অপরিকল্পিত উচ্চশিক্ষা
- নিউজ ডেস্ক
প্রতিবছর সাত থেকে আট লাখ শিক্ষার্থী এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। তবে উচ্চশিক্ষার জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন মাত্র ৪৫ হাজার। বাকিদের ভরসা জাতীয় ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীকে পড়তে হয় নিজ খরচে। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি ও বেসরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার প্রায় পুরো খরচ বহন করছে সরকার। শিক্ষার্থীরা মাসে ২৫ থেকে ১০০ টাকা বেতন দিলেও একজনকে গ্র্যাজুয়েট করার জন্য সরকারের খরচ হয় অনেক টাকা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী গ্র্যাজুয়েশন শেষ করলেও দক্ষতার খাতায় তারা শূন্য। গ্র্যাজুয়েট হয়েও চাকরির বাজারে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ছে জাতীয় ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ফলে উচ্চশিক্ষার পেছনে সরকারের অঢেল খরচ যাচ্ছে গচ্চা।
ব্রিটিশ সাময়িকী দি ইকোনমিস্টের ‘ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)’-এর সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। দক্ষিণ এশিয়ায় এর চেয়ে বেশি উচ্চশিক্ষিত বেকার শুধু আফগানিস্তানে—৬৫ শতাংশ।
ভারতে শিক্ষিত বেকার ৩৩ শতাংশ, পাকিস্তানে ২৮, নেপালে ২০ এবং শ্রীলঙ্কায় ৭.৮ শতাংশ।
ইকোনমিস্ট বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও উচ্চশিক্ষায় পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। এখানকার নীতিনির্ধারকরা জানেন না শ্রমবাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কোন খাতে কত কর্মী প্রয়োজন। বাংলাদেশের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলো হলো তথ্য-প্রযুক্তি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, জাহাজ নির্মাণ, তৈরি পোশাক, পর্যটন, হালকা কারিগরি নির্মাণ খাত প্রভৃতি। কিন্তু এসব খাতের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত দক্ষ (বিশেষায়িত ও সাধারণ) কর্মীর খুবই অভাব।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৫ সালে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় ছিল ৯৭ হাজার ৪৪১ টাকা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯৪ হাজার ৩২৭, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৪ হাজার ৮৯৭, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক লাখ ছয় হাজার ২৮৩, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৫ হাজার ৫৮২ টাকা। বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যয় আরো বেশি। এই খরচের প্রায় পুরোটাই বহন করেছে সরকার। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে ২০১৫ সালে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় ছিল ৮৯ হাজার ৬৮৮ টাকা। আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯৭ হাজার ৯৭৭, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে এক লাখ ৫৯ হাজার ৩১৪, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে এক লাখ ৯০ হাজার ৮০৩ টাকা।
২০১৫ সালে দেশে মোট স্নাতক শেষ করেছেন পাঁচ লাখ ১৬ হাজার ৬৬৬ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করেছেন মাত্র ৪০ হাজার। ৮৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন ৬১ হাজার ৪৮২ জন। বাকি সবাই জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন না থাকলেও বাকি চার লাখ ১৬ হাজার শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন হয়েছে মুখস্থ বিদ্যার ওপর ভর করে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে জোড় বছরের জন্য আগের দু-তিন জোড় বছর এবং বিজোড় বছরের পরীক্ষার জন্য আগের দু-তিন বিজোড় বছরের প্রশ্ন পড়লেই মিলে যায়। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা হয়ে গেছে শিটনির্ভর। সেখানে বইয়ের কোনো বালাই নেই। শিক্ষার্থীদের যেতে হয় না লাইব্রেরিতে। শিক্ষকরা যে দু-চারটি শিট ধরিয়ে দেন, সেটা পড়লেই পাস।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. হাফিজ মো. হাসান বাবু বলেন, ‘একসময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যে প্রেক্ষাপট ছিল, এখন আর তা নেই। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক হাজার ৪০ কোটি টাকার একটি ফান্ড আমরা পেয়েছি। এই অর্থ দিয়ে অধিভুক্ত কলেজগুলোর অবকাঠামোর উন্নয়ন হবে। শিক্ষকরা দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ পাবেন। এ ছাড়া দেশসেরা শিক্ষাবিদদের দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ের বই প্রণয়ন করানো হবে। অপেক্ষা করুন, সামনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নত ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। ’
স্নাতকোত্তর শেষ করা বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ইংরেজি বলতে বা লিখতে পারে না। অথচ ইংরেজি জানা যেকোনো ভালো চাকরি পাওয়ার অন্যতম শর্ত।
জানা যায়, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই উচ্চশিক্ষায় যায় সীমিতসংখ্যক শিক্ষার্থী। অথচ আমাদের দেশে উল্টো পরিস্থিতি। যেকোনোভাবেই একজন শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষা
গ্রহণ করা চাই-ই চাই। আর মুখস্থ বিদ্যায় উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেট পেতে সহায়তা করছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এককথায় উচ্চশিক্ষিত বেকারত্বের জন্য প্রধানত দায়ী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও (ইউজিসি) একাধিক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলেছে, কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজ থেকে পাস করা স্নাতকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। উচ্চশিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটলেও শিক্ষার প্রত্যাশিত মান নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।
ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, ‘আমরা শিক্ষিত বেকার চাই না। আমাদের দেশের মতো সার্টিফিকেটমুখী শিক্ষা অন্য কোনো দেশে নেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোতে ভালো শিক্ষকের অভাব আছে, গবেষণাও নেই। এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব সরকারের।’
শিক্ষাবিদ ও গবেষক অধ্যাপক ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ খুবই কম। এরপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের মানও ভালো নয়। শহরকেন্দ্রিক কলেজগুলো মোটামুটিভাবে চললেও মফস্বলের অবস্থা খুব খারাপ। যত্রতত্র অনার্স খোলা হয়েছে। প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ক্লাস করে না। শিক্ষার্থীরা পাস করে চাকরির বাজারে ঢুকতে পারছে না। এ জন্য উচ্চশিক্ষা অবশ্যই সীমিত এবং এসএসসির পর থেকে কারিগরিতে আরো জোর দেওয়া দরকার।’