নতুন উদ্যোগ কতোটা সুফল আনবে
- রেজাউল করিম খোকন
বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে অতি দারিদ্র্য হার কমেছে। মূলত শিক্ষাক্ষেত্রে লিঙ্গসমতা ও সফল পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি বাস্তবায়ন এ দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে বড় ধরনের সহায়তা করেছে। নানা চরাই-উত্রাই পেরিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে উঠেছে আরো আগেই। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি বাড়াতে নারী উদ্যোক্তাদের সক্রিয় করে তোলার কোনো বিকল্প নেই। কারণ দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারীকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে সমাজ ও পরিবারে তাদের অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করা সম্ভব।
নারীর ক্ষমতায়নের ভিত্তি শক্তিশালী করতে তাদেরকে আর্থিকভাবে সচ্ছল ও স্বাবলম্বী করে তোলা প্রয়োজন। আর্থিকভাবে যদি নারী স্বাবলম্বী হয় তাহলে তার সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভাব অনেকটাই সুস্পষ্ট এবং দৃঢ় হয়ে ওঠে। নারী উদ্যোক্তাদের অধিক পরিমাণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় করে তুলতে বর্তমানে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন ব্যাংক নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিভিন্ন ধরনের ঋণ স্কিম চালু করলেও সেই ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের অনেক বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি হতে হয়। ফলে তাদের অনেকেই হতোদ্যম হয়ে পড়েন। নারী উদ্যোক্তাদের ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা হলো আবেদনকৃত ঋণের বিপরীতে জামানত প্রদানে ব্যর্থতা। যে সব নারী উদ্যোক্তা জামানতের অভাবে ব্যাংক ঋণ পান না, তাদের জন্য জামানত নিশ্চয়তা তহবিল (ক্রেডিট গ্যারান্টি ফান্ড) গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সংক্রান্ত দুটি তহবিল গঠনে সহায়তা দেবে সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি (সিডা) ও ইউনাইটেড ন্যাশন ক্যাপিটাল ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (ইউএনসিডিএফ)। এর মধ্যে সিডা দেবে দেড় কোটি ডলার যা বাংলাদেশি ১২০ কোটি টাকার সমান ও ইউএনসিডিএফ দেবে এক লাখ ডলার বা ৮০ লাখ টাকা। এর মধ্যেই ইউএনসিডিএফ এর তহবিল পাবার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। খুব শীঘ্রই সিডার তহবিলও পাওয়া যাবে। এই দুটি তহবিলই বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই এন্ড স্পেশাল প্রোগ্রামস বিভাগ।
বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, সারা দেশে বর্তমানে প্রায় ৯ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা রয়েছে। যার মধ্যে ১৭ শতাংশই নারী। এ ধরনের তহবিল গঠনের প্রেক্ষিতে নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে এক ধরনের আশার সঞ্চার হয়েছে। কারণ সব ধরনের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও অন্যান্য যোগ্যতা থাকার পরেও বেশিরভাগ নারী উদ্যোক্তা জামানত প্রদানে ব্যর্থতার কারণে ব্যাংক ঋণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন। বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালিত এই জামানত নিশ্চয়তা তহবিল দরিদ্র অসহায় আর্থিকভাবে অসচ্ছল নারীদের ব্যাংক ঋণ পাওয়া অনেকটা সহজলভ্য করবে। এর মাধ্যমে নারীদের অর্থনৈতিক মূলধারায় অধিকহারে সম্পৃক্ত করবে। এতে সমাজে নারীর ক্ষমতায়নও বাড়বে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশ কয়েকটা পুনঃঅর্থায়ন স্কিম রয়েছে। প্রতিটি তহবিল থেকে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ন্যূনতম ১৫ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে এসব তহবিল থেকে নারীদের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এছাড়া এসব তহবিল থেকে নারীদের ব্যক্তিগত গ্যারান্টিকে বিবেচনায় এনে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। যদিও এ ক্ষেত্রে গ্রুপ জামানত বা সামাজিক জামানত গ্রহণের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন ব্যাংক এই নির্দেশনা মানছে না বলে জানা যায়। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নারী উদ্যোক্তাদের জামানত বিহীন ঋণ দিতে নানা দ্বিধা সংকোচে ভোগে। অনেক ধরনের শর্ত আরোপের কারণে শেষ পর্যন্ত আগ্রহী নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ না নিয়েই খালি হাতে বাড়ি ফিরে যেতে হয়। ব্যাংক ঋণ দিতে গেলেই ব্যাংক জামানত অর্থাত্ সিকিউরিটি এবং গ্যারান্টার মানে জামিনদার চায়। এক্ষেত্রে জমি, আবাসিক বাণিজ্যিক ফ্ল্যাট কিংবা ব্যাংকে রাখা এফডিআর জামানত হিসেবে নেওয়া হয়ে থাকে। পাশাপাশি জামিনদার অর্থাত্ গ্যারান্টার হিসেবে উদ্যোক্তা নারীর স্বামী, ভাই কিংবা বাবা ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের সই নেওয়া হয়। সাধারণত একজন উদ্যোক্তাকে যতটা ঋণ দেওয়া হয় তার বিপরীতে শতভাগের বেশি সিকিউরিটি দাখিল করতে হয়। এ ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন সিকিউরিটি হয় ১১০ শতাংশ। তবে বেশির ভাগ ব্যাংকই ১৫০ থেকে ১৮০ শতাংশ পর্যন্ত জামানত চায়। কিন্তু এখানকার নারী উদ্যোক্তাদের বেশির ভাগের পক্ষে জামানত প্রদানের এই শর্ত পূরণ করা সম্ভব হয় না। ফলে প্রচণ্ড ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ব্যবসা-বাণিজ্যে আমাদের নারী উদ্যোক্তারা যথেষ্ট পরিমাণে এগিয়ে আসতে পারছেন না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে গঠিত জামানত নিশ্চয়তা তহবিল এর সুবিধা গ্রহণে আগ্রহী ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে চুক্তি সম্পাদন করতে হবে প্রথমে। কেবল নতুন নারী উদ্যোক্তারা চুক্তিবদ্ধ ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের জন্য আবেদন করবেন। এ ক্ষেত্রে একজন নারী উদ্যোক্তাকে যে পরিমাণ ঋণ দেওয়া হবে তার জন্য যে পরিমাণ জামানত এর টাকার প্রয়োজন হবে, সেই পরিমাণ কভারেজ পাওয়া যাবে এ তহবিল থেকে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এ তহবিল থেকে ব্যাংকগুলোকে তার প্রদত্ত ঋণের জামানতের টাকার অর্থাত্ সিকিউরিটি মানির ৫০ শতাংশ কভারেজ দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা চলছে। অবশিষ্ট ৫০ শতাংশ কভারেজ ব্যাংকগুলোকে নিজেদের বহন করতে হবে। জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালিত জামানত নিশ্চয়তা তহবিলের সুবিধা তখনই পাওয়া যাবে, যখন প্রদত্ত ঋণটি মন্দমানের খেলাপী ঋণে পরিণত হওয়ার পর ন্যূনতম ছয় মাস অতিক্রান্ত হবে।
নারী উদ্যোক্তাদের ব্যাংক ঋণ গ্রহণে বিদ্যমান বাধা-বিপত্তিগুলো দূরীকরণে গৃহীত পদক্ষেপগুলো যদি যথাযথভাবে কাজে লাগানো যায় তাহলে এ ক্ষেত্রে দারুণ এক বিপ্লব ঘটবে সন্দেহ নেই। জামানত প্রদান নিয়ে নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে এতোদিন ধরে যে অশ্চিয়তা ও অসহায়ত্ব ভাবটি বজায় ছিল তা জামানত নিশ্চয়তা তহবিল গঠনের মাধ্যমে অনেকটাই দূরীভূত হবে। তবে এ ব্যাপারে গৃহীত পদক্ষেপগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব না হলে পরিস্থিতির কোনো উন্নয়ন ঘটবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক সিডা ও ইউএনসিডিএফের আর্থিক সহযোগিতায় নারী উদ্যোক্তাদের জন্য জামানত নিশ্চয়তা তহবিল গঠনের ব্যাপারটি সবাইকে আশাবাদী করে তুলেছে। আমরা সবাই প্রত্যাশা করি এর সুফল নারী উদ্যোক্তারা ভোগ করতে পারবেন পরিপূর্ণভাবে।