বিশ্ব সিএমএল দিবস
- ডা. অখিল রঞ্জন বিস্বাস
আজ ২২ সেপ্টেম্বর বিশ্ব লিউকেমিয়া দিবস। ২০০৮ সাল থেকে লিউকেমিয়া রোগী ও এর চিকিৎসা ও গবেষণার সাথে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো দিনটি পালন করে আসছে। অসংখ্য উপলক্ষ আর দিবসের ভিড়ে এটি মনে হতে পারে স্রেফ আর একটা ‘দিবস’। এই একই দিনে ভিন্ন কোন উপলক্ষে ভিন্ন কোন দিবসও থাকতে পারে হয়তো। তবে এই দিনে CML দিবস পালন করার বিশেষ একটা তাৎপর্য আছে বৈকি। সেটাপরবর্তী আলোচনায় চলে আসবে।
CML এক ধরনের রক্তের ক্যান্সার বা blood cancer. রক্তের ক্যান্সারসমূহের মধ্যে প্রাদুর্ভাবের হার বিবেচনায় CML এর অবস্থান একেবারে শীর্ষের দিকে না হলেও বৈজ্ঞানিক মহলে আলোচনার ক্ষেত্রে এটি সবসময় শীর্ষের দিকেই থেকেছে। এর কারন সম্ভবতঃ এই যে CMLকে বলা হয়ে থাকে ‘disease of first.’ এটাকে ‘disease of first’ বলার কারন- ১) এই রোগের ক্ষেত্রেই সর্বপ্রথম leukemia অভিধাটি ব্যবহার করা হয় (রুডলফ্ ভারকো, ১৮৪৫) ২) এই ক্যান্সারের ক্ষেত্রেই সর্বপ্রথম ক্যান্সারের পিছনের কার্যকারন (triger) হিসেবে সুনির্দিষ্ট জিনগত বিকৃতি চিহ্নিত হয, এবং ৩) ঐ জিনগত বিকৃতিকে লক্ষ্য (target) করে ওষুধ আবিষ্কারও হয় এই রোগের ক্ষেত্রেই প্রথম। এছাড়াও তেজসক্রিয় বিকিরনের সাথে ক্যান্সারের যে কার্যকারণগত সম্পর্ক রয়েছে সেটাও প্রথম চিহ্নিত হয় সম্ভবতঃ এই ক্যান্সারের ক্ষেত্রেই। অনেকেরই হয়তো জানা থাকবে সারা জীবন তেজসক্রিয়তা নিয়ে গবেষনা করে দু’দুবার নোবেল পুরস্কার বিজয়ের বিরল সম্মানের অধিকারিণী মাদাম মেরি কুরি মৃত্যুবরণ করেন এই CML এ আক্রান্ত হয়ে।
জিনগত যে বিকৃতির বা genetic triger এর দ্বারা CML উদ্ভুত হয় তা হচ্ছে রক্তের বীজ কোষের (hemopoetic stem cell) ৯ নং ক্রমোজোমের লম্বা বাহুর একটি অংশ কোনভাবে ভেঙে গিয়ে ২২ নং ক্রমোজোমের লম্বা বাহুর একটি নির্দিষ্ট স্থানে যেয়ে জুড়ে বসা যেটাকে জীববিজ্ঞানের ভাষায় বলে t(9:22) বা translocation (9:22). এতক্ষনে কেউ কেউ নিশ্চই বুঝে ফেলেছেন যে কেন CML day পালন করা হয় ২২ শে সেপ্টেম্বর: আমেরিকা ধরনে তারিখ লিখতে ২২শে সেপ্টেম্বরকে লেখা হয় 9/22. t(9:22) তে আসলে যেটা ঘটে তা হলো, ক্রমোজোম 9 এ অবস্থিত ABL1 নামে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী নিষ্ক্রিয় জিনটি ক্রমোজোম 22 এর BCR নামক জিনের প্রভাবাধীনে যেয়ে অনন্ত সময়ের জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠার কারনে রক্তের দানাদার শ্বেত কনিকাগুলো (granulocytes) অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে থাকে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রথম আবিস্কৃত যে সুনির্দিষ্ট লক্ষভেদী ওষুধের কথা বলছিলাম সেটা ঐ ABL1 নামক ক্যান্সার জিন (oncogene) পুনরায় নিষ্ক্রিয় করার লক্ষ্যেই তৈরী।
CML এর স্বাভাবিক গতিপ্রকৃতি বা natural course হলো এর তিনটি পর্যায়- chronic phase, accelerated phase এবং blastic phase. পরবর্তী ২ পর্যায়কে সম্মিলিতভাবে advanced phase বা diseasd progression ও বলে। প্রকৃতপক্ষে chronic phase CML একেবারেই মামুলি কিছু রোগলক্ষন থাকে বা অনেক সময় তাও থাকে না এবং এই স্তরের রোগের কারনে মৃত্যুর সম্ভাবনা নাই বললেই চলে। তবে সমস্ত রোগীর শরীরের CMLই অবশ্যম্ভবীভাবে এক সময় অগ্রসর হয়ে accelerated phase তারপর blastic phase এ রূপান্তরিত হয় যার লক্ষনগত চরিত্র acute leukemia এর মত এবং মৃত্যু অবশ্যম্ভবী। তবে হ্যাঁ, এই রোগ অগ্রসরের গতি কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন রোগীর ক্ষেত্রে ব্যাপকরকম ভিন্ন ভিন্ন হয়। এই ভিন্নতা নির্ভর করে t(9:22) ছাড়াও অতিরিক্ত কিছু ক্রমোজোমগত/জেনেটিক পরিবর্তনসহ আরো কিছু নির্নায়কের উপর। তাই CML এই চরিত্রাবলী সম্পর্কে জানার সাথে সাথে বিজ্ঞানীদের মূল লক্ষ্য হয়েছে CML এর phase progression থামিয়ে দেয়া।
যেটা বলছিলাম, স্বাভাবিক ক্ষেত্রে (natural course) CML এর এই অগ্রসরের ঘটনা কারো ক্ষেত্রে অতি দ্রুত, এমনকি কয়েক মাসের মধ্যেও ঘটতে পারে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটা ঘটতে সময় লাগে বছরের পর বছর, এমনকি কখনো কখনো সেটা ১ দশকেরও বেশী। তাই chronic phase এ রোগীদের উপসর্গ মামুলি বা প্রায় অনুপস্থিত হলেও সাধারনতঃ এই পর্যায়ে থাকতে থাকতেই চিকিৎসকের সংস্পর্শে এসে যেন। তবে এখনও কিছু সংখ্যক রোগী, বিশেষতঃ অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশসমূহে, চিকিৎসকের কাছে প্রথমই আসেন accelerated অথবা blastic phase.
‘লিউকেমিয়া’ নাম শুনলেই সাধারনভাবে মনে আসে প্রায় অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুভয় এবং এর চিকিৎসা হিসেবে মনে এসে Bone Marrow Transplantation (BMT) বা Hemopoetic Stem Cell Transplantation এর কথা। তবে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রসরের কল্যাণে এই প্রচলিত মিথ আসলে অযৌক্তিক হয়ে পড়েছে; বিশেষতঃ CML এর ক্ষেত্রে।
বিকৃত জিন BCR-ABL বিরুদ্ধে targeted therapy বা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যভেদী ওষুধ Imatinib Mesylate আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত BMT -এর নাম্বার ১ উপযোগিতা ছিল CML. ১৯৯২ সালে এটি প্রথম আবিষ্কারের পর দীর্ঘ পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে এটি যখন ব্যবহারের ছাড়পত্র পায় ২০০১ সালে, তখন এতটাই সাড়া ফেলেছিল যে ঐ বছর ২৮শে মে বিখ্যাত Time Magazine এ প্রচ্ছদ প্রতিবেদন হয়েছিল “There is new ammunition in the war against cancer. These are the bullets.” তখন এই ওষুধটিকে বলে হতে থাকে ‘magic bullet’. এটি আবিষ্কারের পর chronic phase CML -এ BMT করা প্রায় একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। কারন CML এর চিকিৎসায় এই ওষুধের molecular remission এ সক্ষমতা বা রোগের কার্যকারণগত জেনেটিক পরিবর্তন BCR-ABL এর মাত্রা দৃষ্টিগ্রাহ্য মাত্রার নীচে নিয়ে যাবার ক্ষমতা। যার ফলে রোগের অগ্রসর প্রলম্বিত করে দেয়া বা কখনো কখনো সম্পূর্ণ আরোগ্য করে দেয়া সম্ভব। এই Imatinib আসলে tyrosine kinase নামে একধরনের এনজাইম এর inhibitor কার্যনিবৃতিকারী। এই Imatinib এরও কিছু কিছু সীমাবদ্ধতা এবং তার কার্যকারণ চিহ্নিতের পরিপ্রেক্ষিতে এই গোত্রের আরো গোটা চার পাঁচেক ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে, যার মধ্যে দুটি বাংলাদেশে পাওয়া যায়। এসব কিছুর পরেও কিছু রোগী, দেরীতে হলেও, রোগ অগ্রসরের (accelerated বা blastic) স্বীকার হচ্ছে বৈকি। তাদের জন্য BMT.
তবে এতসব সাফল্য অর্জনের জন্য ২টি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১) চিকিৎসা শুরুর আগে রোগীর সার্বিক অবস্থতা বিশেষতঃ রোগীর প্লীহার আকার, রক্তে বিভিন্ন ধরনের কোষের (eosinophil, basophil, blast) পরিমান এবং t(9:22) ছাড়াও আরো যেসব জেনেটিক/ক্রমোজোমের পরিবর্তন সম্পর্কে পরিষ্কার চিত্র নিয়ে রোগের ঝুঁকির গানিতিক পরিমাপ করে রাখা। ২) চিকিৎসার সময় নির্দিষ্ট সময় অন্তর নির্দিষ্ট কিছু পরীক্ষার (জেনেটিক পরীক্ষাসহ) রোগের গতি প্রকৃতির প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখা। এ বাবদে যে খরচ হয় তা অনেকের কাছে এমনকি অনেক চিকিৎসকের কাছেও বাড়াবাড়ি মনে হলেও এখানে আপোষ করার ফল খারাপ হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা।
এবার আসি ওষুধের দামের ব্যাপারে। Imatinib এর আবিষ্কারের স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান Novertis বাংলাদেশের মত স্বল্পোন্নত দেশে বছরে ৪ মাসের ওষুধ কেনা সাপেক্ষে বাকি ৮ মাসের ওষুধ বিনামূল্যে দেবার পরেও প্রতিদিনের ওষুধের গড় মূল্য পড়ত প্রায় ২ হাজার টাকা, অর্থাৎ বছরে ৭ লক্ষ টাকার অধিক, যেটা ছিল প্রায় সব রোগীর ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। তবে এখন দেশী বিদেশী অনেক প্রতিষ্ঠান এর জেনেরিক ভার্সন বাজারে আনার কারনে এর খরচ দৈনিক ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকার মধ্যে চলে এসেছে। ওষুধটি খেতে হতে পারে কমপক্ষে ৪ বছর থেকে অনির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত।
শেষ করার আগে CMLসংশ্লিষ্ট ২টি চমকপ্রদ তথ্য দিয়ে রাখি।
এক) রুডলফ ভারকো কর্তৃক এই রোগ লিউকেমিয়া নামে এবং এক ধরনের ক্যান্সার হিসেবে চিহ্নিত হবার আগেও কিছু বিজ্ঞানী এই রোগের বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তবে তাঁরা সবাই এটাকে কোন এক ধরনের জীবানু সংক্রমন মনে করেছিলেন।
দুই) বিখ্যাত গোয়ান্দা কাহিনী ‘শার্লক হোমস্’ এর স্রষ্টা স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের মৌলিক গবেষনা ছিল CML এ আর্সেনিক এর ব্যবহার বিষয়ে, যার ফলাফল তিনি বিখ্যাত Lancet জার্নালে ১৮৪২ সালে। অনেকই হয়তো জানেন বা এখন জেনে গেলেন কোনান ডয়েল ছিলেন একজন বড় মাপের চিকিৎসক। তার সৃষ্ট চরিত্র শার্লক হোমস্ যে একজন রসায়নবিদ এটাও তাঁর নিজ মেধার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।