ভর্তি ও পরীক্ষা নিয়ে কেন তাড়াহুড়া
- ড. সুলতান মাহমুদ রানা
শিক্ষা নিয়ে গণমাধ্যমে সবসময়ই নানাবিধ আলোচনা-সমালোচনা চলে। কারণ সবাই চাই শিক্ষার উন্নয়ন। ফলে শিক্ষা নিয়ে সবার ইতিবাচক ভাবনা থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণসহ নানা অভিযোগের কথা আমাদের সামনে চলে এসেছে। এসব নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিকারের যথেষ্ট উদ্যোগ থাকলেও প্রকৃত অর্থে এখনও অনেক সমস্যা আমাদের চোখে পড়ছে। প্রায়ই গণমাধ্যমে এমন কিছু খবর প্রচারিত কিংবা প্রকাশিত হয়, যা দেখে আমরা হতবাক কিংবা হতাশ হয়ে উঠি।
শিক্ষার্থীরা যখন পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে অনেক ভালো ফল করে, তখন আমাদের মনটা ভরে যায়। আবার যখন দেখি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ওইসব ভালো ফলধারীর অনেকেই পাস নম্বরও তুলতে ব্যর্থ হয়, তখন লজ্জায় মাথা নুয়ে পড়ে। স্বাভাবিক কারণেই শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কয়েক দিন আগে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে হঠাৎ বিনা নোটিশে ফল পরিবর্তনের একটি খবর প্রচারিত হয়। ংবাদে প্রচারিত হয় যে, সম্মান শ্রেণির ফল চূড়ান্তভাবে ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হওয়ার দুই মাস পর তা পরিবর্তন করা হয়। হঠাৎ ফল পরিবর্তনে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর ফল পাল্টে যায়। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান শ্রেণির চূড়ান্ত ফল ওয়েবসাইটে দুই মাস প্রচারিত হওয়ার পর কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া পরিবর্তন করে দেওয়ার বিষয়টি শিক্ষা ব্যবস্থাপনার অদক্ষতার একটি বড় উদাহরণ।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল প্রকাশের পর ওয়েবসাইট থেকে মার্কশিট গ্রহণ এবং তা দিয়ে চাকরিতে আবেদন করা যায়। ইতিমধ্যেই সংশ্লিষ্ট ফলধারী অনেক শিক্ষার্থী চাকরির আবেদন করেছে। কিন্তু হঠাৎ ফল পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় ওইসব শিক্ষার্থীর চাকরি পাওয়ার বিষয়টি অনিশ্চয়তায় রূপ নিয়েছে। উল্লেখ্য, জাবির সব চূড়ান্ত ফলই ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিংবা কলেজে কোনো ফলের প্রিন্ট কপি দেওয়া হয় না। ওই ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে বলে গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পেরেছি।
দীর্ঘদিন থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সেশনজটে পূর্ণ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট কমিয়ে আনতে ইতিমধ্যেই নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। আর এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার অন্যতম অংশ হলো দ্রুত ও তড়িঘড়ি করে পরীক্ষার ফল প্রকাশ। আর তড়িঘড়ি করে ফল প্রকাশ করতে গিয়েই হয়তো এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ভুলের সৃষ্টি হয়ে থাকে; যা শিক্ষার্থীদের প্রচণ্ড মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। সম্প্রতি অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স পাঠদানে মান রক্ষা বা বৃদ্ধি নয়, তড়িঘড়ি করে কোর্স শেষ করতেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে জাবি। অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ের উত্তরপত্র মূল্যায়নে চিরায়ত রীতি ভেঙে একক পরীক্ষক দিয়েই তা করা হচ্ছে। একক পরীক্ষক দিয়ে উত্তরপত্র মূল্যায়নের বিষয়টি কোনোভাবেই ন্যায্য ও যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না। এমনকি সেমিস্টার পদ্ধতি চালু না হলেও একই বছরে দুটি পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। শুধু সেশনজট দূর করতে শিক্ষা ক্ষেত্রে এমন তড়িঘড়ি ও আত্মঘাতীমূলক সিদ্ধান্ত কখনোই শিক্ষার গুণগত উন্নয়নের সঙ্গে মানানসই নয়।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থীকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে ক্লাসে উপস্থিত থাকার বিষয়টি অপরিহার্য নয়। অথচ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থী নির্ধারিত সংখ্যক উপস্থিতি না থাকলে ওই শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে না। সম্প্রতি সরকারের জঙ্গি দমনের অংশ হিসেবে ক্লাসে উপস্থিতি-অনুপস্থিতির বিষয়টি নজরে রাখতে বলা হলে কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিশ্ববিদ্যালয় সামগ্রিক শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানায়। কিন্তু জাবি কিংবা এর অধিভুক্ত কোনো কলেজ অনুপস্থিতির তালিকা কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিয়েছে কি-না তা আমার জানা নেই। অথচ জাবি অধিভুক্ত বেশিরভাগ কলেজ শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের উপস্থিতি ছাড়াই পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে থাকে।
প্রধানমন্ত্রী ২০১৪ সালের ৩১ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করতে গিয়ে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির বিষয়টি মাথায় রেখে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সব সরকারি-বেসরকারি কলেজকে সংশ্লিষ্ট এলাকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়ার নির্দেশ দেন। এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন হলে জাবির ওপর চাপ কমার পাশাপাশি লেখাপড়ার মান বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিতে পারত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এই নির্দেশনা বাস্তবায়নের কার্যক্রম শুরু করলেও এই প্রক্রিয়া থেমে যায়।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সীমিত আসনের কারণে সবার ভর্তির সুযোগ হয় না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিমাত্রায় শিক্ষা ব্যয়ের কারণে দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা ভর্তি হতে পারে না। বর্তমানে সব শ্রেণির (নিম্ন থেকে উচ্চ) পরিবারের সন্তানরা অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ে পড়াশোনা করে। আর এই সুযোগে ২০১৬-১৭ সালে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কার্যক্রম শুরু না হতেই তড়িঘড়ি করে গত ৫ নভেম্বরের মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্র্ষে ভর্তি কার্যক্রম শেষ করা হয়। শিক্ষার্থীরা নিজেদের ভর্তির অনিশ্চয়তার বিষয়টি বিবেচনা করে জাবিতে ভর্তি হতে বাধ্য হয়। উল্লেখ্য, কোনো শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলে পুনরায় ফি দিয়ে ওই ভর্তি বাতিল করে ছাড়পত্র নিতে হবে। জাবির দ্রুত শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর নামে আর্থিক সচ্ছলতা বাড়ানোর প্রক্রিয়াটি সবার কাছেই স্পষ্ট। এমন তড়িঘড়ি কার্যক্রম কোনোভাবেই শিক্ষার জন্য শুভ ইঙ্গিত বয়ে আনে না। শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে সঠিক নীতি, পরিকল্পনা এবং মানসম্পন্ন ব্যবস্থাপনার যথাযথ প্রয়োগ ঘটাতে না পারলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বড় একটি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান ক্রমেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়