ভার্চুয়াল দুনিয়ার সতর্কতা
- ফিচার ডেস্ক
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ফেসবুকের মতো ওয়েবসাইটগুলো তৈরি হয়েছিল যোগাযোগের জন্য। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে, যোগাযোগমাধ্যম পরিচয়টি ছাপিয়ে এগুলো হয়ে উঠেছে ব্যবহারকারীদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আড্ডা থেকে শুরু করে বিদেশ-বিভুঁইয়ে থাকা আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধবের সাথে কথোপকথন, গ্রুপ স্টাডি, বেড়াতে গিয়ে ছবি তুলে আপলোড করা, লেখালেখি, এমনকি যেকোনো তথ্য আদানপ্রদানে দারুণ জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। আজকাল ফেসবুককে কাজে লাগিয়েই দারুণ সব সৃজনশীল কাজ ও সংগঠন পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে, সৃজনশীল ভাবনা তুলে ধরা যাচ্ছে। কখনো গণমাধ্যমের ভূমিকাও পালন করছে এ মাধ্যম।
পড়াশোনার ব্যাপারটাই ধরা যাক। ক্লাসের সব বন্ধু-সহপাঠী সবসময় একাধিক হওয়া সম্ভব হয় না। অথচ গ্রুপ স্টাডি বা নিজেদের মধ্যে তথ্য আদানপ্রদান করা দরকার। দেখা গেল যে, হঠাত্ পরীক্ষার আগের রাতে কারো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের নোটের প্রয়োজন হলো। এখন উপায়? মুহূর্তের মধ্যেই অন্য এক বন্ধু তা ছবি তুলে পাঠিয়ে দিল মেসেঞ্জারে। ব্যস, ঝামেলা শেষ। বুয়েটের শিক্ষার্থী আবু সাদাত সায়েম বললেন, ‘একটা ফেসবুক গ্রুপ আছে আমাদের ডিপার্টমেন্টের। সেখানে সব পড়াশোনার আপডেট পাওয়া যায়। বন্ধুরা সবাই মিলে শেয়ার করছে। আবার কারো কোনো প্রয়োজন হলেও হাজির হয় সবাই। ফেসবুকেই ক্লাসের সময়সূচি, অ্যাসাইনমেন্ট জমার তারিখ, রুটিনসহ সবরকমের তথ্য আদানপ্রদান হচ্ছে।’
অনেকসময় গণমাধ্যমের তাত্ক্ষণিক খবরও ফেসবুকেই পাওয়া যায়। এতে করে নিজেকে আপডেটেড রাখা যায়।
সামাজিক যোগাযোগের সাইটে আজকাল অনেকেই শিক্ষামূলক ভিডিও শেয়ার করেন। একজন রসায়নের শিক্ষক শেয়ার করতে পারেন কোনো একটা কঠিন চ্যাপ্টারের ওপর তার নেওয়া ক্লাস। এভাবে বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের উপকারে আসে। তাছাড়া পড়ালেখার কাজে প্রযুক্তি ব্যবহার করাটাও অনেকের কাছে আকর্ষণীয়।
এ তো গেল ইতিবাচক দিকগুলো। আরও আট-দশটা জিনিসের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেরও নেতিকবাচক দিক আছে। অনেক সময়ই অপ্রাসঙ্গিক আলোচনায় মনোযোগ নষ্ট হয়। অনলাইনের বিশাল জগতে অবাধে বিচরণ করার স্বাধীনতা পেলে লাভের চেয়ে ক্ষতি হয় বেশি। অনেকেই আছেন, যারা ফেসবুকে ভুয়া প্রোফাইল তৈরি করে নানারকম ভুয়া খবর বা অতিরঞ্জিত কথাবার্তা ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করেন। এর থেকে সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছে বেশ কয়েকবার। আজকাল ইনবক্সে-মেসেঞ্জারে প্রায়ই একটি বিশেষ ধরনের মেসেজ দেখা যায়, ‘এই মেসেজটি বিশজনকে পাঠালে এই সপ্তাহে ভালো খবর পাবেন।’ ‘ভালো খবর’-এর আশায় অস্থির হয়ে থাকা ফেসবুক ব্যবহারকারীরাও ফরোয়ার্ড করতে থাকেন সেই মেসেজ। এমনটাও চোখে পড়ে, ‘ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুটির ছবি শেয়ার করলে প্রতি শেয়ারে শিশুটি এক টাকা পাবে।’ আবেগের বশবর্তী হয়ে অথবা ব্যবহারকারীদের অসচেতনতার কারণেই মুহূর্তেই ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়ে এসব পোস্ট। ফলাফল ‘শূন্য’। যারা এমনটা করেন, তাদের তালিকায় রয়েছেন শিক্ষার্থী, শিক্ষক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী এমনকি সরকারি কর্মকর্তারাও। আবার কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ বা গালিগালাজ করার জন্যও অনেকের কাছে দারুণ অস্ত্র ফেসবুক। সুতরাং নানা নাটকীয়তার এই যোগাযোগমাধ্যমে মেতে থাকতে গিয়ে অনেকেই ভুলে যান, কিছু সাধারণ রীতিনীতি এখানেও মেনে চলতে হয়।
ধরা যাক, কেউ একজন বেশকিছুদিন ধরে ফেসবুক ব্যবহার করছেন না। পরিচিত একজনের সঙ্গে দেখা হতেই প্রশ্ন, কী ব্যাপার কোথায় ছিলেন এতদিন? ব্যাপারটা এমন দাঁড়ালো যে, ফেসবুকে অনুপস্থিত মানেই কোথাও চলে গিয়েছিল। অথচ ফোনে খোঁজ নেওয়ার ব্যাপারে কারোরই আগ্রহ নেই। আবার জন্মদিনে যেমন কার্ড বা উপহার দেওয়ার চল বদলে গিয়ে ফেসবুকে শুভেচ্ছা জানানোর চল এসেছে, একইভাবে কারোর অসুস্থতার খবরেও ‘সুস্থতা কামনা করি’ লিখে দায় সারা হয়ে যাচ্ছে। দেখতে যাওয়া বা খোঁজখবর নিয়ে কথা বলার অভ্যাসও হারিয়ে গেছে।
বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, এখন প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে কিশোর-কিশোরীরাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বেশি ব্যবহার করছে। আর বিশেষ করে বাবা-মা কর্মজীবী হলে একা বেড়ে ওঠা অনেক ছেলেমেয়েই স্মার্টফোনেই বেশি ব্যস্ত থাকছে। ২০১৭ সালে রয়াল সোসাইটি অব পাবলিক হেলথ একটি জরিপ করে কিশোর-কিশোরীদের ওপর। ফলাফলে দেখা যায় স্ন্যাপচ্যাট এবং ইনস্টাগ্রাম তাদের মনে হতাশা তৈরি করছে। নিজের শরীরী গঠনও কারো কারোর হতাশার কারণ। আবার ফেসবুকের কারণে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ বা অপমান-হয়রানি করার প্রবণতা আরও গুরুতর আকার নিয়েছে। ভুক্তভোগীদের মানসিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। কথাসাহিত্যিক ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, ‘পারিবারিক বন্ধনের ধরন বদলে গেছে। সময় কাটাতে অনেকেই বেশি বেশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করছে, তাই শারিরীকের ও মানসিক ক্ষতি হচ্ছে। অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে আসক্তি তৈরি হচ্ছে। আর এতে নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে।’
হলিফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. সালমা ইয়াসমিন বলেন, ‘দীর্ঘক্ষণ মোবাইল ফোন আর কম্পিউটার ব্যবহারের জন্য চোখ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি লম্বা সময় ধরে বসে থাকায় মেরুদণ্ডেও ব্যথা হতে পারে। হতে পারে ঘুমের সমস্যাও। এসব ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।’ সাধারণ ব্যবহারকারীদের ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শান্তা তাওহীদা বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগাতে হবে। সত্যতা যাচাই না করে যেনতেন পোস্ট শেয়ার করে অন্যদেরকে বিভ্রান্ত করা যাবে না।’
সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ২০১৬ সালে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ‘সরকারি প্রতিষ্ঠানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার নির্দেশিকা’ জারি করে। সেখানে বলা হয়েছে, কোনো সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে এমন কন্টেন্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না। জনমনে অসন্তোষ বা অপ্রীতিকর মনোভাব সৃষ্টি করতে পারে এমন কনটেন্ট প্রকাশ করা যাবে না। এ ছাড়া দেশে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে হেয় করে কিছু বলা যাবে না। কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রকে হেয় প্রতিপন্ন করে এবং লিঙ্গ বৈষম্য বা এ সংক্রান্ত বিতর্কিত কোনো কনটেন্ট প্রকাশ করা যাবে না। সাধারণ মানুষের জন্য কাগজে কলমে এধরনের কোনো নীতিমালা নেই, যদিও নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের জন্য আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে এই নির্দেশিকার কথাগুলো সবার জন্যই প্রযোজ্য হতে পারে। একজন মানুষ অনলাইনে কেমন আচরণ করছেন, তা থেকেও তার ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে। সেজন্য জানতে হবে, মানতে হবে নিয়মকানুন।