ছাত্র আন্দোলন কী শুধু বাংলাদেশেই হয়?
- ফিচার ডেস্ক
না, শুধু বাংলাদেশে নয়—সারা পৃথিবীজুড়েই ছাত্র আন্দোলন হয়। বাংলাদেশে তো বটেই, সারা পৃথিবীজুড়েই ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস বহু পুরনো। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে রাজপথে নেমে এসেছে শিক্ষার্থীরা। এই প্রতিবেদনে থাকছে পৃথিবীর আলোচিত কিছু ছাত্র আন্দোলনের সারসংক্ষেপ।
প্যারিস: সময়টা ১৯৬৮। প্যারিসে ছাত্র আন্দোলন তখন মধ্যগগনে। প্রতিদিন রাস্তায় ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের খন্ডযুদ্ধ চলছে। এরকম এক সন্ধ্যারসময় রাজপথে তৈরি করা অস্থায়ী ব্যারিকেডের উপর দাঁড়িয়ে ছাত্রদের সামনে ধর্মঘটের সপক্ষে বক্তব্য রাখছিলেন বেলজিয়ামের মার্ক্সবাদী দার্শনিক আর্নেস্ট ম্যান্ডেল। বক্তৃতা শেষ করে নেমে এসেই তিনি দেখতে পেলেন সামনে একটি গাড়ি দাউ দাউ করে জ্বলছে। ওই রাজপথেই শিশুর মতো আনন্দে নেচে উঠে চেঁচাতে লাগলেন ম্যান্ডেল, “কী অপূর্ব! কী সুন্দর! বিপ্লব তা হলে এসেই গেছে।” যারা দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখল, তাদের মধ্যে হাতেগোনা কিছু ছাত্র ছিল। একমাত্র তারাই জানত ওই গাড়িটা ছিল প্রফেসর ম্যান্ডেলের নিজের!
এটি ছিল নাগরিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন। ছাত্রী-আবাসনে অবাধ প্রবেশের দাবিতে বিক্ষোভে নেমেছিল ফরাসী শিক্ষার্থীরা। ১৯৬৮-র মার্চ মাসে এই বিক্ষোভে যোগ দিল অন্যান্য বামপন্থী ছাত্ররা, স্লোগান তুলল ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে। মে মাসের শুরুতে নঁতের বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিল প্রশাসন। বিদ্রোহী ছাত্ররা প্যারিসের প্রাণকেন্দ্র লাতিন কোয়ার্টারে অবস্থিত সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘাঁটি গাড়ল।
৫ মে থেকেই শহরের সিনেমা হল এবং নাট্যশালাগুলিকে ছাত্ররা দখল করে জনসমাবেশ করছিল। এরকমই একটি সভায় এক মাওবাদী নেতা তাঁর রাষ্ট্রবিরোধী বক্তৃতায় বললেন, ‘দ্য গলের (তৎকালীন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট) স্বৈরাচার জনগণের সংসদকে বুর্জোয়া নাট্যশালায় পরিণত করেছে।’ সঙ্গে সঙ্গে তাঁর হাত থেকে মাইক কেড়ে নিয়ে ছাত্রনেতা ওয়ালি রোজেল বলে উঠলেন, ‘‘আর ঠিক এই কারণেই বুর্জোয়া নাট্যশালাগুলোকে দখল করে তাদের আমরা জনগণের সংসদে পরিণত করব।’’ সরকার আন্দোলনকে দাগিয়ে দিল মাওবাদী ষড়যন্ত্র হিসেবে। দেশকাল নির্বিশেষে রাষ্ট্রক্ষমতা সম্ভবত একই রকমের ভূত দেখে!
ব্যাপক সংখ্যায় মানুষ, গায়ক, কবি, অধ্যাপক এবার আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে এলেন। তত দিনে ফ্রান্সের সরকার প্রায় নিষ্কিয় হয়ে গিয়েছে। কারখানা, বিশ্ববিদ্যালয়, রাজপথ সবকিছুরই দখল সাধারণ মানুষের হাতে। এবার চার্লস দ্য গল যেটা করলেন সেটা প্রায় অভাবনীয়। মন্ত্রিসভাকে অন্ধকারে রেখে দেশ ছেড়ে নিরুদ্দেশ হলেন। যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীকে বলে গেলেন, ‘‘আমার দিন শেষ’’। সঙ্গে সঙ্গে গোটা দেশ ফেটে পড়ল প্রবল উল্লাসে।
কানাডা: ২০০৯ সালে কানাডার ছাত্র-শিক্ষকরা অর্থনৈতিক মন্দার দোহাই দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট সংকোচনের প্রদেশিক সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন। অনেক শিক্ষক নির্ধারিত ক্লাস বাতিল ঘোষণা করেন। বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটও ছাত্রদের এই কর্মসূচির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে।
জার্মান: ২০০৯ সালে জার্মানে ‘টিউশন ফি’ প্রথার বিরুদ্ধে শত শত ছাত্র বিক্ষোভ মিছিল করে। এ সময় বিপুলসংখ্যক নিরাপত্তা কর্মী ছাত্রদের সমাবেশকে ঘিরেরাখে। পরে তাদের দাবি মানতে বাধ্য হয় সরকার।
আয়ারলান্ড: আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে ১৫ হাজার ছাত্র ‘টিউশন ফি’ প্রথা পুনঃপ্রবর্তণের প্রতিবাদে নানা প্লাকার্ড ও বাদ্য যন্ত্র নিয়ে রাজপথে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। ছাত্রদের এই টিউশন ফি বিরোধী বিক্ষোভ মিছিলে শ্রমিকরাও সামিল হয়। নানা শ্লোগানমুখর এই বিক্ষোভের মূল বক্তব্য ছিল অর্থের বিনিময়ে কোনো শিক্ষা নয়। ‘আইরিশ টাইম’ ৫ ফ্রেব্রুয়ারি ২০০৯ এই ছাত্র বিক্ষোভ সম্পর্কে মন্তব্য করে….Dublin came to a standstill today as about 15,000 students marched through the city Centre in protest against the reintroduction of third-level fees.
যুক্তরাষ্ট্র: গত বছর (২০১৭) যুক্তরাষ্ট্রে টিনেসি রাজ্যের বিভিন্ন কলেজের ছাত্ররা রাজধানীতে সরকারের শিক্ষা বাজেট সংকোচন ও শিক্ষার্থীদের উপর শিক্ষা ব্যয় বোঝা বৃদ্ধির প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে। বিক্ষোভ সমাবেশে কফিন বহন করে বুঝাতে চেয়েছে টিউশন ফি বৃদ্ধির মাধ্যমে ছাত্রদের ভবিষ্যৎ মৃত্যুবরণ করবে।
দক্ষিণ আফ্রিকা: দক্ষিণ আফ্রিকার ‘এলিস’ এ অবস্থিত ফোর্ট হায়ার ইউনিভার্সিটি শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি বৃদ্ধি ও আবাসিক হলের ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে বিক্ষোভের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কর্মসূচী ব্যহত হয়। এটিও গত বছরের ঘটনা।
বুরুন্ডী: আফ্রিকার বুরুন্ডীর বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা তাদের শিক্ষা অধিকার সপ্তাহ পালনের জন্য বুরুন্ডি ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে মিলিত হয়। শিক্ষা অধিকার সপ্তাহের মূল প্রতিপাদ্য ছিল মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় সকলের জন্য অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থা। সমবেত ছাত্ররা শ্লোগান তোলে (শিক্ষাকে শক্তিশালি কর; দেশের নেতাদের আমাদের কথা স্মরণ রাখতে হবে!)।
ভারত: সময়টা ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সাল। ভারতের বিখ্যাত জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে (জেএনইউ) ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্টস ইউনিয়নের (ডিএসইউ) কিছু প্রাক্তন সদস্য একটি সাংস্কৃতিক সভার আয়োজন করে। সভার উদ্দেশ্য ছিল, উদ্যোক্তাদের ভাষায়, ‘মকবুল ভাট এবং আফজল গুরুর বিচার বিভাগীয় হত্যার প্রতিবাদে এবং কাশ্মীরী জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের গণতান্ত্রিক অধিকারের সংগ্রামে সংহতি প্রকাশ’। কিন্তু ক্ষমতাসীন বিজেপি নিয়ন্ত্রিত ছাত্র সংগঠন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের ক্যাম্পাসে মাইক ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং শেষমেষ পুলিশ দিয়ে তাদের উচ্ছেদ করে।
ডিএসইউ সাহায্য চায় জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস ইউনিয়নের (জেএনইউ-এসইউ) সাথে অন্যান্য বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো, এসএফআই, এআইএসএ- এরা একজোট হয় গণতান্ত্রিক এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে সভা করার অধিকার রক্ষায়। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে গ্রেফতার করা হয় জেএনইউ-এসইউ’র সভাপতি কানহাইয়া কুমারকে। অভিযোগ দেয়া হয় ‘কাশ্মীরের স্বাধীনতা চাওয়া জনগণকে সমর্থনের’। ভারত জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে কুমারের মুক্তি দাবির আন্দোলন। প্রথমে সেই আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, তারাও শিকার হয় পুলিশি ও ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের হামলার। এভাবে রাজধানী দিল্লিসহ বেঙ্গালুর, চেন্নাই, জয়পুরসহ বিভিন্ন স্থানে কানহাইয়া কুমারের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন হয়।
এই আন্দোলনের সাথে ছাত্রদের সংশ্লিষ্টতা সাধারণ বিষয়, কিন্তু এই ন্যায়ের আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালের শিক্ষকগণের ভূমিকা ভারতের ছাত্র আন্দোলনকে আজ অবধি স্মরণীয় করে রেখেছে। কলকাতায় শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশি হামলার পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাস বলেন, “দরজা বন্ধ করে, ফোর্স দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করা যায় না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ হলো মুক্ত চিন্তার জায়গা।” গণতন্ত্রে সবার মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে বলে মন্তব্য করেন সুরঞ্জন দাস। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা ছাত্র আন্দোলন করে জেএনইউ’র সমর্থনে প্ল্যাকার্ড ছাপিয়ে মিছিল করে। অন্যদিকে ছাত্রদের আন্দোলন থামাতে মরিয়ে হয়ে উঠে প্রশাসন। শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে বলা হয় উপাচার্যকে। কিন্তু সুরঞ্জন দাস সাফ জানিয়ে দেন, তিনি কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করবেন না এবং পুলিশ ডেকে তিনি ক্যাম্পাস শাসন করবেন না। সেরকম কিছু হলে পদত্যাগ করবেন। উপমহাদেশর প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রমিলা থাপারসহ প্রায় ১২০ জন শিক্ষক তখন ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়ায়। রমিলা থাপার বক্তব্য দেন জেএনইউ ক্যাম্পাসে। ‘দ্যা নেশন এন্ড হিস্ট্রি- নাউ এন্ড দেন’ প্রবন্ধে তুলে ধরেন সমকালীন রাজনীতি, বাক স্বাধীনতা ও ইতিহাসের আলোকে উপমহাদেশের জাতীয়তাবাদকে স্মরণ করিয়ে দেন। কানহাইয়া কুমারকে দলিত তথা নিম্ন বর্ণের হিন্দু বলে সীমাহীন নির্যাতন করা হয়। কিন্তু ছাত্র আন্দোলনের কারণে তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।