কোনটা শখ, কোনটা মোহ ?
- ফিচার ডেস্ক
শখ আমাদের মনের পথটাকে রাখে গোছালো, আগলে রাখে যাবতীয় বিপথ থেকে। তাই শখ থাকাটা জরুরি বটে। তবে শখের পেছনে দিন-রাত লেগে থাকলে সেটি হয়ে যায় ঘোর।
মনে করো, কেউ খেতে ভালোবাসে। কিন্তু এমন যদি হয় যে ওই বন্ধুটির সঙ্গে যত কথাই হোক না, তুমি যে কথাই বলো না কেন, তার শেষটুকু গিয়ে পৌঁছচ্ছে খাবারে, তাহলে ব্যাপারটা চিন্তার বিষয়।
স্নিগ্ধা গাছ ভালোবাসে। নানা রকম গাছের ছবি, সেই গাছ নিয়ে সমস্ত তথ্য জোগাড় করা তার শখ। গাছের ছবি তুলে বা পেপার থেকে কেটে সেটি নিজের ‘হবি বুক’-এ আঠা দিয়ে আটকে রাখে স্নিগ্ধা। পাশে লিখে রাখে সব তথ্য। অন্য দিকে, রাশিনের শখ হ্যারি পটারকে ঘিরে। একটা সময় হ্যারি পটারে মুগ্ধ হয়ে পড়েছে রাশিন। একটু একটু করে হ্যারি পটারের সঙ্গে জুড়ে আছে এমন সব জিনিস জড়ো করা হয়ে গিয়েছিল ওর শখ। কিন্তু এখন? এখন কেন যেন মাঝে মাঝে হ্যারি পটারের দুনিয়ায় চলে যেতে ইচ্ছা হয় ওর। মনে হয়, ও একটা সময় হগওয়ার্টে পড়বে। সেখানে নানা রকম জাদু করতে শিখবে সে। বইয়ে লেখা সবগুলো জাদুর কথাও তার মুখস্থ।
স্নিগ্ধা আর রাশিন—দুজনের ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা এক রকম বলা যায়। কিন্তু সেটি পুরোপুরি কি এক রকম? একটু কি পার্থক্য পাচ্ছ তুমি ওদের শখের ভেতরে? ঠিক ধরেছ! স্নিগ্ধার শখটা এখনো খুব সাধারণ শখের পর্যায়ে আছে। কিন্তু রাশিন? ওর হ্যারি পটারের প্রতি ভালোবাসাকে এখন আর শখ বলা যায় না। মনোবিজ্ঞানে এই পর্যায়কে বলা হয় অবসেশন বা ঘোর। যেখানে শখের চেয়ে অনেক বেশি কিছু অনুভব করে মানুষ। একজন মানুষের জন্য শখ খুব ভালো ব্যাপার হলেও, ঘোর বা অবসেশন তেমনটা নয়। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে একে ক্ষতিকারকও বলা চলে।
এ ব্যাপারে মনোবিজ্ঞানী ডা. সালাউদ্দিন কাউসার বিপ্লব বলেন, ‘শখ ও অবসেশন দুটি দুই বিষয়। শখ ইতিবাচক। অবসেশন ব্যাপারটাও ইতিবাচক মাঝেমধ্যে হতে পারে। তবে সব সময় নয়। কোনো কিছুই অতিরিক্ত হলে সেটি ভালো ফল বয়ে আনে না। শখ মানুষ তৈরি করে। কিন্তু অবসেশন মানুষের জন্মগত। মানুষ যেটি বারবার করে, সেটিই অবসেশন। তবে এই অবসেশনের একটি স্থান জুড়ে থাকে শখ। মানুষের শখ যখন ক্ষতিকর ও মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তখন সেটিকে ঘোর বা অবসেশন বলা যায়। তবে হ্যাঁ, এর মানে এই নয় যে শুধু শখ থেকেই অবসেশন হয়। এটা অন্য আরো অনেক কিছু থেকেই হতে পারে।’
গল্পের বই পড়ার শখ থাকতেই পারে, তাই বলে ২৪ ঘণ্টা গল্পের বই আগলে রাখাটা ঠিক হবে কি?
ঘোরের লক্ষণ
যদি কখনো এমন মনে হয় যে শখের বশে করা কাজগুলো একজন মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে মনে হচ্ছে, সেটি ছাড়া দিন চলছে না, ইচ্ছা করলেই সেই শখ ছেড়ে থাকা যাচ্ছে না, যেকোনো কাজ শুরু করা হোক না কেন, সেটি শেষ পর্যন্ত ওই শখ পর্যন্ত গিয়েই পৌঁছচ্ছে, এমনকি তার প্রভাব পড়ছে অন্যদের ওপরও, তবে সেটিকে অবসেশন বা মোহাচ্ছন্ন বলে ধরে নেওয়া যায়।
মনে করো, কেউ খেতে ভালোবাসে। কিন্তু এমন যদি হয় যে ওই বন্ধুর সঙ্গে যত কথাই হোক না কেন, তার শেষটা গিয়ে পৌঁছচ্ছে খাবারে, তাহলে ব্যাপারটা চিন্তার বিষয়। আর্থিকভাবেও এই অবসেশন মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। মোহাম্মদপুর সরকারি কলেজের প্রথম বর্ষের বাঁধন খেতে খুব ভালোবাসে। কেন এমন শখ? বাঁধন জানাল, ‘খাবার মুখে নিলেই সেটার যত উপাদান, তার সব কটার স্বাদ আলাদা করে বুঝতে পারি। এটা আমার খুব ভালো লাগে। বিভিন্ন দেশের এত এত খাবার যে সেগুলো একবারে খাওয়া সম্ভব নয়। আর আমি একবারে খাওয়ার চেষ্টাও করি না। মাসে তিন দিন বাইরে খাই। পরিশ্রমও করি অনেক, যাতে মুটিয়ে না যাই। আমি মনে করি না আমার এ শখ ক্ষতিকর কিছু।’
অবসেশন কেন
নিজের ভালো লাগার কাজ বা শখ পূরণ করলে আমাদের মস্তিষ্কে বেটা-এন্ড্রোফিন নামের এক ধরনের হরমোন তৈরি হয়। এই রাসায়নিক পদার্থটির কারণে আমাদের মন উত্ফুল্ল থাকে। এই ভালো বোধটুকুই একটা সময় আমাদের অবচেতন মন বারবার চাইতে থাকে। বারবার নিজের শখ পূরণ করতে করতে এটা মাথায় আরো শক্ত করে গেড়ে বসে।
অনেকে আবার নানা ধরনের মানসিক চাপ বা হতাশা, বিষণ্নতা কাটাতে শখের আশ্রয় নেয়। আর সেই শখটাকেই মনে করে জীবনের ধ্যান-জ্ঞান। সে শখটাই শেষে ঘোরে গিয়ে দাঁড়ায়। এ ক্ষেত্রে শখটা যদি উৎপাদনশীল কিছু হয়, তবে সেটি সমস্যা তৈরি করে না। উল্টো সফলতা এনে দিতে পারে। যেমন দিন-রাত প্রগ্রামিং করা বা বিশেষ কোনো জ্ঞানের চর্চা করা। কিন্তু অর্থহীন শখের পেছনে বেশি সময় নষ্ট হওয়া মানেই সেটি ক্ষতিকর মোহের দিকে গড়াবেই।
ধানমণ্ডির দেবযানী কার্টুন দেখতে ভালোবাসে। নানা রকম কার্টুনের স্টিকার জমানো তার শখ। কিন্তু কী থেকে কী হলো, হুট করে একেবারে কার্টুনের মতো করে সাজতে শুরু করল দেবযানী। কথাও বলতে লাগল কার্টুন চরিত্রগুলোর মতো করে। কার্টুন না থাকলে খাওয়াদাওয়াও বন্ধ। ঠিকমতো কারো সঙ্গে কথা বলে না। দেবযানীর মা-বাবা এক রকম চিন্তিত হয়েই মেয়েকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলেন। এখন রীতিমতো তার কার্টুনমুক্তির থেরাপি চলছে।
অনেক সময় কোনো মানুষ জানতেই পারে না যে তার শখ নেশা বা অবসেশনে পরিণত হচ্ছে। একাকিত্ব থেকে দূরে থাকার জন্য বা অন্য কোনো কারণে শখকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে একটা সময় সে ঘোরের মধ্যে চলে যায়। শখ ও নেশার মধ্যে থাকা পার্থক্যটুকু সম্পর্কে ধারণা না থাকায়ই এ সমস্যা হয় বেশি।
মজার ব্যাপার হলো, আমাদের মন কিন্তু এতটা বোকা না। তুমি খুব সহজেই যে শখ থেকে নেশার দিকে চলে যাবে, এমনটা কিন্তু হওয়া সম্ভব না। বিশেষ করে বর্তমান সময়ে তো সেটি একটু বেশিই কঠিন। কেন হবে না বলো? সারা দিন এত এত কাজ, সেগুলোর মধ্যে কোনো শখ পালন করা, আর সেই শখ অতিরিক্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া বেশ কষ্টকর ব্যাপার, তাই না? এ ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে ভয় কাজ করে যে কোনো একটা কাজ বেশি করলে হয়তো অন্য কাজে সময় দেওয়া যাবে না। তুমিই ভাব, পড়াশোনা, টিউশন, খেলাধুলা, গেমস খেলা, বই পড়া—এত কিছুর পর অনেকটা সময় তুমি পাচ্ছ কোথায় শখ মেটানোর জন্য?
মানুষ হতাশা বা বিষণ্নতা থেকে অবসেশনের দিকে চলে যায়। তবে ইদানীং মানসিক চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াটা এখন বেশ প্রচলিত। তাই ইচ্ছা করলেই খানিকটা সময় চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে আসতে পারো।
কোনো ব্যাপারে মোহ তৈরি হলে প্রাথমিকভাবে তুমি নিজেই নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে পারো। কিন্তু যদি তা সম্ভব না হয়, তবে নিজের খুব কাছের কোনো বন্ধু বা মা-বাবার সাহায্য নাও। তাঁরা তোমাকে সাহায্য করবেনই। তাতেও কাজ না হলে, মনোবিদরা তো আছেনই।
ডা. বিপ্লব বলেন, ‘শখ মানুষ একটা পুরস্কারের জন্য করে, ভালো লাগে বলে করে। কিন্তু অবসেশন বিরক্ত হওয়া, রাগ লাগা, ভালো লাগা—এসব অনুভূতি থেকে আসে। অবসেশন কোনো ব্যক্তির মধ্যে পাওয়া গেলে এবং সেটি সামাজিক, আর্থিক, মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্ষতিকর হলে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলাই শ্রেয়।’
ভয় পাওয়ার কিছু নেই। শখ মানেই যে সেটি নেশার দিকে চলে যাবে এমন নয়। কোনো একটি শখ তোমাকে মানসিকভাবেও ভালো থাকতে সাহায্য করবে। তুমি যেন ইচ্ছা করলেই শখ থেকে দূরে থাকতে পারো—এমন মানসিকতা তৈরি করো।
সাইকোলজি টুডে ডটকমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে স্নায়ুবিজ্ঞানী থিও সাওসাইডস বলেছেন, একই সঙ্গে কয়েকটি শখ রাখা নিরাপদ। কারণ এতে একটা শখ কাউকে আচ্ছন্ন করে রাখতে পারবে না।
কী শখ, কেন শখ?
♦ গাছগাছালির শখ থাকতে পারে, যদি তুমি প্রকৃতি ভালোবাসো।
♦ ডাকটিকিট বা মুদ্রা জমাও নানা দেশকে জানতে চাইলে, ইতিহাস ভালোবেসে থাকলে।
♦ ছবি আঁকো রং নিয়ে খেলতে চাইলে, নিজের ভেতরের ভাবনা ক্যানভাসে ফোটাতে চাইলে।
♦ শরীর সুস্থ রাখতে সাইকেল চালানো থেকে শুরু করে যাবতীয় খেলাধুলাও হতে পারে শখের বস্তু।
♦ ছবি তোলার শখ আছে? তার মানে তুমি মজার, আনন্দঘন বা বিশেষ মুহূর্ত ধরে রাখতে চাও। বা হতে পারে, তোমার বড় আলোকচিত্রী হওয়ার লক্ষ্য আছে।
♦ অন্য ভাষা শেখাও হতে পারে শখ। এতে ভিনদেশে যাওয়া বা ভিনদেশি কারো সঙ্গে বন্ধুত্বের খায়েশটাও মিটবে।
♦ বই পড়ার শখ সবচেয়ে কমন। তবে এটাই সবচেয়ে দামি। কারণটা নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা করতে হবে না! আর লেখালেখি করার শখ যদি থাকে, তার জন্যও আগে ঢের বই পড়া চাই।
♦ বাদ্যযন্ত্র বাজানোর শখ আছে, মানে তুমি সুর ভালোবাসো। আর এ শখ ধরে রাখলে বড় শিল্পী হতে কতক্ষণ! এ শখ থাকলে বন্ধুমহলেও পাবে বাড়তি কদর।