যশোরের চারুপীঠ থেকে ঢাকার চারুকলা
- মারুফ ইসলাম
১৯৮৫ সাল। দেশে সামরিক স্বৈরাচার ক্ষমতাসীন। সমাজের সর্বস্তরে মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়, শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা যাপন করছে। অনেকটা বন্দি জীবন। এমন একটি সময়ে কয়েকজন তরুণ ঢাকার চারুকলা অনুষদের পড়াশোনার পাট চুকিয়ে চলে যান নিজ শহর যশোরে। সে দলে ছিলেন মাহবুব জামাল শামীম, হিরণ্ময় চন্দ প্রমুখ। যোশোরে গিয়ে প্রথমেই তারা গড়ে তুললেন চারুশিক্ষার প্রতিষ্ঠান ‘চারুপীঠ’। চারুপীঠ শিল্পীরা ভাবলেন, মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ_ সবারই আলাদা উৎসব আছে। কিন্তু এমন একটি উৎসব চাই যেটা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই নিজের উৎসব বলে মনে করবে। শিল্পী হিরণ্ময় চন্দ প্রস্তাব করলেন পহেলা বৈশাখের কথা। জয়নুলের ফোক ভাবনা আর সুলতানের গণমানুষের চেতনা মাথায় রেখে ১৯৮৫ সালে বাংলা নতুন বছর বরণের আয়োজন করে চারুপীঠ। শামীম-হিরণ্ময়-গোলাম দস্তগীরদের আয়োজনে চৈত্রের শেষ রাতে একুশের মতো আলপনা আঁকা হলো যশোর শহরজুড়ে। শোভাযাত্রার জন্য মাহবুব জামাল শামীম তৈরি করলেন পরী ও পাখি, হিরণ্ময় চন্দ তৈরি করলেন চমৎকার একটি বাঘের মুখোশ। পহেলা বৈশাখে মেয়েরা শাড়ি আর ছেলেরা পাঞ্জাবি পরে এলো। সানাইয়ের সুরে, ঢাকের বোলে নেচে-গেয়ে সেই শোভাযাত্রা প্রদক্ষিণ করল যশোর শহর। সব শ্রেণীর মানুষ এসে যোগ দিলেন সেই শোভাযাত্রায়। জন্ম নিল এক উৎসবের। মঙ্গল শোভাযাত্রা।
কয়েক বছর পর এই আয়োজন শুরু হলো ঢাকাতেও। সেই কাহিনী আরও চমকপ্রদ।
১৯৮৯ সাল। মাহবুব জামাল শামীম ও হিরণ্ময় চন্দ এলেন ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউটে মাস্টার্স পড়তে।সঙ্গে শহীদুল ইসলাম, সুভাশীষ মজুমদার, মাহবুবুর রহমান, ফিরোজ রায়হান, শামীম ইকবাল রিপন ও মনিরুজ্জামান শিপু। চারুকলাকে আনন্দমুখর, কর্মমুখর করার পরিকল্পনায় সে বছরের জয়নুল উৎসবে মাহবুব জামাল শামীম ও তার দলবল সমমনা সহপাঠীদের সঙ্গে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেন ঢাক বাজিয়ে ঘোড়া নিয়ে নেচে-গেয়ে সবাইকে অবাক করে দেবেন। হলোও তাই- ঢাকের বোলে, দশটি কাগুজে ঘোড়ার নৃত্যে সবাই এক হয়ে গেল। তৎকালীন ছাত্র সাখাওয়াত হোসেন, সালেহ মাহমুদ, শহীদ আহমেদ, আহসান হাবিব, ফরিদুল কাদের, ফারুক এলাহীসহ অনেকে যোগ দিলেন তাতে। সাবেক ছাত্ররাও অনেকে এগিয়ে এলেন। তার সঙ্গে আরও যুক্ত হলেন তরুণ ঘোষ ও সাইদুল হক জুইস। সিদ্ধান্ত হলো চারুকলার শিল্পীরা তাদের তৈরি শিল্পকর্ম নিয়ে থাকবে বৈশাখী আয়োজনের অগ্রভাগে। সবার অংশগ্রহণে এটি হবে একটি জাতীয় উৎসব।
এ সময় চারুশিল্পী সংসদ এগিয়ে এসে অনুষ্ঠানের দায়িত্ব তুলে নেয় কাঁধে। সেই সময়ের চারুশিল্পী সংসদের প্রধান ছিলেন শিল্পী রফিকুন নবী। তিনি বলেন, ‘যশোরের শোভাযাত্রা দেশের একটা আকর্ষণীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যা দেখে আমরা উৎসাহিত হয়েছিলাম। চারুশিল্পী সংসদ একসঙ্গে বসে ঢাকায় বৈশাখে বর্ষবরণের শোভাযাত্রা করার সিদ্ধান্ত নেয়। চারুকলা থেকে পাস করা শিল্পীরা চারুশিল্পী সংসদের সদস্য ছিল। তাদের সঙ্গে তৎকালীন ছাত্ররাও জড়িয়ে যায় এই আয়োজনে। একই সঙ্গে তাদের সঙ্গে যুক্ত হন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ফয়েজ আহমদ। সেই আয়োজনে পুরো পরিকল্পনা ছিল শিল্পী ইমদাদ হোসেনের। তিনি তখন ডিজাইন সেন্টারের চিফ ডিজাইনার। তার সেই পরিকল্পনা কার্যকর করেছিল ছাত্ররা। প্রথমে শোভাযাত্রার নামকরণের কথা ছিল বৈশাখী শোভাযাত্রা। পরে আলাপ-আলোচনা করে যশোরের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামটাই ফাইনাল হলো। ’
প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রার পোস্টার করেছিলেন জুইস। লক্ষ্মীসরা ছিল সেই পোস্টারের বিষয়। গুরু শিল্পীরা দেখিয়ে দিলেন কীভাবে কী করতে হবে। আর শিল্পী তরুণ ঘোষ তখন বিদেশ থেকে শিখে এসেছেন কীভাবে মুখোশ বানাতে হয়। শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারের প্রিয় ছাত্র জুইস। তিনি শিখিয়ে দিলেন কীভাবে মুখোশ তৈরি করতে হয়।
সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে। চারুকলা ইনস্টিটিউটে শোভাযাত্রার পরের বছর এই আয়োজন ছড়িয়ে পড়ে ময়মনসিংহ ও বরিশালে। এখন প্রায় সব জেলাতেই বৈশাখের প্রথম প্রহরে মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়। দেশ ছাড়িয়ে এই শোভাযাত্রা ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর দেশে-দেশে। পহেলা বৈশাখে শোভাযাত্রা হয় রবীন্দ্রভারতীতেও। তাদের এই আয়োজন যশোর থেকে গেছে বলে জানান শিল্পী রফিকুন নবী।
রফিকুন নবী বলেন, ‘এখন একটা জিনিস যোগ হয়েছে পহেলা বৈশাখে-পান্তা আর ইলিশ খাওয়া। সেজেগুজে গাছতলায় বসে তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধ সবাই এই পান্তা-ইলিশ খেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এটা ব্যক্তিগতভাবে আমার খুবই অপছন্দের। পেটের দায়ে ক্ষুধা নিভৃতের জন্য প্রান্তিক মানুষ পান্তা খায়। আর ঢাকা শহরে হঠাৎ একদিনের জন্য ইলিশ খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। অথচ যাদের অনুকরণে এই আয়োজন তারা ইলিশ মাছের চেহারাও চোখে দেখতে পায় না দুর্মূল্যের কারণে। মনে হয়, সেই প্রান্তিক চাষাকে ঘটা করে একদিন কটাক্ষ করার জন্যই এই আয়োজন।’