শিক্ষকদের কর্মবিরতী : বছরের শুরুতেই শিক্ষা বিপর্যয় ?
নিউজ ডেস্ক : নতুন বেতনকাঠামোতে সিলেকশন গ্রেড বহাল ও বেতন গ্রেডের সমস্যা নিরসনের দাবিতে গতকাল (১১ জানুয়ারি) সকাল থেকে দেশের ৩৭টি সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কর্মবিরতি পালন করছেন। এর আগে শিক্ষকরা এই কর্মবিরতির কথা জানিয়ে সরকারের প্রতি আলোচনার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু সেই আহ্বানে সরকারের সংশ্লিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষ সাড়া দেয়নি।
শিক্ষকদের এই আন্দোলনের শুরু প্রায় আট মাস আগে। শুরুতে শিক্ষকেরা প্রতীকী কর্মবিরতি পালন করেছেন, কালো ব্যাজ ধারণ করেছেন এবং মানববন্ধনে মিলিত হয়ে নিজেদের দাবির কথা জানিয়েছেন। কিন্তু তাতেও সরকার কর্ণপাত করেনি। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে—বেতন-ভাতা দ্বিগুণ করা হয়েছে। এর চেয়ে বেশি কিছু করার নেই। এমনকি গতকাল বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত এক সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষকদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
এমন পরিস্থিতিতে আজ (১২ জানুয়ারি) দ্বিতীয় দিনের মতো কর্মবিরতি পালন করছেন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব এ এস এম মাকসুদ কামাল জানান, গ্রেড সমস্যা নিরসনের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষকদের লাগাতার কর্মবিরতি কর্মসূচি চলবে।
এই অবস্থা বেশি দিন চললে শিক্ষার্থীদের সেশনজটে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হবে বলে মনে করছেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। গত কয়েক বছরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বাদে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশনজট প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ এইচ এম নুরুন নবী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ সেশনজট ছিল, তা প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা হয়েছে। গত বছর সহিংসতার সময় শিক্ষকেরাই ছাত্রদের ডেকে ক্লাস করার অনুরোধ জানিয়েছেন। কিন্তু প্রায় আট মাস ধরে শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষায় ব্যাঘাত না ঘটিয়ে আন্দোলন করেছেন। এরপরও শিক্ষকদের দাবির বিষয়টি সরকার উপলব্ধি করছে না বলে তাঁরা কঠোর কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
শিক্ষকেরা নয় দিন সময় দিয়ে গতকাল থেকে লাগাতার কর্মবিরতি শুরু করলেও মধ্যবর্তী সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে শুধুই আলোচনার কথা বলা হয়েছে। বাস্তবে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে শিক্ষকেরা অভিযোগ করেন।
অর্থ মন্ত্রণালয় কয়েক দিন আগে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যাতে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড ছাড়া গ্রেড-১ ও ২ প্রাপ্য হন, সে জন্য সরকারের সিদ্ধান্তের আলোকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কাজ করছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পাওয়া গেলে অর্থ মন্ত্রণালয় দ্রুততার সঙ্গে অনাপত্তি দেবে।
কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, এখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কিছু করার নেই। এ বিষয়ে যা করার, তা অর্থ মন্ত্রণালয়কেই করতে হবে। আর বিষয়টি একেবারেই নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত।
এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, সমস্যা দূর করার জন্য তিনি সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
শিক্ষা ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, গত ১৫ ডিসেম্বর নতুন বেতন স্কেলের প্রজ্ঞাপন জারির পরপরই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় একটি ‘ফর্মুলা’ শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানায়। কিন্তু শিক্ষকেরা বলছেন, এই ‘ফর্মুলা’ বাস্তবায়িত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের গ্রেড-১-এ যাওয়ার সুযোগ অর্ধেক বা তারও বেশি কমে যাবে। কারণ, বর্তমানে মোট অধ্যাপকদের ২৫ শতাংশ গ্রেড-১-এ যেতে পারেন। সেখানে এখন প্রথমে গ্রেড-২ ভুক্ত করে তাঁদের মধ্য থেকে ২৫ শতাংশ অধ্যাপককে গ্রেড-১-এর কথা বলা হচ্ছে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়।
আন্দোলন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বৈরাচারী এরশাদের বিদায়ের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কোনো দাবিতে একযোগে ধর্মঘট পালন করেছেন, এরকম নজির নেই।
শুধু শিক্ষকরাই নন, নতুন বেতন কাঠামো সংশোধনের দাবি জানিয়ে আন্দোলনে নেমেছেন ব্যাংকার প্রকৌশলী, কৃষিবিদ ও চিকিৎসক এবং ২৬টি বিসিএস ক্যাডারসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা। গতকাল থেকে তারাও দুই ঘণ্টা করে কর্মবিরতি শুরু করছেন। প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় কমিটির ডাকে দুপুর ১২টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত এই কর্মবিরতি হচ্ছে। কর্মবিরতি চলবে ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত।
গত ৪ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংশ্লিষ্ট কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সচিবকে ডেকে নিয়ে বেতন-সংক্রান্ত জটিলতার বিষয়টি দেখার নির্দেশ দেন। এরপর সচিবেরা প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, চিকিৎসকসহ ২৬টি ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে ফলপ্রসূ আলোচনার কথা বললেও এসব কর্মকর্তাও গতকাল থেকে দুই ঘণ্টা করে কর্মবিরতি শুরু করেছেন। বাংলাদেশ সম্মিলিত সরকারি কর্মকর্তা পরিষদও দুই ঘণ্টা কর্মবিরতি শুরু করেছে।
তবে আন্দোলনরত বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা গভর্নরের আশ্বাসে গতকাল থেকে কর্মসূচি স্থগিত রেখেছেন।
সরকারি সূত্রগুলো বলছে, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, চিকিৎসকসহ ২৬টি ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠনের কর্মকর্তারা সরাসরি সরকারি কর্মকর্তা হওয়ায় তাঁদের সমস্যার সমাধান সহজ মনে করা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিষয়টি নিয়ে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
এই পরিস্থিতির আশু সুরাহা না হলে বছরের শুরুতেই দেশ একটি শিক্ষা বিপর্যশয়ের মধ্যে পড়বে বলে মনে করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবাই।