ফল মেনে নিয়ে সামনে তাকাও
- সুমনা শারমীন
উত্তর আমেরিকায় প্রবাসী দুই বাংলাদেশি যুবকের কথোপকথন।
– ভাই, আপনি কি সেই লোক, ম্যাট্রিকে (এখনকার এসএসসি) ফার্স্ট হয়েছিলেন?
– জি (নম্র ভঙ্গিতে)।
– আরে ভাই, আপনি তো আমার চিরশত্রু! জীবনে আপনার জন্য কম অপমান সহ্য করি নাই।
– মানে? আমার জন্য আপনি অপমানিত হয়েছেন? আপনার সঙ্গে আমার কি পরিচয় হয়েছিল আগে কোথাও?
– ভাই, আপনি ম্যাট্রিকে সম্মিলিত মেধাতালিকায় প্রথম হইলেন। বাবা–মাকে দুই পাশে নিয়ে ছবি তুললেন। পত্রিকার প্রথম পাতায় সেই ছবি দেখে আমার মা বলতেন, ‘যা, ওর পা ধুইয়া পানি খাইয়া আয়’। সেই থেকে আপনি আমার শত্রু!
– (হাসতে হাসতে) তাতে কী? আমি তো আপনার মতো এত ভালো গান গাইতে পারি না!
এ ঘটনা সত্য। উত্তর আমেরিকায় বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) ক্রেসগি অডিটরিয়ামে বছর কয়েক আগে বাংলা গানের যে চমৎকার আয়োজন হয়েছিল, সেখানে আমার উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে বাংলা গানের এই আয়োজনে অংশ নেন অসংখ্য প্রবাসী বাঙালি তরুণ–তরুণী। তাঁদের গান যখন মিলনায়তন ছাপিয়ে বোস্টন গ্লোব–এর মতো পত্রিকার পাতায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছিল, তখন গায়ে কাঁটা না দিয়ে পারে? আর যে বাঙালি যুবকের নেতৃত্বে এই অসামান্য আয়োজন হয়েছিল, সে-ই কিনা ঈর্ষা করে পরীক্ষায় প্রথম হওয়া মানুষটিকে!
একেকজনের ভেতরে থাকে একেক প্রতিভা। কেউ পরীক্ষায় ভালো ফল করে এগিয়ে যাবে, কেউবা ক্রিকেট খেলে। মুস্তাফিজের সঙ্গে একটা ছবি তোলার জন্য ঢাকার সেরা স্কুলের সেরা ছাত্র–ছাত্রীদের ভিড়ের মধ্যে কী ভীষণ লড়াই…নিজের চোখেই তো দেখলাম গতবার কিশোর আলোর আয়োজন কিআনন্দে! কে তখন মনে রাখে মুস্তাফিজের পরীক্ষার নম্বর?
সুতরাং মন দিয়ে পড়াশোনা করব, নিয়মশৃঙ্খলা মানব, পরীক্ষায় ভালো ফল করার চেষ্টা করব, বাবা–মাকে শ্রদ্ধা করব…এ রকম অনেক মানব, করব–র পর পরীক্ষার ফল যা–ই হোক না কেন, দৃষ্টি থাকবে সামনে। আমরা কেউ জানি না, আমাদের কোন আলো কখন জ্বলে উঠবে!
তোমার কি মন খারাপ?
হ্যাঁ, তোমাকেই বলছি। যে তুমি এ বছর উচ্চমাধ্যমিক বা সমমানের পরীক্ষায় জিপিএ–৫ পাওনি কিংবা কৃতকার্য হওনি। মন তো খারাপ হবেই। কিন্তু মনকে বলো, ‘দেখিস, একদিন আমরাও…।’ তোমার এই মন খারাপ করার পেছনে দায়ী আমরা বড়রা। আমরা তুলনা করি। তোমার দুর্বলতাকে চিহ্নিত করে সমানুভূতি দিয়ে তা কাটাতে সহযোগিতা করি না। তুমি এই সহযোগিতার হাত না পাও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, না পাও পরিবারে। গড্ডলিকা প্রবাহে গা না ভাসিয়ে তোমার ভেতরের সবলতাকে খুঁজে বের করে শাণিত করি না। বলি—তুই আমার মানসম্মান ডুবালি। আমার অফিসের জুনিয়র সহকর্মীর কাছে আমার মুখ ছোট করলি। ওর ছেলে পারল, তুই পারলি না?
বটেই, সন্তানের পরীক্ষার ফল এখন বাবা–মায়ের সামাজিক মর্যাদার নিয়ামক হয়ে উঠেছে।
আরেক দল তো নৌকা ভাড়া করে কাটা ঘায়ে নুন ছিটাতে শুরু করে। ‘হ্যালো ভাবি, শুনছেন, অমুক ভাবির তো খু…উ…ব মন খারাপ। মেয়েটা জিপিএ–৫ পায়নি। ভাই নাকি খু…উ…ব রেগে গেছেন। ভাবিকে দোষ দিচ্ছেন। বলেন তো, ভাবির কী দোষ? ভাবি তো কম চেষ্টা করেননি। কতগুলো কোচিংয়ে নিয়ে যেতেন মেয়েকে। কেন যে খারাপ করল? আমার মেয়ে কিন্তু ওর চেয়ে কম পড়েছে। এখন মেয়েটা ভালো কোথাও ভর্তি হতে পারবে কি না? যা হোক, ভাবিকে ফোন করে একটু সান্ত্বনা দিয়েন। আমি দিয়েছি!’
আমাদের সময় এই জিপিএ ৫/৪ ছিল না। সম্মিলিত মেধাতালিকা প্রকাশ করা হতো। পত্রিকার পাতায় গর্বিত বাবা–মায়ের সঙ্গে ছাপা হতো ছবি। আমাদের মতো সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মনে হতো—ইশ্, আজ যদি পত্রিকা না বের হতো! কারণ, ওই দিনের পত্রিকা ছিল আমাদের গলার কাঁটা। আর মেধাতালিকায় স্থান পাওয়া অচেনা–অজানা ছেলেমেয়েগুলো অকারণেই হয়ে যেত আমাদের চরম শত্রু। তোমাদেরও নিশ্চয়ই গণমাধ্যমে সহপাঠীদের আনন্দ–উল্লাসের ছবি দেখে মন আরও খারাপ হচ্ছে? মনে মনে বলো—এই দিন দিন না, আরও দিন আছে, সেই দিন ধরা দেবে এই দিনের কাছে।
প্রথম আলোর ইউটিউব চ্যানেলে গেলে ঘোড়সওয়ার নামে একটা তথ্যচিত্র দেখা যায়। নওগাঁর তাসমিনা নামের কিশোরী। অন্যের ঘোড়া নিয়ে ঘোড়দৌড়ে প্রথম হয়। নিজের হাতে পুরস্কার তুলে দেয় ঘোড়ার মালিককে। দরিদ্র পিতার কন্যা। কিন্তু তাসমিনা হারতে শেখেনি। ওর কাহিনি ছাপা হয়েছে প্রথম আলোর পত্রিকায়, ওকে নিয়ে তৈরি হয়েছে তথ্যচিত্র (আশা করি, না দেখে থাকলে তুমিও দেখবে: goo.gl/9757eR)। কজনকে নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরি হয়? পরীক্ষার নম্বরের জন্য নয়, পাড়া–গাঁয়ের একটি মেয়ের অসম্ভব মনোবলের জন্যই আজ সে নিজের ঘোড়ায় চেপে একের পর এক জয় ছিনিয়ে নিচ্ছে। হয়তো তাসমিনার মতো তুমিও একদিন ছুটবে টগবগ টগবগ করে। অপেক্ষা করো, তোমাকে নিয়েই আবার লেখা হবে কবি শামসুর রাহমানের এই কবিতার মতো নতুন কোনো কবিতা; নতুন হাতে, নতুন দিনে—তুমি আর ভবিষ্যৎ যাচ্ছ হাত ধরে পরস্পর/ সর্বত্র তোমার পদধ্বনি শুনি দুঃখ তাড়ানিয়া/ তুমিতো আমার ভাই, হে নতুন, সন্তান আমার…
ভারতীয় ক্রিকেট দলের এম এস ধোনিকে নিয়ে তৈরি সিনেমাটা (এম এস ধোনি: দ্য আনটোল্ড স্টোরি) তোমরা অনেকেই দেখেছ। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। পানির পাম্প অপারেটর বাবার স্বপ্ন ছিল, ছেলে লেখাপড়া শেষে রেলের টিটি হবে। ছেলের ক্রিকেট–নেশা কিন্তু মানতে পারতেন না বাবা। রেলের চাকরি ছেড়ে দেওয়াতে মনঃক্ষুণ্নই হয়েছিলেন। কিন্তু যখন গোটা স্টেডিয়ামে ধোনি ধোনি রব, তখন কিন্তু মাহীর (ধোনির ডাকনাম) বাবা হয়ে গেলেন গর্বিত ধোনির বাবা। চোখ বেয়ে নামল আনন্দের ধারা। বাবা–মা সন্তানের সাফল্যে খুশি না হয়ে পারেন?
আলীবাবা ডটকমের কর্ণধার জ্যাক মা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অঙ্কে পেলেন ১। আর ব্যবসা জীবনে? ১০০ তে ১০০! এই ‘স্বপ্ন নিয়ে’র পাতাতেই পড়েছি সেই কাহিনি। তাই কথা একটাই—যারা এ মুহূর্তে ভালো ফল করেছ, তাদের অভিনন্দন। আর বাকিদের আগাম অভিনন্দন। কারণ, চেষ্টা করলে জীবনের কোনো না কোনো ধাপে তুমি ছয় মারবেই। সুতরাং সামনে তাকাও। দেখতে পাচ্ছ? সামনে একটা ট্রেন আসছে…ঝিকঝিক…ঝিকঝিক…কুউউউউ… ঝিকঝিক…ঝিকঝিক…তোমাকে শুধু সঠিক কামরায় চড়তে হবে।