নাগরিক সিগন্যালে ভুগছে ঢাকা
- আসিফ রাজ
পল্টন মোড়। সারাদিনের কাজ শেষে ঘরে ফেরায় ব্যস্ত নগরী। মাঝ রাস্তায় বড় বড় গাড়িগুলো হঠাৎ থামল যদিও ট্রাফিক সিগন্যালে জ্বলছে সবুজ বাতি। কিছু নাগরিক এতসব তোয়াক্কা না করে জীবনের ঝুকি নিয়ে রাস্তা পার হওয়ায় থামতে বাধ্য হয়েছে গাড়িগুলো। ট্রাফিক সিগন্যালের পাশাপাশি এরূপ নাগরিক সিগন্যালও এ শহরের প্রতিদিনের দৃশ্য।
দ্যা গ্লোবাললি ভ্যেবিলিটি রিপোর্ট ২০১৭ অনুযায়ী, বিশ্বে বসবাসের উপযোগী ১৪০টি দেশের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৩৭তম। বিশেষজ্ঞদের মতে এই নিম্নস্থানে থাকার কারণগুলোর পিছনে একমাত্র দায়ী হচ্ছে অতিরিক্ত যানজট; এবং এই অতিরিক্ত যানজটের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম এই নাগরিক সিগন্যাল বা অবৈধ রাস্তা পারাপার।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) রাজধানীতে অবৈধ রাস্তা পারাপার বন্ধের লক্ষ্যে ২০১৪ সালে আইনী পদক্ষেপ নেন। তারা ২৫ নভেম্বর থেকে ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত ভ্রাম্যমান আদালতের সাহায্যে কমপক্ষে ১৭০ জন অবৈধ পথচারীকে ২০০ টাকা করে জরিমানা করেন। যদিও এখনও অনিয়মিতভাবে জরিমানা করা হচ্ছে কিন্তু কোনো সুফলের দেখা মিলছে না।
কঠোর আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরও সুফল না পাওয়ায় ব্যতিক্রম সমাধান প্রসঙ্গে সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড়ে দায়িত্বরত ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) হেলাল উদ্দিনকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘মানুষ গরু–ছাগল নয় যে তাদেরকে আমরা রাখালের মতো নিয়ন্ত্রণ করব। তাদের নিজেদের ভালো নিজেদেরকেই বুঝতে হবে। এর জন্য দরকার সকলের মধ্যে নৈতিকতা সৃষ্টি এবং এই দায়িত্ব গণমাধ্যমকর্মীদেরকেই নিতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যদিও আমরা রাস্তায় পার্শ্বস্থ অবরোধ বা রেলিং স্থাপন করেছিলাম কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয় নি; দু–একটা শিক কেঁটে জনগন সেখান দিয়েই পার হচ্ছে।’
ট্রাফিক আইন বিষয়ে নৈতিকতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে ফ্রান্সের পদক্ষেপটি ছিল জ্বলন্ত উদাহরণ। তারা এক বিশেষ আধুনিক পদ্ধতিতে নাগরিকদের মধ্যে প্রচার শুরু করে যে, ‘অবৈধ পারাপারের ফলাফল মৃত্যু’। তবে ঢাকা তাদের মতো এত আধুনিক শহর না হওয়ায় হুবহু ওই পদক্ষেপ বাংলাদেশের জন্য অনেক ব্যয় বহুল হবে। কিন্তু বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ২০১৭ সালের একটি জরিপ অনুযায়ী, ঢাকার ৭২.২২% বসবাসকারী টেলিভিশনের মাধ্যমে রাস্তা পারাপার সম্পর্কিত জ্ঞান লাভ করে থাকে। সুতরাং টিআই হেলালের মতে, টেলিভিশনকর্মীরা এ গুরুদায়িত্ব নিতেই পারেন। সেই লক্ষ্যে বুয়েটের এই গবেষণায় গণমাধ্যমকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, ‘ট্রাফিক আইনকে ব্যাখ্যা, স্পষ্টীকরণ ও পুনর্বহাল করতে।’
একজন পথচারীকে অবৈধ রাস্তা পারাপারের ফলে দুর্ঘটনার কথা বললে তিনি জবাব দেন, ‘দুর্ঘটনা শুধু দুর্ঘটনাই। ভাগ্যে ছিল ভেবে মেনে নিতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘নিজেকে কীভাবে নিরাপদে পার করাতে হয়, জানি।’ এছাড়া চারজন পথচারীর সবাই স্বীকার করেন যে, তারা এটিকে আইনত অপরাধ জেনেও করছেন এবং বিকল্প পদ্ধতি– ফুটওভার ব্রিজকে এড়াচ্ছেন কারণ উঠা–নামায় কষ্ট ও সময় নষ্ট হয়। যদিও ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) ২০১৫ সালের একটি গবেষণায় ফুটওভারব্রিজকেই অবৈধ রাস্তা পারাপার সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ডুয়েটের এই গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রায় ৫০% নাগরিক সময় স্বল্পতা এবং প্রায় ৪৫% নাগরিক উঠা–নামার কষ্ট এড়ানোর জন্য ফুটওভারব্রিজ পরিহার করে। বুয়েটের ২০১৭ সালের জরিপ অনুযায়ী ২১.৬৭% নাগরিক ফুটওভার ব্রিজের অনুপযুক্ত অবস্থানকে দুষছেন। এখানে দেখানো হয়েছে, প্রায় ৭৬.৬৭% জনগণ ট্রাফিক আইন সম্বন্ধে অবগত থাকা সত্ত্বেও প্রায় ৮০.৪০% জনগণ অমান্য করছেন। এখানে ১৮–২৪ বছর বয়সের নাগরিকের শতকরা হার ৮১.৩৯, যারা নিজেদেরকে নিরাপদে পার করাতে সক্ষম ভেবে এ ঝুঁকির দিকে পা বাড়াচ্ছেন। ফলে ওয়ার্ল্ড হেল’ ওরগেনাইজেশন ২০১৩–এর জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ১৩.৬ জন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। এছাড়া শিক্ষাগত যোগ্যতার দিক থেকে জরিপ করে দেখা যায়, মাধ্যমিক শিক্ষার নিম্নে অবস্থানকারী অবৈধ পারাপারের শতকরা হার ৬০.৫২। অর্থাৎ শিক্ষার অভাবে নৈতিকতাহীনও এর অন্যতম কারণ।
ফুটওভার ব্রিজের উচ্চতা সমস্যা সমাধানে চীনের একটি জার্নাল উঠা–নামার জন্য সিড়ি ব্যবস্থা না করে কৌণিক সমতল পথের পরামর্শ দিয়েছে; যার একটি ছোট উদাহরণ রাজধানীর ধানমন্ডিতে ৮ নং সড়কে রবীন্দ্র সরোবর থেকে ডিঙ্গি (ভোজনশালা) অব্দি ফুটওভার ব্রিজটি।
রাজধানীতে শুধুমাত্র এই যানজট ভোগান্তির ফলে সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা ২০১৫ অনুযায়ী, দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘন্টা এবং বছরে ৩৭ হাজার কোটি টাকা নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া বিশেষজ্ঞদের মতে, মানসিক চাপবৃদ্ধি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রদ্রোহী মনোভাব পর্যন্ত প্রায় নয় ধরনের মানসিক সমস্যার কারণ হচ্ছে যানজট।
যদিও কিছু সাধারণ নাগরিকের মন্তব্য, ‘যানবাহন দ্রুত গতিতে চলাচল করলে কারও সাহস হবে না, সিগন্যাল অমান্য করে রাস্তা পার হওয়ার।’ কিন্তু ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের মতে, ‘যখন রাস্তায় স্বল্প গতিসম্পন্ন গাড়ি চলাচল করে, তখন রাস্তায় অপরাধ কমে। কোনটি আমাদের প্রত্যাশা?’ তারা আরও বলেন, ‘রাস্তা কি শুধু ইট–বালি–সিমেন্ট আর গাড়িতে পরিপূর্ণ থাকবে? রাস্তা কি প্রতিযোগিতার জন্য?’