শিক্ষার্থী ও তারুণ্যের মিলনমেলা
- নিউজ ডেস্ক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সাদিয়া তামান্না এসেছেন ভিএস নাইপলের বক্তৃতা শুনতে। সাদিয়ার মতো অনেক তরুণই এসেছেন লিট ফেস্টে বইয়ের টানে, লেখকের টানে। বিশ্বখ্যাত লেখকদের আকর্ষণে ছুটে এসেছেন তারা। গতকাল শুক্রবার দ্বিতীয় দিনেও ঢাকা লিট ফেস্ট মাতিয়ে রেখেছেন তরুণরাই। সব অধিবেশনেই তারা শুনছেন দেশ-বিদেশের লেখকদের কথা। বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে নানাজনের সঙ্গে মেতে উঠছেন আড্ডায়। ঢাকা লিট ফেস্ট তরুণদের জন্য সত্যিকার অর্থেই আন্তর্জাতিক সাহিত্যের আঙিনা হয়ে উঠেছে।
ঢাকা লিট ফেস্টের পরিচালক সাদাফ সায সিদ্দিকী বললেন, বিশ্বসাহিত্যের প্রতি আগ্রহী প্রজন্মের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম সৃষ্টি করা গেছে। ছয় বছর আগে যখন শুরু হয় তখন মনে সাহস ছিল। আমাদের উদ্দেশ্য নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন। কিন্তু এর ফলাফল এখন সবার চোখের সামনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ফখরুল আলম বললেন, এটা সত্যি যে বাংলা সাহিত্য ইংরেজিতে অনুবাদ হচ্ছে। কিন্তু সেটা ইংরেজি ভাষার পাঠকদের উপযোগী নয় বলে তা বাজার পাচ্ছে না। ইংরেজি বাজারে প্রবেশের জন্য যোগ্য এজেন্ট নিয়োগ জরুরি, যারা মানসম্পন্ন বাংলা সাহিত্যকে বিশ্ববাজারে পৌঁছাতে কাজ করবে। সেদিক থেকে লিট ফেস্টের এই প্লাটফর্ম বাংলাদেশের সাহিত্যকে বিশ্বে মার্কেটিং-এর জন্য খুব বড় ক্ষেত্র।
বাংলাদেশের সাহিত্যের সঙ্গে বিশ্বসাহিত্যের পাঠক-লেখকদের মেলবন্ধনের এক অনন্য আয়োজন হয়ে দেখা দিয়েছে ঢাকা লিট ফেস্ট। গত দুদিনে বিভিন্ন সেশনে দেশি-বিদেশি লেখক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও সমালোচকদের আলোচনায়, আড্ডায় মুখর হয়ে উঠেছিল বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ।
সাহিত্য যখন সবার
গতকাল বেলা দুইটায় মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘সাহিত্য যখন সবার’ শীর্ষক অধিবেশন। আন্দালিব রাশদীর সঞ্চালনায় এতে অংশ নেন কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন, মঈনুল আহসান সাবের, সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও ইমতিয়ার শামীম।
ইমদাদুল হক মিলন বলেন, ‘সাহিত্য সবার কাছে পৌঁছাতে পারছে না। যদি পারত, তবে বদলে যেত পৃথিবী। থাকতো না হানাহানি, হিংসা-বিদ্বেষ।
মঈনুল আহসান সাবের বলেন, সাহিত্য সবার কাছে পৌঁছতে পারে না। সেটা পারবেও না। তবে লেখকরা আকাঙ্ক্ষা করেন তাদের সৃষ্টিকর্ম সবাইকে স্পর্শ করুক।’
ইমতিয়ার শামীম বলেন, সাহিত্য সবাইকে স্পর্শ করতে না পারলেও অন্তত কিছু মানুষকেও যদি তাড়িত করে সেটাই হবে সাহিত্যিকের স্বার্থকতা।’
দ্বিতীয় দিনে ৩৭ অধিবেশন
গতকাল ছুটির দিনে সকাল থেকেই সাহিত্যপ্রেমীদের ভিড় জমতে শুরু করে বাংলা একাডেমি চত্বরে। লিট ফেস্টের ছয়টি মঞ্চেই ছিল নানা ধরনের আয়োজন। সাহিত্য নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতা এবং জঙ্গিগোষ্ঠীর পৃথিবীজুড়ে যে তাণ্ডব সেসব বিষয় উঠে আসে আলোচনায়। এছাড়া প্রকাশনা শিল্পে সংকট, নারী ও নারীর জীবনচিত্র, মঞ্চ নাটকসহ আরো নানা বিষয় ছিল দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনগুলোতে আলোচনায়। দ্বিতীয় দিনের আয়োজনে ছিল ৩৭টি অধিবেশন। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় এ উৎসবের আয়োজন করেছে যাত্রিক। এ উৎসবে ১৮ দেশের ৬৬ জন বিদেশি এবং দেড় শতাধিক বাংলাদেশি সাহিত্যিক-লেখক-গবেষক অংশ নিচ্ছেন।
বেলা দুইটায় ফেস্টের লনে অনুষ্ঠিত হয় ‘মঞ্চ যখন আমার’ শিরোনামের অধিবেশন। অভিনেত্রী বন্যা মির্জার সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশ নেন মঞ্চনাটকের তিন গুণী শিল্পী সারা যাকের, মিতা হক ও সামিনা লুত্ফা।
সকাল ১০টায় কেকে টি স্টেজে ‘ইন আদার ওয়ার্ডস : লাইব্রেরি অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক অধিবেশনে ২০১৬ সালের ম্যান বুকার পুরস্কারজয়ী সাহিত্যিক ডেবোরাহ স্মিথ, অরুণাভ সিনহা, চার্লস টর্নার ও কায়সার হক। অধিবেশনটি সঞ্চালনা করেন ড্যানিয়েল হার্ন। একই সময় ব্র্যাক মঞ্চে ‘ক্যান ইন্ডিয়া স্পিক’ শিরোনামের অধিবেশনে দ্য ‘ইকোনমিস্ট’ পত্রিকার দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরো চিফ ম্যাক্স রডেনবেকের সঞ্চালনায় আলোচনা করেন নরেশ ফার্নান্দেজ, মাঞ্জুলা নারায়ণ ও শ্রীরাম কারি। একই সময়ে কসমিক টেন্টে প্রদর্শিত হয় তথ্যচিত্র ‘ব্লকেড’। একই সময়ে বটতলায় ছিল গল্প বলার আসর। এ পর্বে ‘হাঁসের পায়ে ঘুড়ি’ শিরোনামের গল্প বলেন নাজিয়া জাবিন। সোয়া ১১টায় মূল মঞ্চে ‘দ্য নিউ ওয়ার্ল্ড ডিজঅর্ডার’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। জাস্টিন রোলাটের সঞ্চালনায় এ বিষয়ে আলোচনা করেন ম্যাক্স রোডেনবেক, বেন জুদাহ, রোজামান আরউইন ও ‘ঢাকা ট্রিবিউন’ সম্পাদক জাফর সোবহান। ৯/১১’র পর সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আমেরিকার যুদ্ধ ঘোষণা এবং তাদের শত্রু রাষ্ট্রদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বিষয়গুলো উঠে আসে। একই সময়ে কেকে টি স্টেজে ‘নারী ও নারীত্ব’ বিষয়ক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সাংবাদিক উদিসা ইসলামের সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশ নেন নাসিমা আনিস, সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়, পাপড়ি রহমান ও সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম। একই সময়ে লনে কার্তিকা ভিকের উপস্থাপনায় কথোপকথনে অংশগ্রহণ করেন পুলিৎজার জয়ী সাহিত্যিক বিজয় শেষাদ্রী। একই সময়ে ব্র্যাক মঞ্চে ‘সুফি সোল’ শীর্ষক আলোচনায় আমিনা ইয়াকিনের সঞ্চালনায় অংশ নেন সাদিয়া দেলভি ও অধ্যাপক সলিমউল্লাহ খান।
দুপুর সোয়া তিনটায় কেকে টি স্টেজে অনুষ্ঠিত হয় ‘টিকে থাকার আজ কাল পরশু’ শীর্ষক অধিবেশন। পশ্চিমবঙ্গের নিউরো সায়েন্টিস্ট গার্গো চট্টোপাধ্যায়ের সঞ্চালনায় এতে অংশ নেন ফিরোজ আহমেদ, চলচ্চিত্রকার ইন্দ্রনীল রায় চৌধুরী, সাহিত্যিক আহমাদ মোস্তফা কামাল ও মানস চৌধুরী। একই সময়ে লনে ‘জীবনের কবিতা’ শীর্ষক আলোচনায় নিজের জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে কথা বলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। সঞ্চালনা করেন শামীম রেজা।
সারাবেলা গান আর কবিতা
গতকাল সারাদিনই লিট ফেস্টের নানা মঞ্চে ছিল বাংলাদেশের শিকড় সন্ধানী নানা সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। দিনের শুরুটাই ছিল মারফতি গান দিয়ে। আফসার উদ্দিন আলী চিশতি ও তার দল পরিবেশন করেন মারফতি গান। এরপর সাধনার নৃত্যশিল্পীরা মঞ্চস্থ করে নৃত্যনাট্য ‘পদ্মাবতীর আখ্যান’। সকাল ১০টায় লনে ইংরেজি কবিতা আবৃত্তি করেন শেহজার দোজা, সৈয়দা আহমেদ, ফাতেমা হাসান, জেফরি ইয়াং ও আহমাত জান ওসমান। বিকেল সোয়া তিনটায় বিদ্যা শাহের পরিবেশনায় ছিল ‘জলশা’। বিকাল সাড়ে চারটায় বয়াতি শাহ আলম ও তার দল পরিবেশন করেন পালাগান। দিনের শেষ আয়োজন ছিল উত্সবের বটতলায় এ বছর সাহিত্যে নোবেলবিজয়ী বব ডিলানের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য। সঙ্গীত পরিবেশন করে ব্যান্ডদল স্টোন ফ্রি।
আজ শনিবার লিট ফেস্টের শেষদিন। এদিনের মূল আকর্ষণ হিসেবে বিকাল সাড়ে ৫টায় মূল মঞ্চে প্রদান করা হবে জেমকন সাহিত্য পুরস্কার। সাড়ে ৬টায় সমাপনী অনুষ্ঠান ও রব ফকিরের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শেষ হবে এ সাহিত্য সম্মেলন।