সুযোগ পেয়েও বিশ্বকাপে খেলেনি ভারত!
- ফিচার ডেস্ক
ফুটবল বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পেয়ে কেউ হাতছাড়া করে নাকি! এই উত্তরটাই মিলবে যখন আপনি কাউকে প্রশ্ন করবেন, আপনার দেশকে যদি সরাসরি ফুটবল বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ দেওয়া হয় তাহলে খেলতে যাবে? আসলেই ফুটবল বিশ্বকাপ এমন একটি আসর যেটা পুরোবিশ্বকে উন্মাদনার মধ্যে বন্দি করে রাখে পুরো এক মাস। এই এক মাসে পত্রিকা, টিভি চ্যানেলের খবর আর আয়োজন থেকে শুরু করে চা দোকানের আড্ডার প্রধান ও প্রথম বিষয় ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন দ্য আর্থ’। কিন্তু দ্য বিউটিফুল গেমের এই আসরে সুযোগ পেয়েও খেলেনি ভারতীয় উপমহাদেশ। এমনিতেই ফুটবল বিশ্বকাপে দক্ষিণ এশিয়া রাজত্ব শূন্য। একটু চিন্তা করুন তো, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের এক ভাগ লোকের বাস দক্ষিণ এশিয়ায়, আরো নির্দিষ্ট করে বললে ভারতীয় উপমহাদেশ।
অথচ আমরাই খুব ভালো ফুটবল খেলি না। আর ভারতীয় উপমহাদেশের কোনো দেশ কখনো বিশ্বকাপ ফুটবলের কোনো আসরে খেলেনি! একবার যে সুযোগ এসেছিল সেই সুযোগও ভারত পায়ে ঠেলেছিল। কি অদ্ভুত ব্যাপার। অনেকটা আশ্চর্য করার মতো। সবার মনে হয়তো একই প্রশ্ন, কেনই বা ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসরে অংশ নেওয়ার মোক্ষম সুযোগ সামনে পেয়েও সেটা কাজে লাগায়নি ভারত?
ভারতীয় উপমহাদেশের ফুটবল দলগুলোর অবস্থা বর্তমানে খুব একটা ভালো না। তবে এই মন্দের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ভারত, যাদের বর্তমান ফিফা র্যাংকিং ৯৭। ৩ বছর আগেও তাদের ১৭৩ ছিল। আর বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান ১৯৪। বর্তমানে ভারতের ফুটবলের জীর্ণদশা হলেও সেসময় বেশ সমৃদ্ধই ছিল ভারতের ফুটবল। ১৯৫০ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত ছিল ভারতের ফুটবলের স্বর্ণযুগ। এ সময় এশিয়ার ফুটবলের অন্যতম বড়শক্তি ছিল ভারত। তবে ভারত প্রথম সারাবিশ্বের নজরে আসে ১৯৪৮ সালের অলিম্পিক আসরে। সদ্য স্বাধীন হওয়া ভারত সেবারই প্রথম অলিম্পিকে অংশ নেয়। তারা ফ্রান্সের কাছে ২-১ গোলে হেরে যায়। ম্যাচের ৭০ মিনিট পর্যন্ত তারা হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে ম্যাচে ১-১ ব্যবধানের সমতা বজায় রেখেছিল। বুঝতেই পারছেন, তখন কতটা ভালো দল ছিল ভারত। তবুও বিশ্বকাপ মিস করলো!
১৯৫০ সালের বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়েছিল ভারত, তথা ভারতীয় উপমহাদেশ। সেই বিশ্বকাপের আয়োজন নিয়েও কিছুটা গল্প বলার আছে! ১৯৩৮ সালের পর টানা দুটি বিশ্বকাপের আসর বিঘ্নিত হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে ১২ বছর বন্ধ থাকার পর ১৯৫০ সালে ইউরোপের কোনো দেশ রাজি না থাকায় শেষে ব্রাজিলে আয়োজিত হয় সেবারের বিশ্বকাপ। তবে সেই বিশ্বকাপে নিষিদ্ধ হলো দুটি দেশ। জাপান ও জার্মান। তখন যুদ্ধে পরাজিত পর্যদুস্ত প্রায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া একটি জাতি জার্মানি। জার্মানির প্রায় প্রতিটি সেতু বোমার আঘাতে তখন পানির নিচে, প্রতিটা কল-কারখানার চিমনি দিয়ে তখনো উৎপাদনের বদলে কামানের গোলার ধোঁয়া বের হয়। দেশ হিসেবে তাদের কোনো নিজস্ব আত্মপরিচয় নেই বললেই চলে। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স আর রাশিয়া চার ভাগে ভাগ করে নিয়েছে দেশটিকে। তাদের দয়ায় জার্মানদের অধিকার নির্ধারণ হয়। তারা কি করতে পারবে, আর কি পারবে না সেটা চার মিত্র দেশ মিটিং করে ঠিক করে দেয়। ফুটবল তাদের রক্তে মিশে থাকলেও জার্মানিতে কোনো প্রফেশনাল ফুটবল দল গঠনের অনুমতি মেলেনি। পাড়া-মহল্লায় অবহেলায় জার্মানরা মাথা নিচু করে তাদের ফুটবল চালিয়ে যায়, হয়তো কোনো একদিন যদি আবার বিশ্ব অঙ্গনে প্রতিযোগিতার অনুমতি পাওয়া যাবে সেই আশায়। সেই আশা পূরণ হলো না। জাপান ও জার্মানি ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপে খেলার অনুমতি পেল না।
সেবারের ফিফা বিশ্বকাপে অংশ নেওয়ার কথা ছিল ১৬টি দেশের। স্বাগতিক দেশ ব্রাজিল ও ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ইতালি ছাড়া ৭টি দেশ আসে ইউরোপ থেকে, ৬টি আমেরিকা মহাদেশ থেকে এবং বাকি জায়গাটি বরাদ্দ ছিল এশিয়ার জন্য। বিশ্বকাপে অংশ নেওয়ার জন্য ফিফা এশিয়ার ৪টি দেশকে আমন্ত্রণ জানায়। দেশ চারটি হলো—ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার) ও ভারত। এর মাঝে ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও বার্মা আগেই ফিফাকে না বলে দিলে সুযোগ আসে ভারতের কাছে। ভারত সেই সুযোগ লুফে বিমানবন্দরে যায় ব্যাকপ্যাক নিয়ে। চোখমুখে হাসি ছিল তখনো। কিন্তু যখন ফিফা বললো খালি পায়ে বিশ্বকাপ খেলতে পারবে না তখনই মুখের হাসি হারিকেনের আলোর মতো মিটমিট করে কমতে থাকলো। বলে রাখা ভালো, ১৯৪৮ সালের অলিম্পিকে ভারত ফুটবল দল ভালো নৈপুণ্যের পাশাপাশি যে আরেকটি কারণে নজর কাড়ে তা হচ্ছে তাদের খেলোয়াড়দের খালি পায়ে খেলা। তবে ফিফা তাদেরকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দেয়, খালি পায়ে কোনোভাবেই বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া যাবে না। মানুষ এই গল্প বেশি বিশ্বাস করে যে, পর্যাপ্ত বুট না থাকার কারণে ভারত বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়।
তবে ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের বিবৃতি অনুসারে, ‘দল নির্বাচনে মতনৈক্য এবং প্র্যাকটিস করার যথেষ্ট সময়’ না থাকায় তারা বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে ২০১১ স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেড পত্রিকায় সাক্ষাত্কারে তত্কালীন ভারতীয় দলের অধিনায়ক শৈলেন মান্না বলেন, ‘আমাদের বিশ্বকাপ নিয়ে কোনো ধারণা ছিল না। যদি থাকতো তাহলে আমরা নিজেরাই উদ্যোগ নিতাম যাওয়ার জন্য। সেসময় আমাদের জন্য অলিম্পিকই ছিল সবকিছু। কোনোকিছুই অলিম্পিক থেকে বড় ছিল না।’ তবে ১৯৫০ সালে ফিফার আমন্ত্রণ পায়ে ঠেলার পর এশিয়ার এই ৪ দেশই পুড়ছে বিশ্বকাপে অংশ না নেওয়ার আক্ষেপে। ভারত, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়ার ফুটবলে এখন যে অবস্থা তাতে ক্রীড়াবিশ্বের অন্যতম আকর্ষণীয় এই টুর্নামেন্টে নিজেদের পতাকা ওড়াতে আরো বেশ কয়েকবছর অপেক্ষা করতে হবে।
তবে ৪ বছর পর বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি সয়ে আসার সাথে সাথে ১৯৫৪ সালে অবশেষে সেই অনুমতি মিললো। তখনো জার্মানিতে ফুটবল মানে এমেচার পর্যায়ের খেলা। প্রফেশনাল কোনো ক্লাব নেই, শুধুমাত্র স্থানীয় উদ্যোগে কোন ধরনের বেতন-ভাতা ছাড়াই খেলোয়াড়রা তাদের অবসরে খেলা চালিয়ে যাচ্ছিল। সেই এমেচারদের দিয়ে গড়া জার্মান দল এই বিশ্বকাপে কোয়ালিফিকেশন খেলে জিতে গেল সবাইকে অবাক করে দিয়ে।
পুসকাসের হাঙ্গেরি তখন সর্বকালের অন্যতম সেরাদল। গ্রুপ পর্যায়ের খেলায় তারা কোরিয়াকে ৯-০ গোলে হারানোর পাশাপাশি জার্মানিকে ৮-৩ গোলে তুলোধুনো করলো। জার্মানি টুর্নামেন্ট থেকে বাদ পড়ে যায় যায় বলে সবাই ভাবলো এমেচারদের নিয়ে আর কতদূর যাওয়া যায়। বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই যে করেছে এটাই তো অনেক!