স্বীকৃতি মিলেছে, মেটেনি পেটের ক্ষুধা
সজীব হোসাইন, রংপুর : বৃহত্তর রংপুরের একমাত্র নারী বীরাঙ্গনা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে স্বামীর সাথে সাক্ষ্য দিয়েছেন এটিএম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে। কিন্তু তারপর থেকে কেউ খোঁজ রাখেনি মনছুরা বেগমের।
‘বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত বীরাঙ্গনা হিসেবে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়ে মরে যাওয়ার আগে দেশ স্বাধীনের মত খুশি হইছি কিন্তু পেটের ক্ষুধা এখনো মেটেনি। ভারতে ৮ মাস প্রশিক্ষণ নিয়েও আমার স্বামী আজও পায়নি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। ট্রাইব্যুনালের সাক্ষী ছিলাম আমরা দুজনই। ভয়ে কাটে প্রতিরাত, কখন কি হয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার হয়েও সরকার খোঁজ রাখেনি আমাদের।’ আক্ষেপ করে এভাবেই বলছিলেন মনছুরা বেগম।
মনছুরা বেগম দি প্রমিনেন্টকে বলেন, ‘স্বামী যুদ্ধে যাওয়ার অপরাধে ১৯৭১ সালের আগস্টের শেষদিকে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় আমাকে বাড়িতে নির্যাতনের পর রংপুর শহরের টাউন হলে ধরে নিয়ে গিয়ে করে পাশবিক নির্যাতন। ১৮ দিনের মাথায় গর্ভের অনাগত সন্তানটি নষ্ট হয়ে যায়।’
‘ভুলতে পারি না, যেদিন বৃদ্ধ শ্বশুরের চোখের সামনে নির্যাতন করে আমাকে। অতঃপর আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়া টাউন হলের ‘নির্যাতন সেলে’। রাইফেলের বাট আর বুটের আঘাতে নিস্তেজ হয়ে পড়েন আমার বৃদ্ধ শ্বশুর।’ মনছুরা বলছেন আর ভাঙ্গা চশমার ফাঁক দিয়ে দু’চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে।
মনছুরার স্বামী মোস্তফা মিয়া(৭৫) বলেন, ‘দেশের কথা ভেবে দুই মাসের অন্তঃস্ত্ত্বা স্ত্রীকে বাবা-মার কাছে রেখে ভারতে যুদ্ধের প্রশিক্ষণে জন্য যাই। ফিরে এসে শুনি পাকিস্তানি সেনারা আমার বাড়িতেই আমার স্ত্রীকে ধর্ষণ করার পর টাউন হলে নির্যাতন সেলে নিয়ে আটকে রাখে।’
প্রতিবেশীদের কাছে পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনে বাবার মৃত্যুর খবর পাই। কি লাভ হল দেশের জন্য এত করে ? দেশ স্বাধীনের ৪৪ বছরেও মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় পেলাম না। দু’পা আজ প্রায় অচল। টাকার অভাবে চিকিৎসা করতে পারেন না বলছিলেন মোস্তফা।
আল-বদর কমান্ডার আজহারের বিচার চলাকালে আমাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকার পক্ষ থেকে সাক্ষী দেওয়ানো হলেও আর কেউ খবর নেয় না আমার পরিবারের। সরকারি চাকরি দেওয়ার কথা বলেও আমার বড় ছেলেকে দিনমজুর হিসেবে কাজ করানো হচ্ছে রংপুর সেনানিবাসে। ছোট ছেলে রিক্সা চালায়। কিভাবে আমার সংসার চলে কেউ আর খোঁজ নেয় না। যুদ্ধে গিয়ে মারা গেলে হয়ত বেঁচেই যেতাম। চোখের সামনে এভাবে পরিবারের কষ্ট সহ্য করতে হত না। বলতে গিয়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না মোস্তফা।
গত ২৯ সেপ্টেম্বরের মুক্তিযোদ্ধা গেজেটে বীরাঙ্গনা হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও আজ পর্যন্ত কোন ভাতা পায় নাই মনছুরার পরিবার। কবে পাবে সেটাও জানে না ? প্রধানমন্ত্রী দেওয়া পাঁচ লক্ষ টাকার বিশেষ অনুদানে বাড়িতে বিল্ডিং দিলেও নিয়মিত খাবার জোটে না এখন তাঁদের।
জীবন সায়াহ্নে মোস্তফা মিয়া কান্না জড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ চেয়ে দি প্রমিনেন্টকে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা হয়ে মরতে চাই। দেখে যেতে চাই একটা ছেলের সরকারি চাকরি। মরে যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি তাঁদের এই আশা পূরণ করবেন না ?