিস, সব মিনিস্ট্রিতে কাজ করতে হয়। পুলিশ এবং প্রশাসন ক্যাডারের কাজের ধরনও আলাদা।’ তিনি বলেন, ‘কোন ক্যাডার কত বড় হবে তা অনেক এক্সারসাইজ করে ঠিক করতে হয়। হঠাৎ করে পুলিশ ক্যাডারে জনবল বাড়িয়ে দিতে হবে, পদোন্নতির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে, এটা বাড়াবাড়ি।’
এদিকে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, দীর্ঘদিন থেকেই প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা নানা অজুহাতে মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন দফতরে পদ-পদবির সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছেন। পদ সৃষ্টির মাধ্যমে ক্যাডার কর্মকর্তারা সরকারকে ‘ম্যানেজ’ করে পদোন্নতিও নিচ্ছেন ইচ্ছেমাফিক। অথচ প্রশাসন ক্যাডারের মতো বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে তারাও পুলিশ ক্যাডারে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু তারা এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না। সময়মতো পদোন্নতি না পেয়ে অপেক্ষাকৃত জুনিয়র হিসেবে কর্মরত থাকতে হচ্ছে। এতে পুলিশ ক্যাডারে কর্মরতদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া একই ব্যাচের কর্মকর্তা হয়েও নিুপদে চাকরির বিষয়টি লজ্জার বলে জানিয়েছেন কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ ক্যাডারের একজন পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা একই সঙ্গে বিসিএস দিয়ে যারা সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়েছিলাম তাদের অনেকেই এখন প্রশাসন ক্যাডারের বড় বড় কর্মকর্তা। এমনকি তারা পুলিশকে নিয়ন্ত্রণও করতে চায়। ছড়ি ঘোরাতে চায় পুলিশের ওপর। এটা কোনোভাবে মেনে নেয়া যায় না।
বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশিদ বলেন, বেশিসংখ্যক ক্যাডার সদস্যের নিয়োগ ছাড়াও এবারের পুলিশ সপ্তাহে তারা সরকারের কাছে আরও বেশি পরিমাণ গ্রেড-১ ও গ্রেড-২ পদ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন। এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দফতর ও বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোতে পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রেষণে নিয়োগের দাবি তুলেছেন। এমনকি একই দায়িত্বে সংযুক্ত রেখে ‘সুপারনিউমারারি’ পদ সৃষ্টির মাধ্যমে পদোন্নতি দেয়ারও দাবি উঠে এসেছে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বৈঠকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোয় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ‘সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টির’ গোড়াপত্তন ঘটে ২০০৪ সালে। ওই সময় পদ না থাকলেও তৎকালীন সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে দুই দফায় উপসচিব পদে প্রায় ৪৫০ উপসচিবের সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টি করা হয়। শূন্যপদের বাইরে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়ায় পোস্টিংসহ বেতন-ভাতা দিতে এমন পথ বেছে নেয়া হয়। এতেও সংকুলান না হওয়ায় পরবর্তী সময়ে ঢালাওভাবে ইনসিটো পোস্টিং ব্যবস্থা চালু করা হয়। অর্থাৎ পদোন্নতি হলেও তিনি আগের পদায়নকৃত স্থলে কর্মরত থাকবেন। যে কারণে সচিবালয়ে একসময় যেখানে সিনিয়র সহকারী সচিব বসতেন সেখানে এখন বসেন উপসচিব, আর যেখানে বসতেন উপসচিব, যেখানে বসেন যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা। অবশ্য এ কথাও সত্য যে, জনপ্রশাসনে ১৯৮৪, ৮৫ ও ১৯৮২ বিশেষ ব্যাচে দেড় হাজারের মতো বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়ায় তাদের যথাসময়ে পদোন্নতি ও যথাস্থানে পোস্টিং পেতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। এর জের টানতে গিয়ে ‘প্রশাসন পিরামিড’ এক রকম ভেঙে যায়। ওপর ও নিচে সরু হয়ে মাঝখানের পেটটা অনেক মোটা হয়ে পড়ে।
এদিকে বিষয়টি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্ক যাই থাকুক না কেন, পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তারা পদ ও পদোন্নতিতে এখন প্রশাসন ক্যাডারের মতো সুবিধা পেতে চান। অন্তত এবারের পুলিশ সপ্তাহে বিষয়টি কিছুটা হলেও স্পষ্ট হয়েছে।
চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা যারা বিসিএস অষ্টম ব্যাচে ছিলাম, প্রশাসনসহ অন্যান্য ক্যাডারে আমাদের ব্যাচমেটরা অতিরিক্ত সচিব হয়ে গেছেন। অথচ পদ খালি না থাকায় আমরা এখনও ডিআইজি পদেই আছি, যা আমাদের মানসিক যন্ত্রণারও কারণ।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের একই দায়িত্বে সংযুক্ত রেখে সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টির মাধ্যমে পদোন্নতি দেয়ার প্রস্তাব করেছি। প্রশাসন ক্যাডারে এভাবে পদোন্নতি দেয়া হয়। কিন্তু পুলিশকে ‘সুপারনিউমারারি’ পদ থেকে বঞ্চিত রাখা হচ্ছে।
সরকারের সাবেক এ শীর্ষ আমলা বলেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরে সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টির মাধ্যমে অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তারা দ্রুত পদোন্নতি পেয়েছেন এমন তথ্য মোটেও সত্য নয়। বরং পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তারা দ্রুত পদোন্নতি পেয়ে থাকেন। পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তারা যখন এসপি হন তখন ওই একই ব্যাচের কর্মকর্তারা ডিসি হওয়ার সুযোগ পান না। বরং তখনও তারা সিনিয়র সহকারী সচিব, উপসচিব পদে পদোন্নতি পাননি। এমন উদাহরণ ভূরি ভূরি আছে। এজন্য দেখা যাবে প্রতিটি জেলায় ডিসির চেয়ে কয়েক ব্যাচ জুনিয়র কর্মকর্তা হলেন এসপি।
তিনি বলেন, পুলিশ ও প্রশাসন ক্যাডার এক বিষয় নয়- কাজ ও আচরণ ভিন্ন। এ কর্মকর্তা আরও বলেন, তাহলে আনসাররাও তো বলবে তারা সংখ্যায় খুবই কম। আবার ডাক্তারদের সংখ্যা তো আরও অনেক বেশি। মূলত কাজের ধরন অনুযায়ী ক্যাডারগুলোর জনবল সংখ্যায় ভিন্নতা থাকে। এছাড়া পৃথিবীজুড়ে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করে নির্বাহী বিভাগ। এটাই স্বীকৃত পদ্ধতি। ২০০ বছর আগে ব্রটিশরা এ উপমহাদেশে এমন আইন চালু করে গেলেও কঠিন বাস্তবতায় তা কেউ ফেলতে পারেনি। কারণ যার হাতে অস্ত্র থাকে তাকে কখনও গুলি করার ক্ষমতা দেয়া হয়নি। গুলির নির্দেশ দেয়ার ক্ষমতা থাকে ভিন্ন স্থানে। এভাবে শাসন ব্যবস্থায় ভারসাম্যতা রক্ষা করা হয়।
এদিকে পুলিশ সদরদফতর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে পুলিশ ক্যাডারে কর্মরত কর্মকর্তার সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। যদিও মাত্র কয়েক বছর আগে এ সংখ্যা ছিল দেড় হাজার। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর পুলিশে নতুন প্রায় এক হাজার ক্যাডার পদ সৃষ্টি করা হয়। নবসৃষ্ট এসব পদে নিয়োগের পর প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে পুলিশের ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতিতে কিছুটা সমতা ফিরে আসে। তবে পুলিশ ক্যাডারে কর্মরত কর্মকর্তারা এতে সন্তুষ্ট নন। তারা পদোন্নতি ও পদায়ন পদ্ধতিতেও পুরোপুরি সমতা চান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় একাধিক বিভাগ সৃষ্টি করে সচিবসহ ক্যাডার পদ বাড়ানো হয়েছে। নানা অজুহাতে প্রশাসন ক্যাডারের পদ বাড়ানো হয়েছে বিভাগীয় কমিশনার ও ডিসি অফিসেও। ওদিকে যথাসময়ে প্রয়োজনীয়সংখ্যক পদ সৃষ্টি ও পদোন্নতি না হওয়ায় পিছিয়ে পড়ে পুলিশ ক্যাডার। এ অবস্থায় সংকট নিরসেন পুলিশ ও প্রশাসন ক্যাডারের মধ্যে বৈষম্য কমিয়ে আনতে এবারের পুলিশ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বেশ কিছু দাবি জানানো হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- পদ সৃষ্টির পাশাপাশি বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলো, সিটি কর্পোরেশন, বিআরটিএ, বিআরটিসি, বিআইডব্লিউটিএ, রাজউক, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, শুল্ক গোয়েন্দা, ভ্যাট গোয়েন্দাসহ এবং বিভিন্ন দফতর ও অধিদফতরে পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রেষণে নিয়োগ প্রদান।
এছাড়া পুলিশে গ্রেড-১ ও গ্রেড-২ কর্মকর্তার পদ বাড়ানোর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্র“তির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেন, পুলিশে ৫টি গ্রেড-১ দেয়ার বিষয়ে আপনি নীতিগত সিদ্ধান্ত দিলেও দুটি গ্রেড-১ পদ দেয়ার পর আর দেয়া হয়নি। একই সঙ্গে গ্রেড-২ পদ ১০ করার প্রতিশ্রুতি থাকলেও ৩টি গ্রেড-২ পদ দিয়ে আর দেয়া হয়নি।
অপরদিকে জানা গেছে, বর্তমানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দফতর, অধিদফতর, মাঠ প্রশাসন ও বিভিন্ন দূতাবাসে প্রশাসন ক্যাডারের ৫ হাজারেরও বেশি কর্মকর্তা কর্মরত রয়েছেন। তবে প্রশাসন ক্যাডারের অনুমোদিত মোট পদ ও কর্মরত পদের বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো হিসেব নেই বলে অভিযোগও আছে। এ কারণে এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন আজও আলোর মুখ দেখেনি।