প্রবৃদ্ধি বাড়লেও হচ্ছে না কর্মসংস্থান
- নিউজ ডেস্ক
মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। শিল্পের উন্নতি হচ্ছে, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত কর্মসংস্থান হচ্ছে না। কর্মসংস্থান না হওয়ার কারণ বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির। আর অর্থনীতিকে অতিমাত্রায় প্রবৃদ্ধিনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হচ্ছে। এটি অর্থনীতির অত্যন্ত খণ্ডিত ও অসম্পূর্ণ চিত্র। সবচেয়ে দুস্থ মানুষটি অর্থনীতি থেকে কতটা পেল, সেটা বিবেচ্য হওয়া উচিত। তাই ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা অর্থহীন।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য চলতি অর্থবছরের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে গিয়ে এ কথা বলেন। মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে গতকাল শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে সিপিডি অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ (তৃতীয় সংস্করণ) প্রকাশ করেছে।
কর্মসংস্থান না হওয়ার উদাহরণ দিয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘পোশাক খাতে এত উৎপাদন ও রপ্তানি বেড়েছে, কিন্তু কর্মসংস্থান বাড়েনি। যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরাই আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে উৎপাদন বাড়িয়েছেন।’
বেসরকারি বিনিয়োগ চাঙা না হওয়ায় জিডিপির বড় দুর্বলতা বলে মনে করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের ব্যূহ ভেদ করতে পারছি না। জিডিপিতে যে বাড়তি বিনিয়োগ আসছে, তা রাষ্ট্রের বিনিয়োগ থেকে আসছে। ভোগের ক্ষেত্রে যে অতিরিক্ত অংশটি আসছে, তা-ও রাষ্ট্রের ভোগ। ভোগ ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে রাষ্ট্র দিয়েই অর্থনীতি ধাবিত হচ্ছে।’
চার কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ হচ্ছে না বলে মনে করেন এই গবেষক। তিনি বলেন, প্রথমত, অবৈধ উপায়ে অর্থ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। নির্বাচন যত সামনে আসে, অর্থ পাচার তত বাড়ে। দ্বিতীয়ত, আফ্রিকার দেশগুলোতে বিনিয়োগই বেশি লাভজনক মনে করেন এ দেশের ব্যবসায়ীরা। তাই পুঁজি দুর্ভিক্ষের দেশ এখন পুঁজি রপ্তানির দেশে পরিণত হচ্ছে। তৃতীয়ত, অর্থনীতি ব্যয়বহুল ভোগকাঠামোর দিকে যাচ্ছে। এর উদাহরণ—বিএমডব্লিউ ব্র্যান্ডের বিলাসবহুল গাড়ি বিক্রিতে এশিয়ায় পঞ্চম বাংলাদেশ। চতুর্থত, গত কয়েক বছরে উদ্যোগী সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা দেখা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি আছে।
চূড়ান্ত হিসাবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমতে পারে জানিয়ে সিপিডি বলেছে, ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির যে সাময়িক হিসাব দেওয়া হয়েছে; তা প্রথম তিন-চার মাসের প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে। সাময়িক হিসাবে সংশোধিত বাজেটের তথ্য নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া হাওর অঞ্চলে বিপর্যয়ের কারণে এ বছর বোরো ধান প্রায় ১৬ লাখ টন কম পাওয়া যাবে, যা মোট উৎপাদনের প্রায় ৮ শতাংশ।
মধ্যম আয়ের দেশ কিংবা উন্নত দেশ হওয়ার জন্য যে আকাঙ্ক্ষা, এর সঙ্গে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ প্রবাহের বিষয়টি মিলছে না বলে মনে করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।
সিপিডি মনে করে, আগামী বাজেটে নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আইনে নতুন হার ১২ শতাংশে নামানো উচিত। নতুন ভ্যাট আইন উৎপাদক ও ভোক্তার ওপর চাপ বাড়াবে। পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। আয়করের নিম্নতম স্তরটি ১০ শতাংশের পরিবর্তে সাড়ে ৭ শতাংশ করার সুপারিশ করেছে সিপিডি।
সিপিডি বলেছে, চলতি অর্থবছর শেষে মূল রাজস্ব আদায়ে ৩৮ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি থাকতে পারে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন গতানুগতিক। ২০১২ সালের পর থেকে বিদেশি সহায়তার ব্যবহার সর্বনিম্ন। সুশাসনের অভাবে বা জবাবদিহি কম থাকায় দেশজ উৎসের অর্রথ সহজে ব্যবহার করা যায়। এ জন্য সরকারি ব্যয় পর্যালোচনা কমিশন গঠন করা যেতে পারে।
মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে সিপিডি বলছে, অভ্যন্তরীণ বাজারে চালের দাম বাড়ার কারণে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। তিন মাস পর পর মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করবে বিবিএস—এটি খুবই নেতিবাচক সিদ্ধান্ত। তথ্য-উপাত্তের ঘাটতির কারণে অর্থনীতির সঠিক চিত্র যেমন আসে না, তেমনি নীতিনির্ধারণে যথাসময়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। এ জন্য স্বাধীন পরিসংখ্যান কমিশন গঠন করা যেতে পারে।
ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তন সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘বৃহত্তম ঋণ গ্রহণকারী যখন মালিক হয়ে যান, তখন তা চিন্তার বিষয়। ব্যাংকটির চলমান ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে ভূমিকা থাকা দরকার, তা দেখছি না। এ ব্যাংকের পরিবর্তন মসৃণ করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা থাকা দরকার।’
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সিপিডির পরিচালক আনিসাতুল ফাতেমা ইউসুফ, গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান প্রমুখ।