প্রথা ভেঙে জীবীকা নির্বাহ
- নিউজ ডেস্ক
ঝটপট পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোকের জুতায় আঠা লাগিয়ে হাতুড়িপেটা করে শেফালি দাস। জুতাজোড়া ভদ্রলোকের পায়ের কাছে রেখে দশ টাকা নিয়ে আবার অন্য একটা জুতার সম্পূর্ণ তলা খুলে তাতে আঠা লাগাতে থাকেন। শেফালির জুতায় আঠা লাগানও পেরেক ঠোকার নৈপুণ্য দেখে অনেকের চোখ কপালে ওঠার উপক্রম হলেও মতিঝিল সেনা কল্যাণ ভবনের গেটে প্রতিদিনের পরিচিত দৃশ্য এটি। যিনি স্বামী আর এক মেয়েকে নিয়ে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার জন্য প্রথা ভেঙ্গে মুচির কাজ করছেন।
এই প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে শেফালি জানান, ১৫ বছর ধরে তিনি মুচির কাজ করছেন। তার কাজকে কেউ মেনে নিতে পারেনি। তিনি বলেন, ‘কেউর কথায় কি ভাত দিব, কাম করলেই তিনজনের জীবন বাঁচব’।
শেফালি জানান, স্বামীই তাকে এই কাজ শিখিয়েছেন। প্রতিদিন আয় কত জানতে চাইলে বলেন,‘কোনো ঠিক নাই আপা কোনোদিন ২শ , কোনোদিন আড়াইশ আবার কোনোদিন ৩শ টাকাও কামাই হয়। সাড়ে চার হাজার টাকা বাসা ভাড়া। খাওনের খরচ প্রতিদিন একশ/দেড়শ টাকা আর কামের জিনিসপত্র কিনতে দেড়শ/দুইশ টাকার মতো খরচ লাইগা যায়। তারপরও ভালো থাকতাম যদি ঋণের বোঝা না থাকত। কিসের ঋণ প্রশ্ন করলে বলেন, স্বামীর চিকিত্সার জন্য সুদে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। সেই ঋণের জন্য মাসে হাজারে একশ টাকা সুদ গুনছেন।
এত কাজ থাকতে কেন তিনি এই কাজ করেন প্রশ্ন করলে তিনি জানান, তার মুচি হওয়ার পেছনের গল্প :১৫ বছর বয়সে শেফালির বিয়ে হয় মুচি বিকাশ দাসের সঙ্গে। স্বামীর সঙ্গে ব্রা?হ্মণবাড়িয়া ছেড়ে ঢাকায় আসেন। তাদের দিন ভালোই চলছিল। হঠাত্ একদিন স্বামীর ব্রেইন স্ট্রোক করে, চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসে শেফালির। জমিজমা যা ছিল সব বেচে স্বামীর চিকিত্সা করান। একে একে বসতভিটাও বেচতে হয়। স্বামী বেঁচে গেলেও একপাশ অবশ হয়ে যায়, কথা বলতে পারেন না। তখনই আসে বেঁচে থাকার জন্য হাতে জুতার কালি নেওয়ার পালা। পরে মুচির কাজের পুরোটা আয়ত্তে চলে আসে।
প্রথম দিকে কেবল নারী বলে তেমন কাস্টমার পেতাম না। এক দুই জন বাধ্য হয়েই তার কাছে আসত। দিনের পর দিন কম টাকায় কাজ করে ধৈর্য ধরে বসেছিলেন। ভিক্ষা না করে নিজে কাজ করতে ভালো লাগে শেফালির। যখন কোনো সমত্ত মেয়ে তার কাছে ভিক্ষা চায়- শেফালি তাদের কাজ করতে বলেন। আর এখন সকাল ছয়টা থেকে রাত আটটা/নয়টা পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই কাজ করেন শেফালি। কাজ শেষে বাজার করে বাড়ি ফিরে রান্না, তারপর তিনজনে মিলে খাওয়া। পরের দিন খুব ভোরে উঠেই রাতের রান্না করা খাবার আর স্বামীসন্তান নিয়ে কাজে চলে আসা তার রুটিন। দোকান খুলেই সকালে খাবার খান তারা। দুপুর কাটে চা রুটি খেয়ে। সাড়ে চার বছরের ছোট্ট পূর্ণিমাটা মাঝে মধ্যে ভাত খেতে চাইলে হোটেল থেকে কিনে দেন। কেন একদিনও ছুটি নেন না প্রশ্ন করলে শেফালি জানান- বড় মেয়ের বিয়েতে ৭০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। সুদের দায়, ছোট মেয়েটাকে পড়াশুনা করানর স্বপ্ন আর বাস্তবতা তাকে বিশ্রাম নিতে দেয় না। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, এই দুর্গাপূজায় মেয়েটারে একটা নতুন জামা দিতে পারি নাই। ইতোমধ্যেই বাড়ি ভাড়ার লাইগ্যা তাগাদা দিতাছে বাড়িওয়ালা। তিন হাজার টাকা বাও করেছি-বলেই আঁচলে চোখ মুছেন শেফালি। অন্য কোনো আয়ের কথা কি ভাবছেন প্রশ্ন করলে বলেন, আর কোনো কামতো পারি না।